-ড. আ ফ ম আবূ বকর সিদ্দীক
কোন মানুষের জীবন যতই ঐতিহাসিক হোক না কেন, যতক্ষণ না তার মধ্যে মানবিক গুণাবলী পরিপূর্ণতা লাভ করে ততক্ষণ তা আমাদের জন্য আদর্শ হতে পারে না। আর কোন জীবনের পূর্ণাঙ্গ মানবিক গুণাবলীর সমাবেশ এবং তা সব কিছু থেকে ত্রæটিমুক্ত তখনই প্রমাণিত হতে পারে, যখন তার সমস্ত অংশ আমাদের সামনে থাকে।
স্মর্তব্য যে, ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর সময়ের লোকদের সামনে ছিল এবং তাঁর ওফাতের পর বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় তা পুরোপুরি সংরক্ষিত আছে। তাঁর জীবনে সামান্যতম অংশ এমন নেই যে, ঐ সময় তিনি তাঁর দেশবাসীর দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
যেমন তাঁর জন্ম, দুধপান, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, ব্যবসায়ে যোগদান, চলাফেরা, বিবাহ, নবুওয়াত পূর্বকালের বন্ধু-বান্ধব, কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ ও চুক্তিতে অংশ গ্রহণ, ‘আল-আমীন’ উপাধি লাভ, কাবাগৃহে হাজরে আসওয়াদ স্থাপন, ধীরে ধীরে নির্জনপ্রিয়তা, হেরা-গুহায় নি:সঙ্গ অবস্থান, ওহী নাযিল, ইসলামের দাওয়াত প্রদান, প্রচার অভিযান, তায়েফ গমন, মিরাজ, হিজরত, যুদ্ধ, হুদায়বিয়ার সন্ধি, বিভিন্ন দেশে ইসলামের দাওয়াত প্রেরণ, ইসলাম প্রচার, দ্বীনকে পূর্ণতা প্রদান, বিদায় হজ্জ, ইন্তিকাল-এর মধ্যের কোন সময় দুনিয়াবাসীর দৃষ্টিসীমার আড়ালে নেই।
বস্তুত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের কোন একটি মুহূর্তও পর্দার অন্তরালে ছিল না। ঘরের মধ্যে তিনি থাকতেন স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এবং বাহিরে বন্ধু-বান্ধব ও ভক্তদের মজলিসে।
উল্লেখ্য যে, দুনিয়ার বিরাট প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিও নিজের ঘরে সাধারণ মানুষ হিসেবেই থাকেন। তাই ভল্টেয়ারের কথায় বলা যায়: ‘ঘড় সধহ রং যবৎড় ঃড় যরং াধষবঃ অর্থাৎ ‘কোন ব্যক্তি নিজের ঘরে ‘হিরো’ হতে পারে না।’ বাসওয়ার্থ স্মিথ তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘লাইফ অব মুহাম্মদ’-এ বলেছেন: “এ বক্তব্যটি ইসলামের নবী মুহাম্মদ সম্পর্কে সত্য নয়।”
ঐতিহাসিক গীবন বলেছেন: ‘মুহাম্মদের ন্যায় অন্য কোন নবী তাঁর অনুসারীদেরকে এমন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখী করেননি। যারা তাঁকে মানুষ হিসেবে ভালোভাবেই জানতেন, তাদের সামনে হঠাৎ তিনি নিজেকে নবী হিসেবে পেশ করেন। নিজের স্ত্রী, নিজের গোলাম, নিজের ভাই এবং নিজের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের সামনে তিনি নিজেকে নবী হিসেবে পেশ করেন এবং তারা বিনা দ্বিধায় তাঁর দাবী মেনে নেন।’
মানুষের জীবনের আভ্যন্তরীণ দুর্বলতার খবর স্ত্রীর চাইতে অধিক আর কেউ জানতে পারে না। কিন্তু এটি কি একটি বাস্তব সত্য নয় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ওপর সর্বপ্রথম তাঁর স্ত্রী ‘খাদীজাতুল কুবরা’ ঈমান এনেছিলেন? নবুওয়াত লাভের পূর্বে পনের বছর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন। তাঁর সম্পর্কে প্রতিটি বিষয় তিনি ব্যক্তিগতভাবে জানতেন। এসব সত্তে¡ও রাসূলুল্লাহ (সা.) নবুওয়াত দাবী করার পর তিনিই সর্বপ্রথম তাঁর দাবীর সত্যতা স্বীকার করে নেন।
স্মর্তব্য যে, অতিমহান ব্যক্তিও যিনি মাত্র একজন স্ত্রীর স্বামী, তিনিও তার স্ত্রীকে এ মর্মে ব্যাপক অনুমতি দানের হিম্মত রাখেন না যে, ‘তুমি আমার প্রত্যেকটি কথা, প্রত্যেকটি অবস্থা ও ঘটনা মানুষের সামনে বলে দেবে এবং যা কিছু গোপন আছে, তা-ও সকলের কাছে প্রকাশ করে দেবে।’
কিন্তু উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর একই সঙ্গে নয়জন স্ত্রী ছিলেন এবং তাদের সকলকে তিনি এ অনুমতি দিয়েছিলেন যে, ‘নির্জনে আমার মধ্যে যা কিছু দেখো, তা বিনা দ্বিধায় জনসমক্ষে বিবৃত করো। রাতের আঁধারে যা দেখো দিনের বেলায় তা প্রকাশ করে দিও, কপাটবদ্ধ ঘরের মধ্যে যা দেখো, খোলা ময়দানে তা সবাইকে শুনিয়ে দিও। এহেন চারিত্রিক দৃঢ়তা ও আত্মপ্রত্যয়ের নবী আর কেউ নেই!
বস্তুত: রাসূলুল্লাহ (সা.) নির্জনে বা জনসমক্ষে, মসজিদে বা জিহাদের ময়দানে, রাতের নামাযে মশগুল বা সেনা-দলের সংগঠনে ব্যস্ত, মিম্বরের উপর বা নির্জন কক্ষে-যখন যেখানে থাকতেন, সর্বাবস্থায় তিনি প্রত্যেক ব্যক্তিকে হুকুম দিয়েছিলেন:
“তোমরা আমার যাবতীয় অবস্থা ও কাজ-কর্মকে মানুষের সামনে তুলে ধরো।”
তাঁর পবিত্র বিবিগণ তাঁর নির্জন কক্ষের অবস্থা ও ঘটনাবলী প্রকাশ করতেন। মসজিদে নববীর একটি উঠান ছিল, গৃহহীন সাহাবী (রা.) সেখানে অবস্থান করতেন। তাঁরা দিনের বেলা পালাক্রমে বন থেকে কাঠ কেটে আনতেন, তা বিক্রি করে খাবার ব্যবস্থা করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বাণী শ্রবণ করতেন। তাঁর অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও তাঁর সাহচর্যে অবশিষ্ট সময় কাটাতেন। তাঁদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০ জন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন। তাঁর চাইতে কোন সাহাবী অধিক হাদীস বর্ণনা করেননি।
বলা যায়, এ সত্তর জন সাহাবী গুপ্তচরের ন্যায় অতি আগ্রহ সহকারে সব সময় তাঁর অবস্থা দেখতেন এবং তা অন্যের নিকট বর্ণনা করতেন। মদীনার সব অধিবাসী একাদিক্রমে দশ বছর যাবৎ প্রতিদিন অন্তত: পাঁচবার তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ ও কার্যকলাপ লক্ষ্য করতো। যুদ্ধকালে হাজার হাজার সাহাবী দিবারাত্রি তাঁকে দেখার ও তাঁর অবস্থা অবগত হবার সুযোগ লাভ করতেন। মক্কা বিজয়ের সময় দশ হাজার, তাবুক যুদ্ধে তিরিশ হাজার এবং বিদায় হজ্জে প্রায় সোয়া লক্ষ সাহাবী তাঁকে দেখার সুযোগ পান। এভাবে নির্জনে ও জনসমক্ষে, ঘরে ও বাইরে, মসজিদের মধ্যে ও মসজিদের উঠানে সাহাবাদের মজলিসে, শিক্ষালয়ে ও যুদ্ধক্ষেত্রে, যে ব্যক্তি তাঁকে যে অবস্থায় দেখেছেন তার ব্যাপক প্রচারের জন্য তাঁর কঠোর নির্দেশ ছিল।
আজো তাঁর শত্রæ ও বিরোধীরা সব রকমের যাচাই-পরখ ও অনুসন্ধান চালাবার পর কেবল ‘জিহাদ’ ও ‘তাঁর স্ত্রীদের সংখ্যা’ ছাড়া অন্য কোন বিষয়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেনি। তাহলে এমন জীবনকে মাসূম ও নিষ্পাপ বলা সংগত, না এমন জীবনকে নিষ্পাপ বলা সংগত, যার জীবনের বিরাট অংশ আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে প্রচ্ছন্ন আছে?
অন্যভাবে দেখা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) সব সময় তাঁর ভক্তদল দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন না, বরং তিনি মক্কায় কুরাইশদের মাঝে অবস্থান করেন। তিনি নবুওয়াতপূর্ব চল্লিশটি বছর তাদের মাঝে কাটান।
তাছাড়া ব্যবসায়ী জীবন, লেনদেন, ব্যবহারিক ও কারবারী জীবন; যেখানে প্রতি পদে পদে অসদ্ব্যবহার, ওয়াদা-খেলাফী ও খিয়ানতের গভীর আবর্ত বিদ্যমান ছিল, এসব পথ তিনি এমন সতর্কতার সাথে অতিক্রম করেন যে, তাঁকে জনগণ ‘আমীন’ উপাধি দান করে এবং তাঁর নবুওয়াত প্রকাশের পরেও লোকেরা তাঁকে আগের মত বিশ্বস্ত মনে করে তাঁর কাছে তাদের আমানতসমূহ গচ্ছিত রাখতেন। তাই তিনি হিজরতের সময় লোকদের আমানত ফেরত দেবার জন্য হযরত আলী (রা.) কে মক্কায় রেখে যান। তাঁর নবুওয়াত দাবীর বিরুদ্ধে কুরাইশরা বিক্ষোভ প্রকাশ করে। তাঁকে সামাজিক বয়কট করে, তাঁর সাথে সব রকমের শত্রæতা করে, তাঁকে গালি দেয়। তাঁর পথ রোধ করে তাঁর ওপর নাপাক-আবর্জনা নিক্ষেপ করে। তাঁর প্রতি পাথর ছুঁড়ে মারে। তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। তাঁকে যাদুকর আখ্যা দেয়, কবি বলে আখ্যায়িত করে, পাগল বলে বিদ্রæপ করে। কিন্তু তাঁর আচার-ব্যবহার, কর্ম ও চরিত্রের বিরুদ্ধে একটি কথা বলার সাহসও কেউ করেনি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, একদিন কুরাইশদের বড় বড় নেতারা মজলিস সরগরম করছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কেই চলছিল গরমগরম আলোচনা। তখন সেখানে কুরাইশদের অন্যতম অভিজ্ঞ ও বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণকারী নেতা নাযার ইবনুল হারিস বলেন:
‘হে কুরাইশগণ! তোমাদের উপর যে বিপদ এসেছে, তার কোন সুরাহা তোমরা করতে পারলে না। মুহাম্মদ তোমাদের সামনে শিশু থেকে যুবকে পরিণত হয়েছে, সে তোমাদের মাঝে সব চাইতে জনপ্রিয়, সত্যবাদী ও আমানতদার ছিল। আর এখন তার চুল সাদা হতে চলেছে এবং সে এখন তোমাদের সামনে এসব কথা বলছে। আর তাই তোমরা তাকে বলছো, যাদুকর, গুনিন, কবি ও পাগল। খোদার কসম! আমি তার কথা শুনেছি। মুহাম্মদের মধ্যে এ দোষগুলির একটিও নেই।’ (সিরাতে ইবনু হিশাম বর্ণিত)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব চাইতে বড় শত্রæ আবূ জেহেল বলতো: ‘হে মুহাম্মদ! আমি তোমাকে মিথ্যা বলছিনা, তবে তুমি যা কিছু বলছো এবং বুঝাতে চাচ্ছ, সেগুলিকে আমি সত্য মনে করি না।’
আল-কুরআনের নি¤েœাক্ত আয়াতটি এ সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে:
قَدْ نَعْلَمُ اِنَّهُ لَيَحْزُنُكَ الَّذِيْ يَقُوْلُوْنَ فَاِنَّهُمْ لاَيُكَذِّبُوْنَكَ وَلَكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِايَاتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ-
অর্থাৎ “আমি জানি যে, কাফিরদের কথা আপনাকে মর্মাহত করে। তবে এরা আপনাকে প্রতিপন্ন করে না; বরং এ যালিমরা আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করে।”
উল্লেখ্য, আল্লাহ তাআলা যখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে হুকুম দিলেন যে, ‘তুমি তোমার খান্দানের লোকদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত দাও; তখন তিনি সাফা পাহাড়ের নিকট সকলকে সমবেত করে বললেন:
‘হে কুরাইশগণ! যদি আমি তোমাদের এ কথা বলি যে, এ পাহাড়ের পেছন থেকে একটি সেনাদল তোমাদের ওপর হামলা করতে আসছে, তাহলে তোমরা কি তা বিশ্বাস করবে? সবাই বললো: হ্যাঁ, কারণ আমরা কখনো তোমাকে মিথ্যা বলতে শুনিনি।” (সহীহ বুখারী)।
আরো প্রণিধানযোগ্য যে, রুমের কায়সারের দরবারে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দূত পৌঁছেছেন, কুরাইশ বংশীয় কাফিরদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রধান শত্রæ ও প্রতিদ্বন্ধী আবূ সুফিয়ান, যিনি একাধিক্রমে ছয় বছর তার বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেছেন, তাকেই রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বিবরণ সম্পর্কিত সাক্ষ্য ও অনুসন্ধানের জন্য আহবান জানানো হয়। এক শত্রæ তার এমন এক শত্রæর পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে, যাকে সে মনেপ্রাণে ধরাপৃষ্ঠ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। এমন এক পরাক্রমশালী বাদশাহর দরবারে এ সাক্ষ্য দিতে হচ্ছে যে, তাকে কোনক্রমে রাজী করাতে পারলেই মুহূর্তের মধ্যে তার বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে মদীনার দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। এ সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তরগুলো এরূপ:
বাদশাহ কায়সার: নবুওয়াতের দাবীদারের বংশগত মর্যাদা কোন পর্যায়ের?
আবূ সুফিয়ান: সম্ভ্রান্ত।
কায়সার: এর আগে এ বংশের কেউ কি নবুওয়াতের দাবী করেছে?
আবূ সুফিয়ান: না।
কায়সার: এ বংশের কেউ বাদশাহ ছিল কি?
আবূ সুফিয়ান: না।
কায়সার: যারা তাঁর ধর্ম গ্রহণ করেছেন তারা দুর্বল না প্রভাবশালী?
আবূ সুফিয়ান: দুর্বল।
কায়সার: তাঁর অনুসারীর সংখ্যা বাড়ছে না কমছে?
আবূ সুফিয়ান: বেড়েই চলছে।
কায়সার: তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন এমন কোন ঘটনা কি তোমরা জানতে পেরেছ?
আবূ সুফিয়ান: না।
কায়সার: তিনি কি কখনো নিজের প্রতিজ্ঞা বা চুক্তি ভঙ্গ করেছেন?
আবূ সুফিয়ান: এখনো পর্যন্ত তো ভঙ্গ করেন নি, তবে ভবিষ্যতের কথা বলা যায় না।
কায়সার: তিনি কী শিক্ষা দেন?
আবূ সুফিয়ান: তিনি বলেন, এক আল্লাহর ইবাদত করো। নামায পড়, পাপ কাজ থেকে দূরে থাক, সত্য কথা বলো, আত্মীয়-পরিজনদের হক আদায় কর। বস্তুত: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন ছাড়া অন্য কোথাও কি এমন নাযুক অবস্থায় এমন সাক্ষ্য পাওয়া যেতে পারে? তাঁর চারিত্রিক ও মানবিক গুণাবলীর পূর্ণতার জন্য এর চাইতে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে?
উল্লেখ্য যে, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর প্রথমে ঈমান আনেন, তাঁরা নদী-তীরের মৎস্যজীবি ছিলেন না, তাঁরা মিশরের পরাধীন ও গোলাম জাতির অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না, বরং তাঁরা ছিলেন একটি আযাদ জাতির লোক। সে জাতি বুদ্ধি ও জ্ঞানের দিক দিয়ে সুপরিচিত ছিল এবং তারা সৃষ্টির শুরু থেকে সে সময় পর্যন্ত কখনো কারো আনুগত্য করেনি। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ইরান, সিরিয়া, মিশর ও এশিয়া মাইনর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তাদের মধ্যে এমন লোক ছিলেন, যাদের সূ² দৃষ্টি, গভীর জ্ঞান-বুদ্ধি ও মেধার প্রমাণ আজো আমাদের সামনে বর্তমান আছে।
তাদের মধ্যে এমন লোকও ছিলেন, যারা বিরাট সেনাবাহিনীর মুকাবিলা করে বিজয়ী হন এবং দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সেনাপতিদের অন্তর্ভূক্ত হন। তাদের মাঝে এমন লোকও ছিলেন, যারা বিরাট দেশের উপর শাসন চালান এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যোগ্যতার প্রমাণ দেন। এরা সবাই রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতিটি কাজকর্ম অনুসরণ করেন এবং তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপের অনুসৃতিকে নিজেদের জন্য বিরাট সৌভাগ্য বলে মনে করতেন। এটিও তাঁর মানবিক গুণাবলীর পরিপূর্ণতা তার অকাট্য ও জ্বলন্ত প্রমাণ।
স্মর্তব্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো তাঁর কোন অবস্থা ও জীবনের কোন ঘটনা গোপন রাখার চেষ্টা করেননি। তিনি যেভাবে জীবন যাপন করতেন, তা সবার নিকট প্রকাশ্য ছিল এবং আজো আছে। তাঁর প্রিয়তমা পতœী হযরত আয়েশা (রা.) নয় বছর তাঁর সঙ্গে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন। তিনি বলেনঃ
‘যে তোমাকে বলে, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর নির্দেশনাবলীর মধ্য থেকে কিছু লুকিয়ে রেখেছেন এবং মানুষের নিকট তা প্রকাশ করেননি, তোমরা তাকে সত্যবাদী বলে মনে করো না।’ (সহীহ বুখারী)
কেননা, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন:
يَااَيُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَا اُنْزِلَ اِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَ- وَاِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ
অর্থ: “হে রাসূল! আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু আপনার উপর নাযিল হয়েছে, তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে তো তাঁর পয়গাম পৌঁছালেন না।”
উল্লেখ্য যে, দুনিয়ার কোন ব্যক্তিই তার সামান্যতম দুর্বলতার কথাও প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে চায় না। বিশেষ করে যে ব্যক্তি কোন একটি জামাতের নেতৃত্ব দেয় এবং তাও আবার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব, সে কখনো এ কাজে ব্রতী হয় না।
কিন্তু কুরআন মাজীদে এমন অনেক আয়াত আছে, যেগুলিতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বাহ্যিক ছোট-খাট ভুল-ত্রæটির জন্য তাঁকে সতর্ক করা হয়েছে। এ সত্তে¡ও তিনি কুরআনের প্রতিটি আয়াত পাঠ করে লোকদের শুনিয়েছেন। লোকেরা তা মুখস্থ করেছে। প্রত্যেকটি মসজিদে ও মেহরাবে সেগুলির আবৃত্তি হয়েছে। আর আজো যেখানে মুহাম্মদ (সা.) এর নাম পরিচিত, সেখানে তাঁর অনুসারীদের এগুলিও উচ্চারিত হচ্ছে। অথচ এ মামুলী ভ্রান্তিগুলির উল্লেখ যদি কুরআনে না থাকতো তাহলে আজ দুনিয়ার মানুষ এগুলির কথা জানতেই পারতো না। কিন্তু একটি পবিত্র জীবনের প্রত্যেকটি বস্তুরই প্রকাশ্য দিবালোকে আসার প্রয়োজন আছে এবং তাই হয়েছে।
প্রণিধানযোগ্য যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পোষ্যপুত্র যায়দের স্ত্রীকে বিয়ে করেন যা তৎকালীন আরবদের নিকট আপত্তিকর ছিল। আল-কুরআনে এ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। হযরত আয়েশা (রা.)-বলেন:
‘রাসূলুল্লাহ (সা.) যদি আল্লাহর নাযিলকৃত কোন আয়াত গোপন রাখতে পারতেন, তাহলে অবশ্যই এ আয়াতকে লুকিয়ে রাখতেন, যে আয়াতে বিয়ের কথা উল্লেখ আছে।’ (মুসনাদে আহমদ, ৬ষ্ঠ খÐ, ২৩৩ পৃষ্ঠা)।
এর ফলে অজ্ঞ লোকদের অনর্থক প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগই থাকতো না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা করেননি। এ থেকে প্রমাণিত যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের কোন অংশ প্রচ্ছন্ন বা গোপন নেই।
এ ব্যাপারে ‘বাসওয়ার্থ স্মিথের’ সাক্ষ্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন:
“এখানে সব কিছুই উজ্জ্বল দিবালোকে পরিস্ফুট। আসলে ব্যক্তি জীবনের গভীরতম অঞ্চল চিরকাল আমাদের নাগালের বাইরে থাকবে। কিন্তু আমরা মুহাম্মদের বাহ্যিক জীবনের প্রত্যেকটি বিষয় সম্পর্কে অবগত। তাঁর যৌবন, তাঁর নবুওয়াতপ্রাপ্তি, মানুষের সাথে তাঁর সম্পর্ক, তার অভ্যাস, তাঁর প্রাথমিক চিন্তাধারা এবং এর ক্রম-উন্নতি, তাঁর উপর ওহীর অবতরণ, তাঁর মিশন ঘোষিত হবার পর একখানা কিতাব (কুরআন) আমাদের কাছে আছে। এ কিতাবটি নিজের মৌলিকত্বের ব্যাপারে সংরক্ষিত থাকার এবং অবিন্যস্ত বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে অদ্বিতীয়। এ কিতাবের অভ্যন্তরীণ সত্যতার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।”
ঐতিহাসিক ‘গীবন’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে যা বলেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘প্রথম যুগের কোন পয়গাম্বর সত্যতার এমন কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি, যেমন মুহাম্মদ উত্তীর্ণ হয়েছেন। সর্বপ্রথম তিনি এমন সব লোকের সামনে নিজেকে নবী হিসেবে পেশ করেন, যারা মানুষ হিসেবে তাঁর যাবতীয় দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত ছিল। যারা তাঁকে সব চাইতে বেশী জানতেন, যেমন তাঁর স্ত্রী, তাঁর গোলাম, তাঁর চাচাতো ভাই, তাঁর সব চাইতে পুরাতন বন্ধু; যার সম্পর্কে মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন যে,
‘একমাত্র সেই বন্ধুই কখনো পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেনি এবং কখনো শঙ্কিত হয়নি, এসব লোকই সর্বপ্রথম তাঁর অনুসারী হয়। এক্ষেত্রে সাধারণত: নবীদের ভাগ্যে যা ঘটে থাকে, মুহাম্মদ (সা.) এর ব্যাপারে হয়েছে ঠিক তার বিপরীত। যারা তাঁকে জানতো না, তারা ছাড়া অন্যদের কাছে তিনি অখ্যাত ছিলেন না।’
উল্লেখ্য যে, তাঁকে সর্বপ্রথম তারাই মেনেছেন, যাঁরা তাঁর অবস্থা, চরিত্র ও অভ্যাস সমূহ সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞাত ছিল এবং তাঁরা সবাই নিজেদের ঈমান ও আকীদার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। হযরত খাদীজা (রা.) তিন বছর পর্যন্ত ‘শা’বে আবূ তালিব’ নামক উপত্যকায় অবরুদ্ধ ছিলেন। সেখানে ক্ষুধা, অনাহার ও অর্ধাহারের সম্মুখীন হতে হয়। যখন চারদিক থেকে শত্রæরা পশ্চাদ্ধাবন করছিল, তখন রাতের অন্ধকারে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) ভীষণ বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে তাঁর সহযাত্রী হন। হযরত আলী (রা.) এমন বিছানায় শয়ন করেন, যা পরদিন সকালে রক্তে-রঞ্জিত হওয়ার ছিল। হযরত যায়েদ (রা.) এমন ক্রীতদাস ছিলেন, যিনি পিতার সন্ধান পাবার জন্য তার পীড়াপীড়ি সত্তে¡ও নিজের আধ্যাত্মিক পিতাকে ত্যাগ করেননি। ‘ক্যাডফ্রে হেগেন্স’-‘এ্যাপলজি ফর মুহাম্মদ’ গ্রন্থে বলেছেন:
‘খ্রিষ্টানরা যদি একথা মনে রাখে, তাহলে খুবই ভালো হবে যে, মুহাম্মদের পয়গাম তাঁর অনুসারীদের মনে এমন নেশার সৃষ্টি করেছিল, যা যীশুর প্রথম যুগের অনুসারীদের মধ্যে সন্ধান করা অর্থহীন। যীশুকে যখন শূলদÐের উপর চড়ানো হয়, তখন তাঁর অনুগামীরা তাঁকে ফেলে পলায়ন করে। তাদের ধর্মীয় নেশা টুটে যায় এবং তারা তাদের শ্রদ্ধেয় নেতাকে মৃত্যুর কবলে শৃঙ্খলিত রেখে সরে পড়ে।
অপরদিকে মুহাম্মদ (সা.) এর অনুসারীরা তাদের মযলুম নবীর চারদিকে সমবেত হয়, তাঁর নিরাপত্তার জন্য নিজেদের জানমাল বিপদের মাঝে নিক্ষেপ করে তাঁকে শত্রæদের উপর বিজয়ী করে।’ (উদর্ুু অনুবাদ, পৃষ্ঠা-৬৬-৬৭, ১৮৭ সালে বেরি থেকে মুদ্রিত)।
উল্লেখ্য যে, ‘ওহুদ যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনী যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উপর একযোগে হামলা করে এবং মুসলিম বাহিনীর সারিসমূহ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়, তখন তিনি আওয়ায দেন:
‘কে আমার জন্য জীবন দেবে?’ এ আওয়ায শোনার সাথে সাথেই সাতজন আনসার এগিয়ে আসেন এবং তারা সকলে বিপুল বিক্রমে লড়াই করতে করতে শহীদ হন।’
এ যুদ্ধে জনৈক আনসার মহিলার পিতা, ভ্রাতা ও স্বামীর ন্যায় প্রিয়জন শহীদ হন। পরপর এ তিনটি হৃদয় বিদারক সংবাদ মহিলাটি শোনেন এবং জিজ্ঞাসা করতে থাকেন: ‘আমার প্রিয় রাসূল (সা.) কেমন আছেন?’ লোকেরা বলে: তিনি নিরাপদে আছেন। এ সত্তে¡ও তিনি ছুটতে ছুটতে ওহুদ প্রান্তরে হাযির হয়ে তাঁর চেহারা দেখে বলে উঠেন:
كل مصيبة بعدك جلل يارسول الله-
“হে আল্লাহর রাসূল! আপনি নিরাপদে থাকলে সকল বিপদই তুচ্ছ!” (সুবহানাল্লাহ!)
উল্লেখ্য যে, ইসলামের দৃষ্টিতে মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন মুসলমানের জন্য পরিপূর্ণ আদর্শ। তাই এ আদর্শের সকল দিক সবার সামনে থাকা দরকার এবং তা সামনে আছে। এর দ্বারা প্রমাণিত যে, তাঁর জীবনের কোন একটি বিষয়ও লুপ্ত হয়ে যায়নি। কোন একটি ঘটনাও পর্দার অন্তরালে নেই। তাঁর জীবনের সবকিছুই ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে। তাই বলা যায়, যে জীবনের প্রত্যেকটি দিক এমনি উজ্জ্বল ও প্রোজ্জ্বল, একমাত্র সে জীবনটিই সব মানুষের জন্য আদর্শ ও অনুকরণীয়।
একদা জনৈক ইয়াহুদী একজন সাহাবীকে ব্যঙ্গ করে বলেছিলঃ
‘তোমাদের নবী তোমাদেরকে প্রত্যেকটি বস্তুর শিক্ষাদান করেন এবং সাধারণ ও মামুলি কথাও শিক্ষা দেন।’ জবাবে সাহাবী স্বগর্বে বলেছিলেন:
‘অবশ্যই আমাদের নবী আমাদেরকে প্রত্যেকটি বস্তুর শিক্ষা দান করেন। এমন কি তিনি আমাদের ইসতিনজা ও হস্ত প্রক্ষালনের শিক্ষাও দেন।’ আর আজো আমরা সেই পূর্ণাঙ্গ শিক্ষামূলক জীবনকে গর্বের সাথে বিশ্বের সামনে উপস্থাপিত করি। অর্থাৎ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন যেন দুনিয়ার গৃহ-মুকুর।
এর মধ্যে নিজের দেহ-আত্মা, ভেতর-বাইর, কথা-কাজ, জিহবা-হৃদয়, রুসুম-রেওয়ায, নিয়ম-পদ্ধতি, চাল-চলন প্রভৃতির প্রতিফলন দেখে প্রত্যেক ব্যক্তি সেগুলির সংস্কার ও সংশোধন করতে পারে।
আর এজন্যই মুসলিম জাতি নিজের সভ্যতা, সংস্কৃতি, সামাজিকতা ও নৈতিকতার জন্য তার ধর্মের ও তার রাসূলের জীবনের বাইরে থেকে পৃথক কিছু চায় না। চাওয়ার কোন প্রয়োজনও হয় না।
বস্তুত এরূপ ব্যাপকতা ও পরিপূর্ণতার সাথে কোন পরিপূর্ণ মানুষের জীবন দুনিয়ার সামনে বিদ্যমান নেই, তাই সমগ্র মানব জাতির জন্য মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন একমাত্র পরিপূর্ণ আদর্শ এবং এহেন পরিপূর্ণ ও আবরণহীন জীবনই সমস্ত মানবজাতির জন্য আদর্শ হতে পারে।
[লেখক: পীর ছাহেব, খানকায়ে খাস মুজাদ্দিদিয়া, ঢাকা;
প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও প্রফেসর, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]