যুহুরে নবুওয়াতপূর্ব তাঁর জীবনও আমাদের জন্য অনুসরণীয়

-মাওলানা জ. উ. ম. আব্দুল মুনঈম

সৃষ্টিকুলের সেরা জীব মানব জাতির বিস্তৃতির পাশাপাশি তাদের সুসভ্য জীবন যাপন, সর্বোপরি আল্লাহর বান্দাহ হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের নাজাতের পথ নির্দেশক হিসেবে আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। যারা ছিলেন সমকালীন সম্ভ্রান্ত বংশীয়, পরিপূর্ণ মানবিক গুণে গুণান্বিত, উন্নতর চারিত্রিক গুণে ভূষিত, সামগ্রিক কদর্যতা মুক্ত। তারা শৈশবকাল থেকেই এমন পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করেছেন যে তাঁদের অর্জিত স্বভাব চরিত্রই সর্বমহলে তাদেরকে শ্রদ্ধার পাত্র, প্রিয় এবং অনুসরণীয় করেছিল। আল্লাহ তাআলা কুদরতী বিশেষ তত্ত্বাবধানে তাঁদেরকে পরিচালিত করেছেন। শ্রেষ্ঠ নবী, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। যার মাধ্যমে মানব চরিত্রের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। নবীজী নিজেই ঘোষণা করেছেন-
بعثت لاتمم مكارم الاخلاق
‘আমি পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছি, উন্নত চরিত্রের পূর্ণতাকারী হিসেবে।’
হযরত মুহাম্মদ (সা.) মানবরূপে পৃথিবীতে শুভাগমনের পর তেষট্টি বছরের সময় দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। তেইশ বছর নবুওয়াতীর দায়িত্ব পালন করেন। এর পূর্বে থাকল দুনিয়ার জীবনের চল্লিশটি বছর। প্রশ্ন হলো- এ চল্লিশ বছরের জীবন অনুসরণীয় নাকি শুধু মাত্র চল্লিশ থেকে তেষট্টি বছর পর্যন্ত তেইশ বছরের জীবনই অনুসরণীয়। অনেক জ্ঞান-পাপী অবলীলায় বলে বেড়াচ্ছে- নবীর চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত জীবনের অনুসরণ অপ্রয়োজনীয়। এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই আমাদের নিবন্ধ। প্রমাণাদি ঘাটা-ঘাটি করে আমরা জানার চেষ্টা করব জ্ঞান-পাপীদের কথাই ঠিক না কি চল্লিশ বছর পর্যন্ত এ জীবনও অনুসরণীয়।

কুরআন মজীদে নবীজীর চরিত্র মূল্যায়ন
আল্লাহ তাআলা নবী করীম (সা.) এর উন্নত স্বভাব-চরিত্রের স্বীকৃতি দিয়ে বলেন- وانك لعلي خلق عظيم আপনি অবশ্যই উন্নতর চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত।২
এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর চরিত্রকে উন্নত বলা হয়েছে। এখন জানতে হবে চরিত্র কী? চরিত্র হলো মানুষের অভ্যন্তরীণ এমন শক্তি যার মাধ্যমে অনায়াসে কোন কাজ প্রকাশিত হয়। এ শক্তি থাকার জন্য চল্লিশ বছর পূর্ণ হওয়া বা নবুওয়াত প্রকাশিত হওয়া শর্ত নয় বরং প্রত্যেক মানুষই পৃথিবীতে আগমনের সাথে সাথে তা নিয়েই আসে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা বিকশিত হয়। সুতরাং নবীজীর উন্নত চরিত্র নবুওয়াত প্রকাশিত হওয়ার পর তৈরী হয়নি বরং গোটা জীবনেই তিনি উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। অতএব, তার প্রথম চল্লিশ বছরের জীবন অনুসরণীয় নয় বলা চরম অজ্ঞতা ও বেয়াদবী ছাড়া আর কিছু নয়।

নবী হয়েই তিনি এ ধরায় এসেছেন
সাহাবায়ে কিরাম নবীজীকে প্রশ্ন করেন-
يا ر سو ل لله متى وجبت لك النبوة قال وادم بين الروح والجسد-
-ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! আপনি কখন থেকে নবী? নবীজী ফরমালেন: আদম (আ.) যখন রূহ এবং দেহের মাঝে অবস্থান করছিলেন তখনও আমি নবী ছিলাম।৩ অর্থাৎ যখন আদম (আ.) এর কায়া বানানো হয়েছে কিন্তু রূহ ফুকা হয়নি তখনও আমি নবী ছিলেন। এ হাদীস শরীফ থেকে বুঝা গেল যদিও নবীজী আদম (আ.) এর বংশ পরম্পরায় পৃথিবীতে এসেছেন কিন্তু এর আগেও তিনি অস্তিত্বশীল ছিলেন এবং তিনি নবী-ই ছিলেন। যার মৌলিক সত্তা নবুওয়াতের গুণযুক্ত অবস্থায় পৃথিবীতে এসেছেন তার স্বভাব-চরিত্র আল্লাহর সংরক্ষণাধীন ছিল বিধায় কোন কদর্যতা, দুর্বলতার সংমিশ্রণ অসম্ভব। দুনিয়ার জীবনের ৬৩ বছর-ই নবুওয়াতের গুণে গুণান্বিত ছিল। তাই তাঁর সম্পূর্ণ জীবনই অনুসরণীয় ছিল।

তিনি ছিলেন শয়তানের প্রভাবমুক্ত
মানুষকে অন্যায়, পাপাচার ইত্যাদি খারাপ চরিত্রের দিকে ধাবিত করে শয়তান। অথচ নবী করীম (সা.) পৃথিবীতে আগমনের সাথে সাথে তাঁর সাথী থাকার মাধ্যমে ওয়াস ওয়াসা দিতে যে শয়তান জন্মেছিল সে মুসলমান হয়ে গিয়েছিল অথবা তার কুমন্ত্রণা দেয়ার ক্ষমতা লুপ্ত করে দেয়া হয়েছিল। সুতরাং তার গোটা জীবনের স্বভাব-চরিত্র শয়তানের প্রভাব মুক্ত ছিল। শয়তানের প্রভাবমুক্ত যে চরিত্র তা অনুসরণীয় হবে না কেন?
অনুসরণীয় হওয়ার জন্য উত্তম হওয়া আবশ্যক। আর উত্তম থেকে অধমে অবনমিত করে শয়তান, কিন্ত নবী করীম (সা.) আজীবন শয়তানের প্রভাবমুক্ত ছিলেন। নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেনঃ
“ما منكم من احد الا ومعه شيطان قالوا: ولا انت يا رسول الله قال: ولا انا ولكن الله اعاننى فاسلم”
“তোমাদের সাথে এমন কেউ নেই যার সাথে শয়তান নেই। সাহাবায়ে কিরাম বললেন আপনিও কি শয়তান মুক্ত নন? নবীজী ইরশাদ করলেন না, আমিও না। তবে আল্লাহ তাআলা আমাকে সাহায্য করেছেন। আমার সাথের শয়তান মুসলমান হয়ে গিয়েছে”।৪
শয়তান মুসলমান হয়ে যাওয়া মানে কুমন্ত্রণা দেয়ার দোষমুক্ত হওয়া। অথবা কুমন্ত্রনা দেয়ার অপশক্তি লোপ পাওয়ার কারণে আত্মসমর্পন করা। তাই নবীজীর জীবনের কোন অংশকে-ই এমন কোন দোষ স্পর্শ করতে পারে না যা অনুসরণীয় হওয়ার জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।

নবীজীর শৈশব, কৈশোর ও যৌবনকালের মূল্যায়ন
শৈশব থেকে নবীজী (সা.) আবূ তালিবের তত্ত্বাবধানে সযতেœ লালিত পালিত হন। আবূ তালিব তাঁর প্রিয় ভাতিজার শৈশব, কৈশোর যৌবনকালের ব্যক্তি চরিত্র পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন অনেক কাছে থেকেই। নবীজীর কলুষমুক্ত উন্নততর আচরণ-স্বভাব দেখে মুগ্ধ হয়ে কাব্যিক রূপে তার প্রশংসা করেন এভাবে-
وشق له من اسمه ليجله : فذو العرش محمود وهذا محمد-
-আরশের মালিক (আল্লাহ তাআলা) তাকে মহিমান্বিত করার জন্যই নিজ নাম থেকেই তার নাম উৎসারিত করেছেন। সুতরাং তিনি (আল্লাহ) হলেন মাহমুদ (প্রশংসিত) এবং ইনি হচ্ছেন মুহাম্মদ (বহুল প্রশংসিত)।৫
হযরত হাসসান বিন সাবিত (রা.) থেকে এ শ্লোকটি পাওয়া যায়। ইতিহাসবিদদের মতে মূলত: আবূ তালিবের কবিতা থেকেই তিনি উদ্বৃতি দিয়েছেন।
সমাজ হিতৈষী ও জনকল্যাণমূলক মানসিকতার অধিকারী ভাতিজা মুহাম্মদ (সা.) এর চারিত্রিক গুণাবলী আবূ তালিব নবুওয়াত প্রকাশিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই অবলোকন করেছিলেন। তিনি এতে মুগ্ধ হয়ে একটি পংক্তিতে প্রশংসা করেন এভাবে-
وابيض وجه يستسقي الغمام بوجهه – ثمال اليتمى عصمة للارامل
-উজ্জ্বল চেহারার অধিকারী যার ওসীলা নিয়ে বৃষ্টি কামনা করা হয়। (তিনি)-এতীমদের সযতœ লালনকারী, বিধবাদের সম্ভ্রম নিরাপদকারী।”৬
এমন চমৎকার স্বভাবধারীর আদর্শ অনুসরণ করা যাবে না তো কার অনুসরণ করতে হবে?
ইসলাম ধর্ম প্রবর্তিত হওয়ার আগে মক্কার সম্ভ্রান্ত বংশীয়, বিদূষী, ধনাঢ্য মহিলা খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ মক্কার খ্যাতিমান যুবক মুহাম্মদ ইবনু আব্দুল্লাহ (সা.) এর প্রশংসা শুনে তাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে উন্নত স্বভাব, চরিত্র, আমানতদারী সহ সার্বিক পূর্ণাঙ্গ মানবীয় গুণ দেখেই বিশাল ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব তার হাতে তুলে দেন এবং শেষ পর্যন্ত জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য নিজেই আকাক্সিক্ষত হন এবং জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েও যান।
নবীর প্রতি প্রথম ওহী নাযিল হলো। রাসূলুল্লাহ (সা.) ওহী প্রাপ্ত হয়ে প্রকম্পিত অবস্থায় খাদীজা (রা.) এর ঘরে আসলেন। তাঁর পেরেশানী দেখে খাদীজা (রা.) অভয় বাণী শুনাতে গিয়ে নবীজীর ভালো গুণগুলো যা ইতোপূর্বে অবলোকন করেছেন, তা উল্লেখ করে বললেন-
كلا والله ما يخزيك الله ابدا- انك لتصل الرحم، وتحمل الكل- وتكسب المعدوم، وتقرئ الضيف وتعين على نوائب الحق”
-আল্লাহর কসম! কখনো না, আল্লাহ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, রোযগারহীন ব্যক্তির রুযির ব্যবস্থা করে দেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং দুর্দশাগ্রস্থকে সাহায্য করেন।”৭
খাদীজা (রা.) যে গুণগুলোর উল্লেখ করলেন তা বিকশিত ছিল দয়াল নবীর নবুওয়াত প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেকার জীবনে। সেই মহৎ জীবনের অনুসরণ করতে অসুবিধা কোথায়?
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নবুওয়াতের কথা পৃথিবীর নানা দেশে পৌঁছে গিয়েছিল। সম্রাট হিরাক্লিয়াস আসমানী কিতাবের মাধ্যমে জেনেছেন যে, শেষ নবী আরবের মক্কায় আবির্ভূত হবেন। এখন মক্কায় যে নবীর কথা শুনা যাচ্ছে তিনি কি সেই নবী এটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য কৌতুহলী হলেন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ফেলে রেখে মক্কায় গিয়ে নবীকে পর্যবেক্ষণ করে সত্যাসত্য নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। তাই অপেক্ষমান ছিলেন-মক্কাবাসী কোন ব্যক্তি বা দল যদি পাওয়া যায়। তার কাছে জেনি নিবেন একদিন তাদের দেখা তিনি পেয়ে গেলেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পূর্বে আবূ সুফিয়ান ব্যবসায়ী কাফেলা নিয়ে যখন সম্রাটের দেশে পৌঁছলেন তখন খবর পেয়ে সম্রাট তাকে রাজ দরবারে দাওয়াত করলেন। দু’ভাষীর মাধ্যমে মক্কায় আবির্ভূত নবী সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করেন এবং আবূ সুফিয়ানের কাছ থেকে জবাব শুনে নেন। আম্বিয়ায়ে কিরামের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য কী হয়ে থাকে এ ব্যাপারে সম্রাটের জানা ছিল। এ আঙ্গিকে তিনি কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলেন। এর মধ্যে নবীজীর নবুওয়াত প্রকাশিত হওয়ার পূর্ববর্তী জীবনের ব্যক্তিচরিত্র সম্পর্কিত প্রশ্নও ছিল। সম্রাট জানতে চান-
“فهل كنتم تتهمونه بالكذب قبل ان يقول ما قال؟ قلت: لا- قال- فهل يغدر؟ قلت: لا”
-নবুওয়াত দাবী করার আগে তাঁকে কি মিথ্যাবাদী হওয়ার অপবাদ তোমরা দিতে? (আবূ সুফিয়ান বলেন) আমি বললাম- না। স¤্রাট বললেন: তিনি কি ধোঁকাবাজী করতেন? (আবূ সুফিয়ান বলেন) আমি বললাম: না।৮
এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, নবুওয়াত প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেও রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ব্যক্তি চরিত্র ছিল নিষ্কলুষ, যা অনুসরণীয় ছিল বলে মেনে নিতে কোন আপত্তির সুযোগ নেই।

নবী করীম (সা.) এর জীবন জাহিলিয়াতের সকল কুসংস্কার মুক্ত
আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবীবকে সকল কদর্যতা থেকে পবিত্র রেখেছেন। সুতরাং আজীবন তিনি প্রশংসিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। বাল্যকালে যে বয়সী ছেলেরা লজ্জাস্থান উন্মোচিত করা স্বাভাবিক ছিল, সে বয়সেও নবীজীকে তা থেকে আল্লাহ তাআলা হিফাযত করেছেন।
হযরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজীর বাল্যকালে যখন কুরাইশরা কা’বা শরীফ পুন:নির্মাণ করেন তখন নবীজীও পাথর বহনের কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন। হযরত আব্বাস (রা.) এর কথায় যখন তিনি ‘ইযার’ (শরীরের কোমর থেকে নীচের দিক ঢেকে রাখার জন্য পরিধেয় বস্ত্র) খুলে ঘাড়ের উপর ভাঁজ করে রেখে তার উপর পাথর বহন করার উদ্যোগ নিলেন, সাথে সাথে বেহুশ হয়ে পড়ে গেলেন। তাঁর দৃষ্টি উর্ধ্বমূখী করে ‘আমার ইযার’ ‘আমার ইযার’ বলে চিৎকার শুরু করলে সাথে সাথে তাঁকে ইযার পরিয়ে দেয়া হলো।৯
এ ঘটনাটি হযরত আবূ তুফায়ল (রা.) থেকে এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে যে, নবীজীর বাল্যবয়সে কা’বা শরীফ নির্মাণ কাজে অংশ গ্রহণকালে যখন তার সতর উন্মুক্ত হয়ে গেল, তিনি বেহুশ হয়ে পড়ে গেলেন। হুশ ফিরে আসার পর আবূ তালিব প্রশ্ন করলেন, কী হয়েছে? জবাবে নবীজী বললেন, সাদা পোষাকধারী একজন দেখলাম আমার কাছে এসে বললেন-“মুহাম্মদ! সতর ঢাকা”। ঐশী এ আহব্বান ছিল তাঁর নবুওয়াতের প্রাথমিক আলামত। অথচ তিনি বালক ছিলেন।১০
নবীজীর যৌবনকালও জাহিলিয়াতের কলুষতা থেকে পবিত্র ছিল। হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি মারফু সূত্রে বর্ণনা করেন যে, একদিন যুবক নবী মুহাম্মদ (সা.) ছাগল চরানোর সময় তাঁর সাথী এক যুবককে তাঁর ছাগলের দিকে খেয়াল রাখার কথা বলে পার্শ্ববর্তী একটি বাড়িতে জাহিলিয়াতের নিয়মে নাচগান সমৃদ্ধ অনুষ্ঠান দেখতে গেলেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। সারারাত ঘুমন্ত অবস্থায় থাকার পর পরদিন সকালের সূর্যের আলো গায়ে লেগে তার ঘুম ভাঙ্গলো। রাতের নাচ-গান কিছুই তিনি দেখতে পেলেন না। পরদিন আবার গেলেন ঐ দিনও সেখানে পৌঁছা মাত্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলেন। নাচ গান কিছু দেখতে পেলেন না। এরপর আর কোন দিন তিনি নাচ গানের এমন অনুষ্ঠানে যাননি।১১
ইমামুল হাদীস ইবনু হাজার আসকালানী (র.) বলেন, হাদীসটির সনদ মুত্তাসিল এবং সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য।
হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজীকে প্রশ্ন করা হলো- আপনি কি (নবুওয়াত প্রকাশের আগে) কোনদিন মূর্তিপূজা করেছেন? জবাবে নবীজী বললেন-না। তাঁকে প্রশ্ন করা হলো- মদ পান করেছেন? জবাবে নবীজীর বললেন- না, কোন দিন মদপান করিনি। আমার প্রতি ওহী তখনও নাযিল হয়নি কিন্তু আমি ভালো করে বুঝতাম কুরাইশরা কুফুরীতে নিমজ্জিত।১২
হযরত উম্মে আয়মান (রা.) বর্ণনা করেন- নবুওয়াত প্রকাশিত হওয়ার আগে হুযূর (সা.) চাচা আবূ তালিবের লালনাধীন থাকা অবস্থায় কুরাইশদের প্রথা অনুসারে বার্ষিক পূজা অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য তাকে বলা হলে তিনি সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানালেন। কুরাইশরা তার ব্যাপারে আবূ তালিবের কাছে নালিশ করলে তিনি নবীর উপর রাগান্বিত হয়ে মূর্তি পূজার ঐ অনুষ্ঠানে যেতে বাধ্য করলেন। নবীজী অনিচ্ছা সত্তে¡ও তাদের সাথে গেলেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর আল্লাহর ইচ্ছায় মূর্তি পূজারীদের কাছ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। পরে ভীত সন্ত্রস্থ অবস্থায় তাদের কাছে ফিরে আসলে ফুফুরা বললেন- তোমার মতো এতো ভালো গুণের অধিকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা শয়তানের প্রভাবিত মুসীবতে ফেলবেন না। তুমি কী দেখেছ? নবীজী বললেন, আমি যখন মুর্তির কাছে গিয়েছি সাথে সাথে সাদা পোষাকধারী দীর্ঘকায় একজন লোক চিৎকার করে আমাকে বলেন- মুহাম্মদ মূর্তি স্পর্শ করো না। এরপর থেকে কোন দিন তিনি তাদের সাথে মূর্তি পূজার অনুষ্ঠানে যাননি।১৩
জাহিলিয়াতের যুগেও নবীজীর জীবন নেক আমলের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। হযরত রাবীআ আল জারশী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জাহেলি যুগেও আমি নবীজীকে আরাফার ময়দানে উকুফ করতে দেখেছি। পরে আমি বুঝতে পারলাম আল্লাহ তাকে এ ভালো আমলের তাওফীক দিয়েছেন।১৪
বাল্যকালে সদগুণাবলীর কারণে সমাজের সর্বত্র বিশ্বস্ততা ও নির্ভরযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। ইবনু শিহাব থেকে বর্ণিত, কা’বা ঘর পুনঃনির্মাণের পর হাজরে আসওয়াদ পুনঃস্থাপন নিয়ে বিবাদ দেখা দিল। পরে এর মীমাংসার জন্য সকলে ঐকমত্যে পৌঁছল আগামীকাল কা’বার দিকে বাইরে থেকে প্রথমে যে আগন্তুক আসবেন তিনিই এর মীমাংসা করে দেবেন। এরপর অপেক্ষা চললো। অবশেষে তারা দেখল বাহির থেকে প্রথম যিনি আসছেন তিনি হচ্ছেন সকলের আস্থাভাজন মুহাম্মদ ইবনু আব্দিল্লাহ (সা.)। তাঁকে দেখে তারা ভীষণ খুশী এ জন্য যে, মুহাম্মদের মতো ভালো মানুষ সঠিক মীমাংসা দিতে পারবেন। নবীজীকে তাদের বিবাদ ও মীমাংসার কথা জানালে তিনি একখানা চাদর বিছিয়ে তার উপর পাথর রাখতে বললেন। চাদরের উপর হাজারে আসওয়াদ রাখা হলো। নবীজী প্রত্যেক গোত্রের মুরব্বীদেরকে চাদরের কিনারা ধরে উঠাতে বললেন। তারা তা করল। রাসূল (সা.) নিজ হাত মুবারকে পাথর উঠিয়ে যথাস্থানে স্থাপন করলেন। ইনসাফ ভিত্তিক, প্রজ্ঞাপূর্ণ ফয়সালা দেখে তারা ভীষণ খুশী হলো।
নবীজী কুরায়শদের কাছে ‘আল আমীন’ খেতাবে প্রসিদ্ধি লাভ করছিলেন। নবুওয়াত প্রকাশিত হওয়ার আগে তাদের কাছে এত সম্মানের আসন লাভ করেছিলেন যে কোন পশু জবাই করলে কুরাইশরা অবশ্যই নবীজীকে দাওয়াত করত এবং তিনি তাদের জন্য কল্যাণের দুআ করতেন।১৫
দাঊদ ইবনু হুসাইন থেকে বর্ণিত, নবীজী কুরাইশদের মাঝে ছোট থেকে বড় হলেন গোত্রের মধ্যে উত্তম বিবেক সম্পন্ন, সুন্দরতম চরিত্রের অধিকারী, সম্মানিত সঙ্গী, উত্তম প্রতিবেশী, আমানতদার ও সত্যবাদী হিসেবে। তিনি ছিলেন অশালীনতা ও যন্ত্রণা মুক্ত। তাঁর মধ্যে বাদ-বিসংবাদ ইত্যাদি না থাকার কারণে তাকে সম্প্রদায়ের লোকেরা ‘আল-আমীন’ বলে ডাকত।১৬
আল্লাহ তাআলার নির্দেশনা ইহ-পরকালীন কল্যাণের পথে জীবন পরিচালনার জন্য আল্লাহ তাআলা তার বিধি-নিষেধ বান্দার প্রতি আরোপ করেন যা শরীআতের বিধান হিসেবে খ্যাত। এ বিধান মেনে চলার ব্যাপারে জবাবদিহিতা অবশ্যই আছে। আপন কর্ম দিয়ে মানুষ তার রবকে খুশি রেখে যেন চলতে পারে এ জন্য আল্লাহ তাআলা নির্দেশনা দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে- لقد كان لكم في رسول الله اسوة حسنة “রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ”।১৭
কাদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তাআলা এ নির্দেশনা প্রদান করেছেন যদি এ প্রশ্ন করা হয় তাহলে সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো শরীআতের মুকাল্লাফ তথা নাবালক-নাবালিকা ছাড়া সকল বয়সের মানুষের উদ্দেশ্যে এ নির্দেশনা দিয়েছেন।
যদি নবুওয়াত প্রকাশের পরবর্তী সময় তথা চল্লিশ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য এ নির্দেশনা হতো তাহলে শরীআতের মুকাল্লাফ চল্লিশের কম বয়সী মানুষ কার আদর্শ অনুসরণ করবে? আর কারো আদর্শের অনুসরণ ছাড়াই যদি চলা যায় তাহলে জবাবদিহিতা আসলো কোত্থেকে?
যার জীবনের প্রতিটি পর্বের বিশুদ্ধতার প্রমাণ তার কর্মের মধ্যেই বিদ্যমান তিনি তো সকলের অনুসরণীয় হবেন।
সুতরাং নবুওয়াত প্রকাশিত হওয়ার পরের জীবন যেমনি আমাদের জন্য অনুসরণীয় তেমনি আগের চল্লিশ বছরের জীবনও আমাদের জন্য অনুসরণীয়।

তথ্যসূত্র
১. বুখারী শরীফ
২. আল-কুরআন, সূরা নূন
৩. তিরমিযী
৪. তাফসীরে নিশাপুরী
৫. বুখারী, আত্তারীখুছ সগীর
৬.ইব্নু হিশাম, ইব্নু কাছীর, হালাবী
৭. বুখারী
৮. বুখারী
৯. বুখারী, মুসলিম
১০. ইবনু সাদ, ইবনু আদী, হাকিম, আবূ নুআইম
১১. বায়হাকী, বায্যার, আবূ নুআইম, ইবনু আসাকির, ইবনু ইসহাক
১২. আবু নুয়াইম, ইবনু আসাকির
১৩. ইবনু সাদ, ইবনু আসাকির, আবু নুয়াইম
১৪. মুসনাদে হাসান, মু’জামে বাগাভী
১৫. ইয়াকুব বিন সুফিয়ান, বায়হাকী
১৬. ইবনু সাদ, ইবনু আসাকির
১৭. সূরা-আহযাব।

[লেখক: অধ্যক্ষ, জালালিয়া সিনিয়র মাদরাসা, জালালপুর, সিলেট

সুবহে সাদিক ২০১৬ থেকে সংগৃহীত]

শেয়ার করুন:
  • জনপ্রিয়
  • সাম্প্রতিক

নির্বাচিত

Don`t copy text!