মাহবুবে সুবহানী, বড়পীর, মহীউদ্দিন আবদুল কাদির জিলানী (রহ.)

তাসাউফের ইতিহাসে এমন কিছু মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছিলো, যারা দাওয়াত ও ইরশাদে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শাইখ আবদুল কাদির জিলানী (রহ.)। তাঁর জীবন ছিল তাসাউফ, সমাজ সংস্কারের দাওয়াত এবং ইসলামী শরিয়তের প্রতি দৃঢ় আনুগত্যের অনন্য সমন্বয়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। আমলের ক্ষেত্রে আন্তরিক হওয়া এবং ইসলামী আখলাকে সুশোভিত হওয়াই ছিলো তাঁর দাওয়াতের লক্ষ্য।

এই প্রবন্ধে আমরা হযরত শাইখ আবদুল কাদির জিলানী (রহ.) এর জীবনের কিছু দিক এবং তাঁর ইলমি মর্যাদার ব্যাপারে আলোচনা করবো। তাঁর ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের মতামত আমরা এতে তুলে ধরব। এছাড়া, তাঁর তারবিয়াত সংক্রান্ত বিষয় এবং কাদিরিয়্যাহ তরিকাহ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টার ব্যাপারেও আলোকপাত করবো। তিনি যে তরিকাহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, একে ইসলামি বিশ্বের প্রথম সুসংগঠিত সূফী তরিকাহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মুরীদদের সংঘবদ্ধ করা, তাদেরকে তরিকাহর শাইখদের সঙ্গে সংযুক্ত করা এবং যে মূলনীতির উপর তরিকতের ভিত গড়ে উঠেছে তার বিবরণ দেয়ার মত কাজগুলো এই তরিকার মাধ্যমে সম্প্নন হয়েছে।

নাম ও নসবনামা:

তিনি সাইয়িদ শাইখ আবু সালেহ মুহীউদ্দীন আবদুল কাদির ইবনে আবু সালেহ মুসা জঙ্গি দোস্ত ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে ইয়াহইয়া ইবনে মুহাম্মদ ইবনে দাউদ ইবনে মুসা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে হাসান ইবনে সাইয়িদুনা ইমাম হাসান (রা.) (তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দৌহিত্র) ইবনে আমীরিল মুমিনীন আলী ইবনে আবি তালিব কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু। (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) (গিবতাতুন নাযির, ইবনে হাজার আসকালানী, ১/৯, বাহজাতুল আসরার)।

মায়ের দিক থেকে নসবনামা:

তার মাতা ছিলেন ফাতিমা বিনতে সাইয়িদ আবদুল্লাহ আস-সুমাঈ আয-যাহিদ ইবনে আবু আবদুল্লাহ জামালুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে মাহমুদ ইবনে আবুল আতা আবদুল্লাহ ইবনে কামালুদ্দীন ঈসা ইবনে আবি আবদুল্লাহ আলাউদ্দীন মুহাম্মদ আল-জাওয়াদ ইবনে ইমাম আলী আর-রিদা ইবনে ইমাম মূসা আল-কাযিম ইবনে ইমাম জাফর আস-সাদিক ইবনে ইমাম মুহাম্মদ আল-বাকির ইবনে ইমাম আলী যায়নুল আবিদীন ইবনে ইমাম হুসাইন ইবনে ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব। (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) (ইতহাফুল আকাবীর ফি সিরাতি ওয়া মানাকিবিল ইমাম মুহীউদ্দীন আব্দিল কাদির, পৃ: ১১৫)।

উপাধী ও উপনাম:

সীরাত ও জীবনীগ্রন্থসমূহের ভাষ্য অনুযায়ী তাঁর কুনিয়াত বা উপনাম ছিল আবু মুহাম্মাদ এবং তাঁর পরিচয়সূচক নাম ছিল আল-জিলানী বা আল-জীলী।

শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) এর অনেকগুলো লকব বা উপাধি ছিলো। তাঁর এই লকবগুলো বেশ তাৎপর্যবহ। এগুলো অনেকটা আমাদের সময়ের একাডেমিক সনদপত্র ও পণ্ডিত বা বিখ্যাত ব্যক্তিদেরকে প্রদত্ত পদকসমূহের মতোই, যা তাদের কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য এবং তাদের উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য প্রদান করা হয়ে থাকে। আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) এর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত উপাধিগুলোর মধ্যে ছিল— “ইমাম”। (যাইলু তাবাকাতিল হানাবিলা, ইবন রজব হাম্বলী, ৩/৩২) এবং “শাইখুল ইসলাম” (সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী, ২০/৪৩৯)।

জন্ম ও শৈশব:

তিনি তাকওয়া ও পরহেযগারির জন্য প্রসিদ্ধ এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে, পবিত্র রামাদান মাসের প্রথম রাতে জন্মগ্রহণ করেছেন। অধিকাংশ সূত্র মতে, তাঁর জন্ম হয়েছিল জিলান অঞ্চলে ৪৭০ হি. সালে। জিলান হচ্ছে তাবারিস্তানের পাশে ছড়িয়ে থাকা গ্রামসমষ্টির নাম। (তাফরীহুল খাতির)।

হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) এর জন্ম, জীবন ও ইন্তেকালের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে কোন একজন কবি পংক্তি রচনা করেছেন। আল্লাহ তাকে জাযা দিন। পঙক্তিটি হলো—

إِنَّ بَازَ اللهِ سلطانُ الرجالِ

جاء في عشقٍ توفي في كمالِ

অর্থ: আল্লাহর বাজপাখি, মানুষের সুলতান,

তিনি ‘ঈশক’ এ জন্মেছেন এবং ‘কামাল’ এ তাঁর ওফাত হয়েছে।

এখানে আরবী “عشق” শব্দটির আবজাদ সংখ্যামান দাঁড়ায় ৪৭০, যা আব্দুল কাদির জিলানীর জন্মসাল নির্দেশ করছে। আর “كمال” শব্দটির সংখ্যামান ৯১, যা তাঁর আয়ুষ্কাল নির্দেশ করছে। এই দুটি যোগ করলে হয় ৫৬১, যা তাঁর ইন্তেকালের সাল নির্দেশক (৫৬১ হিজরি)। (সিররুল আসরার ওয়া মাযহারুল আনওয়ার, ১৪১)

শাইখের বাগদাদ গমন:

শায়খ (রহ.)  জিলান থেকে বাগদাদে রওনা হয়ে ৪৮৮ হিজরিতে বাগদাদে প্রবেশ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল আঠারো বছর। সেখানে তিনি অসংখ্য বিশিষ্ট আলেম ও খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করেন। ফলে ক্রমে তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে এক মহীরুহ আলিমে পরিণত হন।

ইবনে রজব হাম্বলী (রহ.) তাঁর ‘যাইলু তাবাকাতিল হানাবিলা’ গ্রন্থে তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে: “তিনি ছিলেন যুগের শাইখ, আরিফদের আদর্শ, শাইখদের সুলতান। তিনি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান, কারামাত, জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞার অধিকারী।” (যাইলু তাবাকাতিল হানাবিলা, ২/১৮৯)

আবয়ব ও মর্যাদার বিবরণ:

ইবন কুদামাহ আল মাকদিসি (রহ.) বলেছেন: “আমাদের শাইখ মুহীউদ্দীন আবদুল কাদির (রহ.) কৃশকায় দেহের অধিকারী ছিলেন। উচ্চতায় ছিলেন মাঝারি। প্রশস্ত বুকের অধিকারী ছিলেন। তাঁর দাড়ি ছিল লম্বা। গায়ের রঙ ছিলো শ্যামলা। ভ্রু দুটি ছিল কাছাকাছি সংযুক্ত। তিনি অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন। তাঁর কন্ঠ ছিলো জোরালো। চেহারা ছিলো গম্ভীর ও সুন্দর। তিনি উচ্চ মর্যাদা এবং পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। “(মিরআতুয যামান ফি তাওয়ারিখিল আইয়ান, সিবত ইবনিল জাওযী, ২১/৯২)

তাঁর কতিপয় শাইখ ও উস্তাদ:

শাইখ (রহ.) প্রখ্যাত আলেমদের কাছ থেকে কুরআন, উসূল এবং ফিকহের শাখা-প্রশাখার জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। সেইসব আলেমদের মধ্যে আলী ইবন আকীল আল-হাম্বলী (রহ.) ও মাহফূয আল-কালওয়াজানী (রহ.) ও ছিলেন.।

তিনি তাঁর শাইখ হাম্মাদ আদ-দাব্বাস (রহ.)-এর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। শাইখ হাম্মাদ আদ-দাব্বাস (রহ.) শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) কে মুজাহাদা ও রূহানী রিয়াজতের প্রতি উৎসাহী করে তুলেছিলেন। ফলে শাইখ (রহ.) ইরাকের মরুভূমিতে সফরে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তিনি নির্জনবাস ও মুজাহাদায় লিপ্ত হয়ে নিজের নফসের বিরোধিতা, প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম, অনিদ্রা ও ক্ষুধা সহ্য করা, নির্জন স্থানে অবস্থান করা—এসব কঠিন সাধনার পথ অবলম্বন করেছিলেন। এ সময় তিনি ইবাদতে মগ্ন থাকতেন এবং নিয়মিত যিকির-আযকারে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। (জামিউ কারামাতিল আউলিয়া, ইউসুফ আন নাবহানী, ২/২০২)

তাঁর কতিপয় খ্যাতনামা শিষ্য:

শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) এর কাছ থেকে অনেকেই জ্ঞান আহরণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ‘আল-আনসাব’ এর গ্রন্থাকার আস-সামআনি, উমর ইবন আলী আল কুরাশী, হাফিজ আব্দুল গনী আল মাকদিসি, শাইখ মুওয়াফফাকুদ্দীন ইবন কুদামাহ ও তার পুত্রদ্বয় আব্দুর রজাক ও মুসা, শায়খ আলী ইবন ইদ্রিস আল-ইয়াকূবী, আহমদ ইবন মুতিঈ আল বাজিসরাই প্রমুখ। আরো অসংখ্য আলিম তাঁর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন এবং অগণিত শিক্ষার্থী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।

ইলমি মর্যাদা:

ইমাম হাফেজ আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন মুহাম্মদ আল-ইশবিলি (রহ.) বলেছেন: “আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) বাগদাদের হাম্বলী ও শাফিঈ আলেমদের মধ্যে একজন ফকিহ এবং তাঁদের শাইখ ছিলেন। ফকিহ-ফকীর এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর পরিপূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তিনি যেন ইসলামের একটি স্তম্ভ হয়ে উঠেছিলেন। বিশিষ্ট কিংবা সাধারণ সকলেই তাঁর দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। তিনি দাওয়াতের ক্ষেত্রে ছিলেন সফল ব্যক্তিত্ব। সহজেই তাঁর চোখে পানি চলে আসত। সর্বদা যিকির-ফিকিরে নিয়োজিত, চিন্তাশীল, হৃদয়বান, সদাচারী, উদার, জ্ঞানসম্পন্ন, উত্তম চরিত্রের অধিকারী, পবিত্র বংশধর এবং ইবাদত ও ইজতিহাদে সুদৃঢ় ছিলেন তিনি। (কালাইদুল জাওয়াহির, মুহাম্মাদ ইবন ইয়াহইয়া আল হাম্বলী, পৃ: ১৯৩)

ফতওয়া:

শায়খ উমর আল-বাযযাজ (রহ.) বলেছেন: শায়খ (রহ.) এর কাছে ইরাকসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে ফতওয়া সংক্রান্ত প্রশ্ন আসত। আমরা তাঁকে কখনও রাতভর ফতোয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখিনি; পত্র পড়েই তিনি সেগুলোর উত্তর লিখে দিতেন। তিনি ইমাম শাফিঈ ও ইমাম আহমদ (রহ.) এর মাযহাব অনুসারে ফতওয়া দিতেন। যখন তাঁর ফতওয়া ইরাকের আলেমদের কাছে পাঠানো হতো, তারা তাঁর সঠিকতার পাশাপাশি দ্রুততার জন্য বিস্মিত হতেন। যে কেউ যখন কোনো ইসলামী শাস্ত্রে তাঁর সঙ্গে কাজ করতো, এক্ষেত্রে সে পুরোপুরি শায়খের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়তো। ফলে সমসাময়িকদের মধ্যে শাইখের অবস্থা থাকতো নেতৃত্বের আসনে (মিরআতুয যামান ফি তাওয়ারিখিল আইয়ান, সিবত ইবনিল জাওযী, ২১/৯২)

পরহেজগারিতা ও তাকওয়া:

শায়খ আবদুল কাদির জিলানী (রহ.) জীবনভর তাকওয়া ও পরহেজগারিতা অবলম্বন করেছেন। তিনি নিজের বেলায় সর্বদা ‘আযীমত’ অবলম্বন করেছেন। সব সময় প্রচুর নফল ইবাদত করতেন। নিজের ক্ষেত্রে তিনি এগুলোতে এমন গুরুত্ব দিতেন, যেন তা ফরজের মতোই বাধ্যতামূলক।

বিবাহ ও সন্তান-সন্ততি:

শায়খ (রহ.) আঠারো বছর বয়সে বাগদাদে প্রবেশ করেন (বাহজাতুল আসরার: পৃষ্ঠা ১৭১)। তিনি তখন পুরোপুরি জ্ঞান অর্জন ও ইবাদতে মগ্ন ছিলেন। ফলে তার বিয়ে হয় দেরিতে। বয়স প্রায় ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরে তিনি বিয়ে করেন। মূলত তাঁর অধ্যবসায় এবং ইবাদতের প্রতি গভীর নিমগ্নতার কারণে বিবাহ বিলম্বিত হয়। পরবর্তীতে আল্লাহ তাঁকে চার জন স্ত্রী দান করেছিলেন এবং তাঁদের মাধ্যমে তিনি মোট ৪৯ সন্তান লাভ করেন। এর মধ্যে ২৭ জন ছেলে এবং বাকি সবাই মেয়ে। (কলাইদুল জাওয়াহির, পৃষ্ঠা ২৪৬)

ইসলাম বিরোধী শক্তি মোকাবেলায় শাইখের ভূমিকা:

শায়খ আবদুল কাদির জিলানী (রহ.) এর মাদ্রাসা ফিলিস্তিনের অধিকৃত অঞ্চলের সন্তানদের ইলম-আমলে যোগ্য করে তোলার মাধ্যমে এবং তাদেরকে ফিকহ, রাজনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রে প্রস্তুত করার মাধ্যমে ইসলাম বিরোধী শক্তি মোকাবেলায় নতুন এক প্রজন্মকে প্রস্তুত করার মূল ভূমিকা পালন করেছে। শাইখের তত্ত্বাবধানে মাদ্রাসা-ই-কাদিরিয়্যাহর ছাত্ররা কুদসকে মুক্ত করার সংগ্রামে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা ইলমী, রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে কাজ করেছে।

তরীকাহর সনদ:

শাইখ (রহ.) সুফি তরীকার সনদ গ্রহণ করেছিলেন তাঁর শাইখ ও উস্তায আবু সাইদ আল মুবারক আল মাখজুমি থেকে, যিনি এটি গ্রহণ করেছিলেন শাইখ আবুল হাসান আলী আল হাক্কারি থেকে, তিনি গ্রহণ করেছিলেন আবুল ফারাহ মুহাম্মদ ইউসুফ আত তারতুসি থেকে, তিনি গ্রহণ করেছিলেন আবুল ফযল আবদুল ওয়াহিদ আত তামিমি থেকে, তিনি গ্রহণ করেছিলেন আবু বকর আশ শিবলি থেকে, তিনি গ্রহণ করেছিলেন সাইয়িদুত তাইফা আবুল কাসেম আল জুনাইদ আল বাগদাদী থেকে, তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাঁর মামা শাইখ আবুল হাসান আস সিররী আস সাকতি থেকে, তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাঁর শিক্ষক আবু মহফুজ মারুফ আল-কারখি থেকে, তিনি গ্রহণ করেছিলেন ইমাম আবুল হাসান সাইয়িদ আলী আর রিদা থেকে, তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাঁর পিতা আবুল হাসান সাইয়িদ মুসা আল কাযিম থেকে, তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাঁর পিতা সাইয়িদ জাফর আস সাদিক থেকে, তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাঁর পিতা সাইয়িদ মুহাম্মদ আল বাকির থেকে, তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাঁর পিতা সাইয়িদ ইমাম জাইনুল আবিদীন থেকে, তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাঁর পিতা ও রাসূল (সা.) নাতী সাইয়িদুশ শুহাদা আবু আবদিল্লাহ হুসাইন (রা.) থেকে, তিনি গ্রহণ করেছিলেন সাইয়িদুনা ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) থেকে, তিনি গ্রহণ করেছেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে।

কাদিরিয়্যাহ তরিকাহর সুলুকের বৈশিষ্ট্য:

শায়খ (রহ.) প্রথম ব্যক্তি ছিলেন যিনি আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (সা.) এর সুন্নাহর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তরিকতের উপরে সুফীদেরকে সংঘবদ্ধ করেছিলেন। তিনি তাঁর ছেলে আব্দুর রাজ্জাককে ওসিয়ত করার ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে জোর দিয়ে বলেছেন– “আমি তোমাকে খোদাভীতি অবলম্বন করা, তাঁর আনুগত্য করা, শরিয়তের বিধান পালন করা এবং এর সীমানা সংরক্ষণের ব্যাপারে ওসিয়ত করছি। হে আমার ছেলে, আল্লাহ আমাদেরকে, তোমাকে এবং সকল মুসলমানকে তাওফিক দান করুন। জেনে রেখো আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ, পরিচ্ছন্ন হৃদয়, দানশীলতা, দয়াশীলতা, শত্রুতা পরিহার, কষ্টে ধৈর্য ধারণ ও ভাই-বেরাদারদের ক্ষমা প্রদর্শন– এগুলো আমাদের এই তরিকতের ভিত্তি।”(ইতহাফুল আকাবীর ফি সিরাতি ওয়া মানাকিবিল ইমাম মুহিউদ্দীন আব্দিল কাদির, পৃ:২৯৯)

তাঁর কৃতিত্বের খ্যাতি:

শায়খুল ইসলাম ইয্‌যুদ্দীন বিন আবদিস সালাম (রহ.) বলেছেন: “আমাদের কাছে কোনো আলেমের কীর্তিসাধনার খবর এভাবে পৌঁছায়নি যেমন পৌঁছেছে শাইখুল আউলিয়া, শাইখ আবদুল কাদির জিলানী (রহ.) এর কীর্তি। শায়খ আবদুল কাদির ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। শরিয়তের নিয়মাবলীর প্রতি ছিলেন দৃঢ় অনুগত। মানুষকে শরিয়তের দিকে আহ্বান জানাতেন এবং এর বিরোধিতা করাকে বারণ করতেন। তিনি ইবাদত ও মুজাহাদায় ব্যস্ত থেকেও মানুষকে এ দিকে মনোনিবেশ করাতে সচেষ্ট থাকতেন। সন্তান বা স্ত্রীদের মত যারা এ ব্যাপারে অমনোযোগী, তিনি তাদেরও মনোযোগ আকর্ষণের প্রচেষ্টা চালাতেন। আর যার পথচলা এমন হয়, তিনি নিশ্চয়ই অন্যদের চেয়ে পূর্ণাঙ্গ হয়ে থাকেন। আসলে এটা আল্লার রাসূল (সা.) এরও বৈশিষ্ট্য।” (কালাইদুল জাওয়াহির ফি মানাকিবি আব্দিল কাদির জিলানী, পৃ: ১৯৩)

মূল্যবান রচনাসমূহ:

শায়খ (রহ.) অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন বা অনেক কিতাব আছে যেগুলোকে তাঁর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়ে থাকে। এগুলো ফিকহের উসূল ও ফিহহী শাখা-প্রশাখা, আধ্যাত্মিক ও রূহানী অবস্থা ও বাস্তবতা এবং তাসাউফ সম্পর্কিত লেখা। এসবের মধ্যে কিছু গ্রন্থ মুদ্রিত আছে, কিছু পাণ্ডলিপি আকারে রয়েছে আবার কিছু অনুলিপি হিসেবে সংরক্ষিত আছে। তাঁর গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে–

الغُنية لطالبي طريق الحق (من أشهر كتب الشيخ في الآخلاق والآداب)

আল গুনইয়াহ লি তালিবি তরীকিল হক। এটি শায়খের খুব প্রসিদ্ধ বই।

الفتح الرباني والفيض الرحماني (مجالس للشيوخ في الوعظ والإرشاد)

আল ফাতহুর রব্বানী ওয়াল ফাইদুর রহমানী।

 فتوح الغيب-مقالات للشيخ في العقائد والإرشاد

ফুতুহুল গায়ব। এটি আকাঈদ ও দিকনির্দেশনা সংক্রান্ত বিষয়ে শাইখের লেখা প্রবন্ধসংকলন।

 سر الأسرار في التصوف

সিররুল আসরার ফিত তাসাউফ

 الطريق إلى الله

আত তরীক ইলাল্লাহ

 إغاثة العارفين وغاية منى الواصلين

ইগাছাতুল আরেফীন

 آداب السلوك والتوصل

আদাবুস সুলুক ওয়াত তাওয়াস্সুল

                                جلاء الخاطر في الظاهر والباطن

জালাউল খাতির ফিয যাহির ওয়াল বাতিন

 ديوان عبد القادر الجيلاني

দিওয়ানু আবদিল কাদীর আর জিলানী

 الحزب الكبير

আল হিযবুল কাবীর

 دعاء البسملة

দুআউল বাসমালাহ

 

শাইখের ব্যাপারে লিখিত কিছু বই:

بهجة الأسرار ومعدن الأنوار للشيخ نور الدين الشطنوفي

বাহজাতুল আসরার ওয়া মা’দিনুল আনওয়ার, শায়খ নুরুদ্দিন আশশাতনুফী।

قلائد الجواهر للشيخ محمد بن يحي التاذفي الحنبلي

কালাইদুল জাওয়াহের, মুহাম্মদ বিন ইয়াহয়িয়া আল হাম্বলী।

غبطة الناظر في ترجمة عبد القادر الجيلاني لابن حجر العسقلاني

গিবতাতুন নাযির ফি তরযমাতি আবদিল কাদির আল জিলানী, ইবনে হাজার আসকালানী।

 إتحاف الأكابر في مناقب الشيخ عبد القادر

ইতহাফুল আকাবির ফি মানাকিবিশ শাইখ আবদিল কাদির।

 الشيخ عبد القادر الجيلاني للدكتور عبد الرزاق الكيلاني

আশ শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী, আবদুর রাজ্জাক কিলানী‌।

جغرافية الباز الأشهب للشيخ جمال الدين فالح الكيلاني

জুগরাফিয়াতুল বাযিল আশহাব, জামালুদ্দীন ফালিহ আল কিলানী।

ইন্তেকাল ও দাফন:

শাইখ আবদুল কাদির জিলানী (রহ.) রবিউল আখির মাসের ১১ তারিখ, ৫৬১ হিজরিতে ইন্তেকাল করেছেন। এসময় তাঁর বয়স হয়েছিলো নব্বই বছর। তাঁর জানাজায় অসংখ্য মানুষ ও শুভানুধ্যায়ী উপস্তিত হয়েছিলো। শাইখকে তাঁর মাদরাসায় দাফন করা হয়েছে। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী, ১৫/১৮৫) তাঁর কবর বাগদাদে অবস্থিত। এই কবরটি অত্যন্ত সুপরিচিত। জিয়ারতকারীরা শাইখের কবর যিয়ারত করে থাকেন এবং তাঁর কবরের মাধ্যমে বরকত প্রাপ্তির প্রত্যাশা করেন।

এই সুরভিত জীবনচরিত ও প্রোজ্জ্বল চিত্রায়ন এমন এক মুসলিম সুফীর স্বচ্ছ ও দীপ্ত মুখচ্ছবিকে উপস্থাপন করে—যিনি ছিলেন আল্লাহর রাহে দাওয়াতের ক্ষেত্রে এক অনুকরণীয় আদর্শ। আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে দোয়া করি, তিনি যেন তাঁকে তাঁর অগাধ রহমতে আচ্ছাদিত করেন, তাঁকে মাফ করে দেন, মর্যাদা উন্নীত করেন এবং তাঁর বরকতে আমাদের সকলের গুনাহ মাফ করে দেন। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ ﷺ, তাঁর পরিবার, সাহাবা ও তাঁর উম্মতের আওলিয়াদের উপর সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক। সমগ্র প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার।

[ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত, জামীলুর রহমান অনূদিত এবং সায়ীদ হোসাইন চৌধুরী সম্পাদিত]

শেয়ার করুন:
  • জনপ্রিয়
  • সাম্প্রতিক

নির্বাচিত

Don`t copy text!