রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্ম ও বংশ মর্যাদা আলোচনা


মুফতী মাওলানা মোঃ গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী

নবীগণকে খাটো করে দেখা, তাঁদের সম্মানকে হেয় দৃষ্টিতে দেখা কাফির-মুশরিকদের স্বভাব ছিল, যার অনেক প্রমাণ কুরআন কারীমে আছে। কুরআনে কারীমের যে আয়াতেই নবীগণকে কোন বৈশিষ্ট্য ছাড়া কেবল বাশার (মানুষ) বলা হয়েছে, দেখা যায় সেটি মূলত কাফিরদের উক্তি ছিল, যা আল্লাহ তাআলা উদ্ধৃতি হিসাবে কুরআন কারীমে বর্ণনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত কয়েকটি আয়াত নিম্নে পেশ করা হল-
(১) قَالُوا مَا أَنتُمْ إِلاَّ بَشَرٌ مِّثْلُنَا -তারা বলল তোমরাতো আমাদের মতো মানুষ। (সূরা ইয়াছিন), (২) مَا نَرَاكَ إِلاَّ بَشَرًا مِّثْلَنَا -আমরা তোমাদেরকে আমাদের মতো মানুষ মনে করছি। (সূরা হুদ), (৩) هَلْ هَذَا إِلاَّ بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ -সে তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ। (সূরা আম্বিয়া), (৪) مَا هَذَا إِلاَّ بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ সে তোমাদের মতো মানুষ ছাড়া কিছুই নয়। (সূরা মু’মিনুন),
খারিজী ও ওয়াহাবীরা অনেক ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে তাঁর সম্মান ও মর্যাদার সাথে সম্পর্কিত অনেক বিষয়কে কাঁট ছাট করে অথবা বাদ দিয়ে দেয়। বিশেষ করে নবুওয়াত প্রকাশের পূর্ববর্তী জীবনের প্রকাশিত অলৌকিক ঘটনা, শান, মান, ও মর্যাদা, তাঁর জন্মকালীন অলৌকিক বিষয় আলোচনা যেমন নিজেরা করে না তেমনি অন্যরা করলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। মীলাদুন্নবী মাহফিল রাসূল (সা.) এর শান মান আলোচনার মাহফিলকে বিদআত বলে। খারিজী ও ওয়াহাবীদের দ্বারা প্রভাবিত কিছু তথাকথিত আলিমও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মকালীন ঘটনা ও তাঁর বংশ মর্যাদার আলোচনার ফয়েয থেকে মুমিনদেরকে দূরে রাখার কৌশল হিসাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনের এমন একটি অংশকে বাদ দেয়ার যড়যন্ত্র করে যা হাদীস, ইতিহাস ও তাফসীরের কিতাবসমূহে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা তাঁর পবিত্র শানে বেয়াদবীমূলক ও অবাস্তব কথা বলে থাকে। এমনকি তারা তাদের বেআদবীর চূড়ান্ত রূপ হিসাবে এ কথাও বলে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নবুওয়াত প্রকাশের পূর্ববর্তী জীবন তথা তাঁর জন্ম থেকে চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত জীবনের কোন গুরুত্ব নেই (নাউযুবিল্লাহ)। অথচ বাস্তব কথা হলো নবুওয়াত প্রকাশের পূর্বেকার ঘটনাবলী রাসূল (সা.)-এর নবুওয়াতের সত্যতার সাক্ষী বহন করে। এসব ঘটনাগুলিকে ইরহাসাত, দালাইলুন নবুওয়াত বলা হয়। সে জন্যে মুহাদ্দিসীনে কিরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নবুওয়াতের ভিত্তিকে মযবুত দলীল দ্বারা সাব্যস্থ করার জন্য সেগুলো বর্ণনা করেছেন। এমনকি হাদীসের ইমামগণ সে সকল বিষয় নিয়ে স্বতন্ত্র কিতাবাদিও রচনা করেছেন। তাছাড়া মুহাদ্দিসীনে কিরাম তাদের নিজ কিতাবে অত্যন্ত গুরুত্বের সহিত মানাকিব (ফযীলত) অধ্যায়ে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মকালীন ঘটনা ও তাঁর বংশ মর্যাদা আলোচনা করেছেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মীলাদ ও মর্যাদা বর্ণনার অধ্যায়- মানাকিব
হাদীসের যে কিতাবে সিয়ার, আদাব, তাফসীর, আকাঈদ, ফিতান, আশরাত, আহকাম ও মানাকিব-এই আটটি বিষয় সম্পর্কিত হাদীস আছে তাকে জামে (جامع) বলা হয়। এ ৮টি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে দেয়া হল।
১. সিয়ার: শব্দটি সীরাত শব্দের বহুবচন। হাদীসের কিতাবাদীতে এটি এমন এক অধ্যায়, যেখানে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র জীবনের ঘটনাবলী সম্পর্কিত হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সিয়ার সম্পর্কে শরহে মুআত্তা গ্রন্থাকার বলেন-
السير جمع سيرة بمعني طريقة واصله جالة السير- الا انما غلبت في لسان اهل الشرع علي المغازي- (شرح الموطا)
অর্থাৎ সিয়ার শব্দটি সীরাতুন শব্দের বহুবচন। অর্থ রাস্তা। মূলত তা পথ চলার অবস্থাকে বুঝায়। তবে উলামায়ে কিরামের নিকট এটি যুদ্ধ বিগ্রহ অর্থে প্রাধান্য পেয়েছে।
আল-আরফুশ শাযী গ্রন্থকার বলেন-
يذكر في أبواب السير ما نقل عنه في الجهاد والغزوات-
অর্থাৎ সিয়ারের অধ্যায়সমূহে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত জিহাদ ও যুদ্ধ বিগ্রহসমূহের আলোচনা করা হয় । (আল-আরফুশ শাযী)
২. আদব: আদব অর্থ শিষ্টাচার। এখানে শিষ্টাচার বলতে সামাজিক শিষ্টাচার, যেমন খাওয়া, পান করা ইত্যাদির আদব উদ্দেশ্য।
৩. তাফসীর: তাফসীর বলতে কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াতের তাফসীর সংক্রান্ত হাদীসসমূহ উদ্দেশ্য।
৪. আকাইদ: আকাঈদ শব্দটি আকীদাতুন শব্দের বহুবচন। এখানে আকাঈদ বলতে আকীদাহ সংক্রান্ত হাদীসসমূহ উদ্দেশ্য।
৫. ফিতান: ফিতান শব্দটি ফিতনাতুন শব্দের বহুবচন। এখানে ফিতান বলতে বড় বড় ঘটনা সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কিত হাদীসসমূহ উদ্দেশ্য।
৬. আশরাত: আশরাত বলতে কিয়ামতের আলামত সম্পর্কিত হাদীসসমূহ উদ্দেশ্য।
৭. আহকাম: আহকাম বলতে ইসলামের বিধি-বিধান সস্পর্কিত হাদীসসমূহ উদ্দেশ্য।
৮. মানাকিব: মানাকিব বলতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আম্বিয়ায়ে কিরাম, সাহাবী, তাবিঈ ও বিভিন্ন গোত্রের মর্যাদা সম্পর্কিত হাদীসসমূহ উদ্দেশ্য।
এ থেকে বুঝা যায় মুহাদ্দিসীনে কিরামের দৃষ্টিতে সীরাত (সিয়ার) ও মানাকিব দুটি পৃথক বিষয়। সীরাত অধ্যায়ে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র জীবনের ঘটনাবলী সম্পর্কিত হাদীস বর্ণিত হয় এবং মানাকিব অধ্যায়ে তাঁর মর্যাদা সম্পর্কিত বিষয়ের পাশাপাশি জন্ম ও বংশ মর্যাদা সম্পর্কিত হাদীস বর্ণিত হয়। অবশ্য প্রাসঙ্গিকভাবে সীরাত অধ্যায়ে মানাকিব সংক্রান্ত হাদীস এবং মানাকিব অধ্যায়ে সীরাত সংক্রান্ত হাদীসও আসতে পারে। অনুরূপ আদব, তাফসীর ও আকাইদ বিষয়ক আলোচনায় প্রাসঙ্গিকভাবে অন্যান্য বিষয়ের বর্ণনা আসতে পারে। তবে হাদীসের কিতাবাদী অধ্যয়ন করলে দেখা যায় মুহাদ্দিসীনে কিরাম রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম ও বংশ মর্যাদা সম্পর্কিত হাদীসসমূহ সাধারণত মানাকিব অধ্যায়েই উল্লেখ করেছেন।

মানাকিব আলোচনা রাসূল বিদ্বেষীদের মনোকষ্টের কারণ
মানাকিব এর পরিচয় প্রদানে মোল্লা আলী কারী (র.) লিখেছেন-
المناقب جمع المنقبة وهي الشرف والفضيلة
অর্থাৎ মানাকিব শব্দটি মানকাবাতুন এর বহুবচন। এর অর্থ হলো উচ্চ মর্যাদা ও উন্নত বৈশিষ্ট্য। (মিরকাত, খÐ: ১১, পৃষ্ঠা: ১৩১)
মানাকিব এর আরেকটি অর্থ হল ছিদ্র করা। এ হিসেবে মানাকিব হলো এমন মর্যাদা যার দ্বারা হিংসুকের অন্তর ছিদ্র করে দেয়া হয়। আল্লামা কাসতালানী (র.) লিখেছেন:
وقال التبريزي المناقب المكارم- واحدها منقبة كانها تنقب الصخر من عظمها وتنقب قلوب الحسود . (حاشية البخاري)
অর্থাৎ ইমাম তিবরিযী বলেন, মানাকিব অর্থ হলো উন্নত মর্যাদা, যার একবচন হলো ‘মানকাবাতুন’। মানাকিবকে এজন্য মানাকিব বলা হয় যেন, এটি বড় পাথরকে ছিদ্র করে এবং হিংসুকদের অন্তরকে ছিদ্র করে। (ইরশাদুস সারী, ১ম খন্ড , পৃষ্ঠা ৪৯৬)
বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘কাশফুল বারী’ এর লেখক জনাব মুহাম্মদ ইদরীস কাসিমী ‘মানাকিব’ এর পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন: ‘মানাকিব’ গুণকীর্তন এবং প্রখর গৌরবকে বলে। কারণ এটি বর্ণনার দ্বারা হিংসুক ও দুশমনদের অন্তরকে ছিদ্র করে দেওয়া হয়। (কাশফুল বারী (বঙ্গানুবাদ), খন্ড ১৪, পৃষ্ঠা: ২১)
কাসিমী সাহেবের বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হলো- মানাকিবকে এজন্য মানাকিব বলা হয় যা আলোচনা করলে হিংসুক ও দুশমনদের দিল ছিদ্র হয়ে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গৌরবময় জন্ম বৃত্তান্ত মানাকিবের অর্ন্তভুক্ত। যদি কোন নামধারী আলিম তা অপছন্দ করেন তবে তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি হিংসা পোষণকারী বলা যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনার মাহফিল করে তাদের কলিজা ছেদ করে দেয়া উচিৎ।

বক্তব্যের মাধ্যমে রাসূলে পাক (সা.) এর মানাকিব বা মর্যাদা আলোচনা
কাফিরগন যখন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করত, তখন সাহাবায়ে কিরাম নানাভাবে এর জবাব দিতেন। কোন কোন সময় বক্তব্যের মাধ্যমে জবাব দিতেন। হযরত হাসসান (রা.) মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসা করতেন। যেমন- হাদীস শরীফে আছে-
عن عائشة قالت كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يضع لحسان منبرا في المسجد يقوم عليه قائما يفاخر عن رسول الله صلى الله عليه و سلم أو قال ينافح عن رسول الله صلى الله عليه و سلم ويقول رسول الله صلى الله عليه و سلم : إن الله يؤيد حسان بروح القدس ما يفاخر أو ينافح عن رسول الله صلى الله عليه و سلم-
-হযরত আয়িশা রাদিআল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত হাসসান রাদিয়াল্লাহু আনহু এর জন্য মসজিদে একটি মিম্বর রাখতেন। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বড়ত্ব প্রকাশ করতেন অথবা মুশরিকদের কুৎসা রটনাকে প্রতিহত করতেন। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করতেন, আল্লাহ! হাস্সানকে রূহুল কুদুস (জিবরাঈল আ.) এর মাধ্যমে সাহায্য করবেন, যতক্ষণ সে রাসূলের গৌরব বর্ণনা করবে অথবা (মুশরিকদের কুৎসা রটনাকে) প্রতিহত করতে থাকবে। (তিরমিযী, আহমদ ও হাকিম। ইমাম তিরমিযী (র.) বলেন- হাদীসখানা হাসান, সহীহ।)
এ হাদীস থেকে একথাও প্রমাণিত হয়, রাসূল (সা.) জন্ম ও বংশ মর্যাদা আলোচনা ও তাঁর প্রশংসাসূচক কাসীদা পাঠের সময় দাঁড়ানো জায়িয। এতে কোনো অসুবিধা নেই।

কাজের মাধ্যমে রাসূলে পাক (সা.) এর প্রতি উচ্চ মর্যাদা প্রদর্শন
কোন কোন সময় সাহাবায়ে কিরাম কাজের মাধ্যমে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উচ্চ মর্যাদা প্রদর্শন করতেন। যেমন- হাদীস শরীফে এসেছে-
إن عروة جعل يرمق أصحاب النبي صلى الله عليه و سلم بعينه قال فوالله ما تنخم رسول الله صلى الله عليه و سلم نخامة إلا وقعت في كف رجل منهم فدلك بها وجهه وجلده وإذا أمرهم ابتدروا أمره وإذا توضأ كادوا يقتتلون على وضوئه وإذا تكلم خفضوا أصواتهم عنده وما يحدون إليه النظر تعظيما له فرجع عروة إلى أصحابه فقال أي قوم والله لقد وفدت على الملوك ووفدت على قيصر وكسرى والنجاشي والله إن رأيت ملكا قط يعظمه أصحابه ما يعظم أصحاب محمد صلى الله عليه و سلم محمدا والله إن تنخم نخامة إلا وقعت في كف رجل منهم فدلك بها وجهه وجلده وإذا أمرهم ابتدوا أمره وإذا توضأ كادوا يقتتلون على وضوئه وإذا تكلم خفضوا أصواتهم عنده وما يحدون إليه النظر تعظيما له
-উরওয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীদেরকে দেখে (তার সঙ্গীদের কাছে ফিরত গিয়ে) বলেন, আল্লাহর কসম! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই থুথু ফেলতেন তখনই তা তাঁর কোন সাহাবী হাতের তালুতে নিতেন এবং তা তার চেহারা ও মুখে মালিশ করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাদেরকে কোন নির্দেশ দিতেন তাঁরা তা প্রতিযোগিতামূলকভাবে পালন করতেন। যখন তিনি উযূ করতেন তাঁর উযূর পানি নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ বেঁধে যেত। যখন তিনি কথা বলতেন তখন সাহাবায়ে কিরাম আওয়াজ নিচু করে রাখতেন এবং তাঁর সম্মানে তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাতেন না। হযরত উরওয়া তাঁর সঙ্গীদের কাছে ফিরে গেলেন এবং বললেন, আমি অনেক রাজা-বাদশাহর কাছে গিয়েছি, আমি রোম ও পারস্য সম্রাটদের কাছে, নাজ্জাশীর কাছে গিয়েছি; কিন্তু সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যতটুকু সম্মান করতে দেখেছি কোন রাজা-বাদশাহকে তার অনুসারী কর্তৃক এতো সম্মান করতে দেখিনি। আল্লাহর কসম! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাদেরকে কোন নির্দেশ দিতেন তারা তা প্রতিযোগিতামূলকভাবে পালন করতেন। যখন তিনি উযূ করতেন তাঁর উযূর পানি নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ বেঁধে যেত। যখন তিনি কথা বলতেন সাহাবায়ে কিরাম আওয়াজ নিচু করে রাখতেন এবং তাঁর সম্মানে তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাতেন না। (বুখারী ও আহমদ)
আলোচ্য হাদীস থেকে ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (র.) যে মাসআলা বের করেছেন, তা নিম্নরুপ-
ولعل الصحابة فعلوا ذلك بحضرة عروة وبالغوا في ذلك إشارة منهم إلى الرد على ما خشيه من فرارهم وكأنهم قالوا بلسان الحال من يحب إمامه هذه المحبة ويعظمه هذا التعظيم كيف يظن به أنه يفر عنه ويسلمه لعدوه
-সম্ভবতঃ সাহাবায়ে কিরাম উরওয়ার উপস্থিতিতে বেশি সম্মান করার কারণ এ কথার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান যে, সাহাবায়ে কিরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ছেড়ে চলে যাবেন- উরওয়ার এমন আশঙ্কার জবাবে প্রদান করা। যেন তারা একথা বুঝাতে চেয়েছেন, যে ব্যক্তি তার ইমামকে এরূপ ভালবাসে ও সম্মান করে, কিভাবে ধারণা করা যায় যে, সে তার ইমামকে শত্রুর সামনে রেখে পলায়ন করবে। (ফতহুল বারী, খন্ড ০৫, পৃষ্ঠা: ৩৪১)
ইবনু হাজার আসকালানী (র.) এর বক্তব্য থেকে প্রমানিত হলো যে, কাফিরগন যখন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অপরাপর নেতাদের মতো ধারণা করেছিল, তখন সাহাবায়ে কিরাম কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন যে, তাঁদের কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদা কতটুকু। খারিজীদের দ্বারা প্রভাবিত ওয়াহাবীরা যখন কোন বক্তব্যের মাধ্যমে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মর্যাদাকে খাটো করে দেখাতে চায়, তখন সাহাবায়ে কিরামের অনুসরণে কথায় এবং কাজে উভয় পন্থায় তাদের জবাব দেয়া উচিত।

রাসূল (সা.) এর উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কিত কয়েকটি বর্ণনা
রাসূল (সা.)-এর মানাকিব বা উচ্চমর্যাদার আলোচনা শুনলে ইয়াহুদিরা বিরক্ত হতো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর মানাকিব বা মর্যাদাকে অস্বীকার করার কারণে একবার হযরত উমর (রা.) এক ইয়াহুদিকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছিলেন। ঘটনাটি ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (র.) ‘খাসাইসুল কুবরা’ কিতাবে এভাবে উল্লেখ করেছেন:
وأخرج ابن راهويه في مسنده وابن أبي شيبة في المصنف عن مكحول قال كان لعمر على رجل من اليهود حق فأتاه يطلبه فقال عمر لا والذي اصطفى محمدا على البشر لا أفارقك فقال اليهودي والله ما اصطفى الله محمدا على البشر فلطمه عمر فأتى اليهودي النبي {صلى الله عليه وسلم} فأخبره فقال ( أما أنت يا عمر فأرضه من لطمته بل يا يهودي آدم صفي الله وإبراهيم خليل الله وموسى نجي الله وعيسى روح الله وأنا حبيب الله -( الخصائص الكبرى)
-ইবনুর রাহওয়াই তার মুসনদে, ইবনু আবী শায়বা তার আল মুসান্নাফে মকহুল থেকে রেওয়ায়ত করেছেন তিনি বলেন, এক ইয়াহুদীর কাছে হযরত উমর (রা.)-এর কিছু পাওনা ছিল। উমর (রা.) পাওনা আদায়ের জন্য ইয়াহুদীর কাছে এলেন এবং বললেন, ঐ সত্তার কসম করে বলছি যিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সকল মানুষের মধ্য থেকে নির্বাচন করেছেন। আমার পাওনা আদায় না করা পর্যন্ত তোমাকে ছাড়ব না। এর জবাবে ইয়াহুদী লোকটি বললো, খোদার কসম! আল্লাহ মুহাম্মদকে মানব জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ বানাননি। একথা শুনে হযরত উমর (রা.) ইয়াহুদীকে চপেটাঘাত করলেন। ইয়াহুদী লোকটি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এল এবং অভিযোগ করল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উমর (রা.) কে বললেন, হে উমর! তোমার চপেটাঘাতের বিনিময়ে তাকে সন্তুষ্ট কর এবং ইয়াহুদীকে সম্বোধন করে বললেন, হে ইয়াহুদী! আদম (আ.) ছিলেন সাফিউল্লাহ, ইবরাহীম (আ.) ছিলেন খলীলুল্লাহ, মূসা (আ.) নাজীউল্লাহ ছিলেন, ঈসা (আ.) রুহুল্লাহ ছিলেন আর আমি হলাম হাবীবুল্লাহ (আল্লাহর একান্ত বন্ধু)। (আল খাসাইসুল কুবরা, তৃতীয় খন্ড , পৃষ্ঠা: ১৯৮)
উপরের হাদীস পর্যালোচনা করলে যে বিষয়টি বুঝা যায় তা হলো-বিনয়ী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বক্ষেত্রে তাঁর নিজের ব্যপারকে ছোট করে দেখতেন। ইয়াহুদীটি হিংসাবশত, কিংবা না জানার কারণে যে কথাটি বলেছিল, তা গুরুতর অপরাধ ছিল এবং হযরত উমর (রা.) কর্তৃক তাকে শাস্তি প্রদান সঠিক ছিল। দয়ালু নবী বিষয়টি তঁর নিজস্ব ব্যাপার হওয়ার কারণে কঠোরতা অবলম্বন না করে তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য উমর (রা.) কে বলেছিলেন। অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কথা ইয়াহুদীর সম্মুখে তুলে ধরেন। এ কাজ থেকে হযরত উমর (রা.) কর্তৃক শাস্তি বিধানের বৈধতার প্রমাণ পাওয়া যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নিজের ব্যপারকে গুরুত্ব না দিলেও সাহাবায়ে কিরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ব্যপারকে খুব গুরুত্ব দিতেন। এক্ষেত্রে হুদাইবিয়ার সন্ধির মুহূর্তে আলী (রা.)-এর ঘটনা উল্লেখযোগ্য। কাফিরগণ সন্ধিনামা থেকে ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দ বাদ দিতে বললে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা মেনে নিলেও হযরত আলী (রা.) তা না মেনে ইশকে রাসূলেরই পরিচয় দিয়েছিলেন।
হুনাইন যুদ্ধে যুল খুয়াইসিরা গনীমতের মাল বণ্টনে অনিয়মের অভিযোগ আনলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও হযরত উমর (রা.) তাকে হত্যার অনুমতি চেয়ে হুব্বে রাসূলের পরিচয় দিয়েছিলেন।
মুসলমানদের মধ্যে রাসূল (সা.) এর উম্মতের দাবীদার অনেকে বলে থাকেন ‘কেবল আমল নিয়ে ব্যস্ত থাক, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মর্যাদার সাথে সম্পর্কিত ঘটনাবলী আলোচনা করে কোন লাভ নেই, তাঁকে আমাদের মতো বললেই চলবে। (নাউযুবিল্লাহ) তারা বলে থাকে- চল্লিশ বছর বয়সের আগে তাঁর কোন মর্যাদা ছিল না বিধায় এসব আলেচনা করে কোন লাভ নেই। ইনশাআল্লাহ পরবর্তী আলোচনা থেকে প্রমান করব যে সৃষ্টির প্রথম থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আলোচনার কতটুকু গুরুত্ব রয়েছে।
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মানাকিব (উচ্চ মর্যাদা) সম্পর্কে যারা অবগত নয়, তাদেরকে এ সম্পর্কে অবগত করার গুরুত্ব কতটুকু তা নিম্নবর্ণিত হাদীস থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।
عن ابن عباس قال جلس ناس من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم ينتظرونه قال فخرج حتى إذا دنا منهم سمعهم يتذاكرون فسمع حديثهم فقال بعضهم عجبا أن الله عز وجل اتخذ من خلقه خليلا اتخذ إبراهيم خليلا وقال آخر ماذا بأعجب من كلام موسى كلمه تكليما وقال آخر فعيسى كلمة الله وروحه وقال آخر آدم اصطفاه الله فخرج عليهم فسلم وقال قد سمعت كلامكم وعجبكم أن إبراهيم خليل الله وهو كذلك وموسى نجي الله وهو كذلك وعيسى روح الله وكلمته وهو كذلك وآدم اصطفاه الله وهو كذلك ألا وأنا حبيب الله ولا فخر وأنا حامل لواء الحمد يوم القيامة ولا فخر وأنا أول شافع وأول مشفع يوم القيامة ولا فخر وأنا أول من يحرك حلق الجنة فيفتح الله لي فيدخلنيها ومعي فقراء المؤمنين ولا فخر وأنا أكرم الأولين والآخرين ولا فخر-
অনুবাদ: হযরত ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কিছু সাহাবী বসে তাঁর অপেক্ষা করছিলেন। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে যখন তাঁদের কাছাকাছি হলেন, তখন শুনলেন তারা পরস্পর কথা বলছেন। তিনি তাঁদের কথা বার্তা শুনতে পেলেন। তাঁদের কেউ বলছিলেন, কি আশ্চর্য! আল্লাহ তা’আলা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন। ইবরাহীম (আ.) কে তিনি তাঁর খলীল (অন্তরঙ্গ বন্ধু) রূপে গ্রহণ করেছেন। কেউ বলছেন, মূসা (আ.) এর সাথে কথা বলা অপেক্ষা এটা আশ্চর্যের নয়। আল্লাহ তো মূসা (আ.) এর সাথে বিশেষভাবে কথা বলেছেন। অন্য একজন বললেন- ঈসা (আ.) তো আল্লাহর কলিমা ও রূহ। অন্যজন বললেন, আদম (আ.) কে আল্লাহ বিশেষভাবে মনোনীত করেছেন। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের কাছে বের হয়ে এলেন এবং তাঁদেরকে সালাম দিলেন। এরপর বললেন, আমি তোমাদের কথাবার্তা ও তোমাদের বিস্ময়ের কথা শুনেছি। ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর খলীল। নিশ্চয় তিনি এরূপ। মূসা (আ.) আল্লাহর সাথে কথা বলেছেন, একথাও ঠিক। ঈসা (আ.) আল্লাহর রূহ ও কলিমা। ঠিকই তিনি অনুরূপ। আদম (আ.) আল্লাহর মনোনীত। তিনি ঠিকই এরূপ। তবে জেনে রাখো, আমি হচ্ছি হাবীবুল্লাহ। আর এতে আমি অহংকার করছি না। কিয়ামতের দিন আমিই হব প্রশংসার পতাকা বহনকারী। এটা কোন অহংকার নয়। কিয়ামতের দিন আমিই হব প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার সুপারিশই প্রথম গ্রহণ করা হবে। এটা আমার কোন অহংকার নয়। আমিই সর্ব প্রথম জান্নাতের কড়া নাড়ব। আল্লাহ তাআলা তা আমার জন্য খুলে দিবেন এবং আমাকে সেখানে প্রবেশ করাবেন। আর দরিদ্র মু’মিনরা আমার সঙ্গে থাকবে। এতে কোন অহংকার নেই। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবার চেয়ে আমি বেশি সম্মানের অধিকারী। এটা কোন অহংকার নয়। (তিরমিযী: কিতাবুল মানাকিব. বাব: ما جاء في فضل النبي)
উপরোক্ত হাদীস থেকে কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত হল-
১. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মর্যাদা সম্পর্কে সাহাবায়ে কিরামকেও ধারণা দেয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
২. তিনি যে সৃষ্টির সেরা এর সপক্ষে সাহাবায়ে কিরামের সম্মুখে অনেক দলীল পেশ করেছেন।
আর এ ধরনের আলোচনার মাহফিল করে ঈমানকে শক্তিশালী করা নবীর সুন্নাত। বিশেষ করে তাদের উদ্দেশ্য, যারা তাওহীদ নিয়ে অতি উৎসাহী হওয়ার কারণে শানে রিসালাতকে এড়িয়ে চলেন।
রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মানাকিব সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থে অনেক হাদীস রয়েছে। যেমন-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ بُعِثْتُ مِنْ خَيْرِ قُرُونِ بَنِي آدَمَ قَرْنًا فَقَرْنًا حَتَّى كُنْتُ مِنْ الْقَرْنِ الَّذِي كُنْتُ فِيهِ
-হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি যুগে যুগে আদম সন্তানের সর্বোত্তম যুগে প্রেরিত হয়েছি। (বুখারী, কিতাবুল মানাকিব)
মিরকাত কিতাবে উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় মুল্লা আলী কারী (র.) লিখেছেন-
انتقلت اولا من صلب اسماعيل ثم من كنانة ثم من قريش ثم من بني هاشم
‘আমি প্রথমত: ইসমাঈল (আ.) এর পৃষ্ঠদেশ হতে স্থানান্তরিত হয়েছি। এর পর কেনানা হতে, এরপর কুরাইশ হতে, তারপর বনী হাশিম হতে স্থানান্তরিত হয়েছি। (মিরকাত, খন্ড : ১০ পৃষ্ঠা: ৪১৯)
হযরত ওয়াসিলা ইবনুল আসকা’ (রা.) বর্ণিত একটি হাদীস ‘আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ.) এর সন্তানদের মধ্যে হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে নির্বাচিত করেছেন। আর ইসমাঈল (আ.) এর সন্তানদের মধ্য থেকে বনূ কেনানাকে, বনূ কেননা থেকে কুরাইশকে, কুরাইশদের থেকে বনূ হাশিমকে আর বনূ হাশিম থেকে আমাকে নির্বাচিত করেছেন। (মুসলিম: কিতাবুল ফাদ্বাইল; তিরমিযী: কিতাবুল মানাকিব)।
অপর একটি হাদীস হলো- হযরত মুত্তালিব ইবনু আবি ইদাআহ (مطلب بن ابى وداعه) বর্ণনা করেন, একদা হযরত আব্বাস (রা.) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খিদমতে হাযির হলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো যে, আব্বাস (রা.) কোনো অপছন্দনীয় কথা শুনেছেন। এমতাবস্থায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরে দাঁড়িয়ে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) কে প্রশ্ন করলেন, আমি কে? সাহাবায়ে কিরাম জবাব দিলেন, আপনি আল্লাহর নবী। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, আমি হলাম- মুহাম্মদ ইবনু আবদিল্লাহ ইবনু আবদিল মুত্তালিব। আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগত সৃষ্টি করে তাদের মধ্যে উত্তম ভাগে আমাকে রাখলেন। এরপর তাদেরকে দু’দলে বিভক্ত করে আমাকে উত্তম দলে রাখলেন। এরপর তাদেরকে গোত্রে গোত্রে ভাগ করে আমাকে উত্তম গোত্রে রাখলেন। এরপর তাদেরকে বিভিন্ন ঘরে বিভক্ত করে আমাকে উত্তম ঘরে এবং উত্তম বংশে রাখলেন। (তিরমিযী: আবওয়াবুল মানাকিব)
উপরোক্ত হযরত মুত্তালিব ইবনু আবি ইদাআহ (مطلب بن ابى وداعه ) সুত্রে বর্ণিত হাদীসটির অস্পষ্ট কথাকে স্পষ্ট করে বুঝার জন্য মুল্লা আলী কারী (র.) এর মিরকাত থেকে কিছু ব্যাখ্যা তুলে ধরছি-
১. হযরত আব্বাস (রা.) কোন কথাটি শুনেছিলেন এবং কাদের কাছ থেকে শুনেছিলেন? মুল্লা আলী কারী (র.) এর ব্যাখ্যায় মিরকাত কিতাবে লিখেছেন- من الطعن في نسبه وحسبه অর্থাৎ তাঁর বংশ মর্যাদার ব্যাপারে কটাক্ষ শুনেছিলেন। আর কাদের কাছ থেকে শুনেছিলেন, এ সম্পর্কে লিখেন- جاء العباس غضبان بسبب ما سمع طعنا من الكفار অর্থাৎ কাফিরদের কাছ থেকে কঠাক্ষ শুনে হযরত আব্বাস (রা.) রাগান্বিত হয়ে আসলেন।
২. কেন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে জবাব প্রদান করেছিলেন? এর ব্যাখ্যায় মুল্লা আলী কারী (র.) লেখেন- تحدثا بنعمته وترغيبا لامته في امر متابعته অর্থাৎ নি’আমতের আলোচনা ও তাঁর নির্দেশ পালনে উম্মতকে উৎসাহ প্রদানের জন্য।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হলো- কাফিরগণ রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মানাকিবের অর্ন্তভুক্ত বংশ মর্যাদা সম্পর্কে কটুক্তি করেছিল। এতে আব্বাস (রা.) ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বেয়াদবী মূলক আচরণের জবাব দেয়ার উদ্দেশ্যে সাহাবায়ে কিরামের সম্মুখে মিম্বরে দাঁড়িয়ে তাদের জবাব দিয়েছিলেন।

মীলাদ ও সীরাত উভয়টি গুরুত্বপূর্ণ
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে মুহাদ্দিসীনে কিরাম মানাকিব ও ফাযাইল অধ্যায়ে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম, বংশ মর্যাদা ও তাঁর ফযীলত সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীস এনেছেন। সীরাত বিষয়টি যেমন মুহাদ্দিসীনে কিরামের দৃষ্টিতে ও হাদীসের কিতাবাদিতে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মানাকিব বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনিভাবে মুসলমানদের জন্য রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সীরাত আলোচনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি মীলাদ (জন্মের ইতিবৃত্ত ও বংশ মর্যাদা) আলোচনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মীলাদ ও সীরাত উভয়টিই আলাদা আলাদা মর্যাদার দাবীদার। যেহেতু এ দুটি বিষয় হাদীসশাস্ত্রবিদদের মতেও পৃথক পৃথক বিষয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গৌরবময় জন্মের ইতিবৃত্ত নির্ভর করে তাঁর বংশ মর্যাদার উপর। তিনি এ বংশ মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার প্রতি কতটুকু গুরুত্বারোপ করেছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় বুখারী শরীফের ‘কিতাবুল মানাকিবে’ বর্ণিত একটি হাদীস থেকে। হাদীসটি নিম্নরুপ-
حَدَّثَنِي عُثْمَانُ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ حَدَّثَنَا عَبْدَةُ عَنْ هِشَامٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ اسْتَأْذَنَ حَسَّانُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي هِجَاءِ الْمُشْرِكِينَ قَالَ كَيْفَ بِنَسَبِي فَقَالَ حَسَّانُ لَأَسُلَّنَّكَ مِنْهُمْ كَمَا تُسَلُّ الشَّعَرَةُ مِنْ الْعَجِينِ
অর্থাৎ হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হাসসান (রা.) কবিতার ছন্দে মুশরিকদের নিন্দা করতে অনুমতি চাইলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার বংশকে কিভাবে তুমি পৃথক করবে? হাসসান (রা.) বললেন, আমি তাদের মধ্যে এমনভাবে আপনাকে (আপনার বংশকে) আলাদা করে নিব যেমনভাবে আটার খামির থেকে চুলকে পৃথক করে নেয়া হয়। (বুখারী, কিতাবুল মানাকিব, বাব: যে ব্যক্তি একথা পছন্দ করে যে, তার বংশকে গালমন্দ করা না হোক)
উপরোল্লেখিত হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্ম বৃত্তান্তের সাথে সম্পৃক্ত গৌরবময় বংশ মর্যাদার প্রতি কোন হেয় মনোভাব সৃষ্টি হয় এমন আলোচনা পছন্দ করতেন না। বরং আলোচনার মাধ্যমে এ মর্যাদাকে সমুন্নত করাই ছিল তাঁর তরীকা। এ কারণে মীলাদুন্নবীর মাহফিলে তাঁর পূর্ব পুরুষদের বুযুর্গী, সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত ঘটনাবলী গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হয়ে থাকে, যাতে নবীদ্রোহীদের কলিজা ছিদ্র হয়ে যায়। আর নবী প্রেমিকরা প্রশান্তি লাভ করে।

রাসূল (সা.) এর বংশ মর্যাদা বর্ণনা প্রসঙ্গে ইদ্রিস কান্দলভীর বক্তব্য
আকাবীরে দেওবন্দ এর নিকট অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সীরাত গ্রন্থ ‘সীরাতে মুস্তফা’ থেকে হযরত ওয়াসিলা ইবনুল আসকা (রা.) বর্ণিত হাদীস প্রসঙ্গে কিছু বক্তব্য এখানে উপস্থাপন করা হল। ‘সিরাতে মুস্তফা’ কিতাবটি লিখেছেন আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশমিরী (র.) এর সুযোগ্য ছাত্র মাওলানা ইদ্রিস কান্দলভী। মূল কিতাবটি উর্দ্দু ভাষায় লিখিত। উক্ত কিতাবে ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র বংশ’ অধ্যায়ে কান্দুলভী সাহেব দীর্ঘ আলোচনার পর লেখেন-
সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত ওয়াসিলা ইবনু আসকা’ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা হযরত ইসমাঈল (আ.) এর বংশধর হতে বনূ কিনানাকে নির্বাচন করেছেন এবং বনূ কিনানা হতে কুরাইশকে, কুরাইশ হতে বনূ হাশিমকে এবং বনী হাশিম থেকে আমাকে নির্বাচন করেছেন। ইবনু সা’দের একটি মুরসাল রিওয়ায়াতে আরো এতটুকু বর্ধিত করা হয়েছে যে, বনূ হাশিমের মধ্য থেকে আব্দুল মুত্তালিবকে নির্বাচিত করা হয়েছে।
ইদ্রিস কান্দলভী আরো লিখেছেন- “উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা (আল্লাহ ক্ষমা করুন) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কোন গর্ব প্রকাশ করা উদ্দেশ্য নয়; বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাস্তব অবস্থা বর্ণনা করা; যাতে জনসাধারণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মর্যাদা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হতে পারে। সর্বোপরি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ নিআমতের বহি:প্রকাশ করেছেন এভাবে যে, ঐ মহান রাব্বুল আলামীনের অপরিসীম শুকরিয়া যিনি আমাকে একটি নির্বাচিত এবং পছন্দনীয় বংশ থেকে একজন নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন।”
তিনি আরো লিখেন- নবীর উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ঘোষণা প্রদান করা ফরয করা হয়েছে যে, তিনি যেন স্বীয় নবুওয়াত এবং রিসালাতের ন্যায় স্বীয় আল্লাহ প্রদত্ত কামালাতেরও ঘোষণা প্রদান করেন, যাতে উম্মতগণ স্বীয় নবীর মর্যাদা সম্পর্কে সম্যক অবগত হয়, তাঁর কামালিয়াত থেকে ফায়দা হাসিল করতে পারে এবং তাঁর প্রশংসনীয় গুণাবলীর মধ্যে যাতে কেউ বিন্দুমাত্র সন্দেহ-সংশয় পোষণ করতে না পারে। আল্লাহ না করুন, যা কোনো দূর্ভাগা ব্যক্তির জন্য ঈমান বিনষ্ট হওয়ার কোনো কারণে পরিণত হয়। আর যেমনিভাবে তাঁর নবুওত ও রিসালাতের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা প্রয়োজন অনুরূপভাবে নবীর আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত হওয়া এবং সার্বিক বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য হওয়ার উপরও বিশ্বাস স্থাপন করা প্রয়োজন। তাই পবিত্র হাদীসে ইরশাদ হচ্ছে- انا سيد ولد ادم ولا فخرـ ‘আমি সমস্ত আদম সন্তানের সরদার, এতে আমার কোনো গর্ব নেই (বরং প্রচারের উদ্দেশ্যে আমি তা বলছি)। যেমন আল্লাহ তাআলার নির্দেশ-
يايها الرسول بلغ ما انزل اليك من ربك وان لم تفعل فما بلغت رسالته ـ
-হে রাসূল! আল্লাহর পক্ষ থেকে যে বাণী আপনার নিকট অবতীর্ণ করা হয়েছে তা আপনি জনসধারণের নিকট পৌঁছে দিন। যদি আপনি এ দায়িত্ব পালন না করেন, তবে বুঝে নিবেন যে, আপনি আল্লাহ তা’আলার বাণী জনসাধরণের নিকট পৌঁছে দেননি। (সূরা আল মায়িদা, আয়াত ৬৭)
এ কথার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার নির্দেশ পালনার্থে নবুওয়াত এবং রিসালাতের ন্যায় স্বীয় নেতৃত্বের ঘোষণা দিচ্ছি, এ কথার মধ্যে (আল্লাহ মাফ করুন) আমার গর্ব করার কোনো উদ্দেশ্য নেই।
একটি হাদীসে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, হযরত জিবরাইল (আ.) আমাকে বলেছেন, আমি পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সমস্ত পৃথিবী অনসুন্ধান করেছি, কিন্তু হাশিম গোত্র থেকে উত্তম কোনো গোত্র পাই নি।’ এ হাদীস ইমাম তাবারানী এবং ইমাম আহমদ (র.) বর্ণনা করেছেন। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (র.) বলেন, এ হাদীস বিশুদ্ধ হওয়ার সনদ একেবারেই সুস্পষ্ট। হাকিম তিরমিযী বলেন, হযরত জিবরাঈল (আ.) পবিত্র সত্তার অন্বেষণে সমগ্র পৃথিবী জরিপ করেন, যেহেতু জাহিলিয়াতের যুগ ছিল, তাই হযরত জিবরাঈল (আ.) বাহ্যিক কাজ-কর্মের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেননি; বরং স্বভাব এবং যোগ্যতার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। এ জরিপের মধ্যে সাধারণভাবে আরব এবং বিশেষভাবে বনূ হাশিম থেকে শ্রেষ্ঠ অন্য কাউকেও পাওয়া যায়নি। (যুরকানী-১ম খন্ড , পৃষ্ঠা: ৬৮ সূত্রে সীরাতে মুস্তফা, ১ম খন্ড , পৃষ্ঠা: ৪১)
কান্দুলভী সাহেবের উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হচ্ছে-আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় অত্যাবশ্যকীয় করে দেওয়া হয়েছে। আর তা হলো-
১. নবুওয়াত ও রিসালাতের ন্যায় স্বীয় আল্লাহ প্রদত্ত উচ্চ বংশ মর্যাদা (যা মীলাদুন্নবীর আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত) প্রচার করা, যাতে উম্মত তা জানতে পারে।
২. এ জানার উপকারিতা হলো তাঁর প্রশংসনীয় গুণাবলির মধ্যে কেউ যেন বিন্দু মাত্র সংশয় না করে। কারণ এ ব্যপারে সন্দেহে করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কেবল নবী-রাসূলই বিশ^াস করলে চলবে না; বরং তার প্রশংসনীয় গুণাবলীকে বিশ^াস করার মাধ্যমে অন্তরে ঈমানের বাতি জ্বালাতে হবে।
উল্লেখ্য যে, যেহেতু উলামায়ে কিরাম রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওয়ারিস, সে কারণে তাদেরকে এসব বিষয়ে প্রচারে যতœবান হতে হবে।

তাবলীগী বয়ানেও বুযুর্গানে কিরামের শৈশবকালীন মানাকিব বা ফযীলত ভক্তি সহকারে পড়া ও শুনার প্রচলন রয়েছে
সচরাচর দেখা যায় যে, অনেক উলামায়ে কিরাম বা মসজিদের ইমামগণ অনেক সময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের সময়ের বা তাঁর শৈশবের কোন ঘটনা বর্ণনা করে থাকেন। আর এতে তাবলীগের অনুসারী ও দেওবন্দী কোন কোন আলিম নাখোশ হন, অস্বস্তি বোধ করেন এবং এ কাজকে তারা অনর্থক মনে করেন। কিন্তু তারা হয়তো জানেন না যে, তাবলীগী নেসাবসহ বহুসংখ্যক গ্রন্থ প্রণেতা শাইখুল হাদীস যাকারিয়া সাহেব স্বীয় ‘হেকায়াতে সাহাবা’ গ্রন্থে তার সম্মানিত পিতার শৈশবকালীন একটি কারামতের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তাবলীগী ভাইরা তা অত্যন্ত ভক্তি সহকারে শুনে ফয়যিয়াভ হয়ে থাকেন। ইমাম হাসান (রা.) এর শৈশবকালীন জ্ঞানচর্চার ফায়দা অংশে তিনি উল্লেখ করেন-“আমি আমার পিতার নিকট অনেকবার শুনেছি এবং ঘরের বৃদ্ধা মেয়েলোকদের নিকট থেকেও শুনেছি যে, বাবা যখন দুধ ছেড়েছিলেন, তখন এক চতুর্থাংশ কুরআন তার মুখস্থ হয়ে যায় এবং ঐ বয়সে দাদাজানের নিকট থেকে তিনি বুস্তা, সিকান্দারনামা ইত্যাদি ফারসী কিতাবও পড়ে ফেলেন।” (তাবলীগী নেসাব, পৃষ্ঠা: ৬৩৪)
কিছুসংখ্যক তাবলীগ জামাতের অনুসারী যেমনিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মকালীন ও শৈশবকালীন ঘটনা বর্ণনা করাকে অনর্থক মনে করে তাচ্ছিল্য করে থাকেন, ঠিক এমনিভাবেই শাইখুল হাদীস যাকারিয়া সাহেবের পিতার শৈশবকালীন কারামতকে ব্যঙ্গ বিদ্রæপ ও তাচ্ছিল্য করেছেন তাবিশ মাহদী। তাবিশ মাহদীর ব্যঙ্গ বিদ্রæপের প্রতুত্তরও প্রদান করেছেন দেওবন্দীদের মুখপাত্র মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানভী। তিনি শাইখুল হাদীস যাকারিয়া সাহেবের খলীফাও ছিলেন। তিনি তার ‘আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল’ কিতাবে তাবিশ মাহদীর বিদ্রæপের জবাবে লিখেন-
শায়খ (যাকারিয়া) এর রিসালাসমূহ আল্লাহ তাআলা এমনভাবে কবূল করেছেন যে, সমস্ত পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষায় এর আলোচনা করা হচ্ছে এবং রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এমন একটি মহূর্ত বাকী নেই যে, দুনিয়ার কোন না কোন স্থানে এ পুস্তিকাগুলো পড়ে শুনা এবং শুনানো হচ্ছে না। (আপকে মাসাঈল আওর উনকা হল, খন্ড : ৭, পৃষ্ঠা: ২৯২)
মাওলানা ইউসূফ লুধিয়ানভী সাহেবের বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হল যে, যাকারিয়া সাহেবের আব্বার শৈশবকালীন কারামতের ঘটনাটি তাবলীগী ভাইয়েরা তাদের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করে রাত দিন দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে পড়ে শুনান। এটা একটি ভালো কাজ। এতে আমাদের কোন দ্বিমত নেই। তবে মীলাদুন্নবীর মাহফিলে যখন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম ও শৈশবকালীন অবস্থা বর্ণনা করা হয় তখন অধিকাংশ সাধারণ তাবলীগী ও তাদের আমীরগণ এ কাজকে অপছন্দ করে থাকেন। এটা তাবিশ মাহদী কর্তৃক যাকারিয়া সাহেবের পিতার ঘটনা বর্ণনা করাকে অপছন্দ করার চেয়ে আরো জঘন্য কাজ।

সর্বক্ষেত্রে সহীহ হাদীস দিয়ে দলীল গ্রহণের দাবীর অসারতা
কেউ কেউ রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মবৃত্তান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে কেবল সহীহ হাদীসের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। অথচ তাদের এ দাবী অগ্রহণযোগ্য। ইদ্রিস কান্দুলভী ‘সীরাতে মুস্তফা’ এর মধ্যে লিখেছেন, যে সব হাদীসের উপর দ্বীন নির্ভরশীল নয়, যেমন ফাযায়িল ও মানাকিব ইত্যাদি- সেসব ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসীনে কিরাম যথাসম্ভব কিছুটা নমনীয়তা অবলম্বন করেছেন। কেননা এখানে কোন আমল উদ্দেশ্য নয় বরং শুধুমাত্র ইলমই উদ্দেশ্য। এজন্য এসব স্থানে শিথিলতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (র.) থেকে বর্ণিত আছে,
اذا روينا في الحلال والحرام تشددنا واذا روينا في الفضائل تساهلنا
-‘যখন আমরা হালাল ও হারাম সম্পর্কে রেওয়ায়েত করি তখন সেখানে আমরা কঠোরতা অবলম্বন করি, আর যখন ফাযাইল ও মানাকিব সম্পর্কে রেওয়ায়েত করি তখন সেখানে শিথিলতা অবলম্বন করি।’ (সীরাতে মুস্তফা, খÐ ১)

রাসূল (সা.) সৃষ্টির প্রথম থেকেই রহমত লাভের ঝর্ণাধারা
ওয়াহাবীরা সর্বক্ষেত্রেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মর্যাদার সাথে সম্পকির্ত বিষয়গুলোকে কাট-ছাট করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে থাকে। এরই ধারবাহিকতায় তারা বলে থাকে, চল্লিশ বৎসর বয়সের আগে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন গুরুত্ব ছিল না। আর তাদের দ্বারা প্রভাবিত কিছু সংখ্যক দেওবন্দী আলিমও এ ধরণের কথা বলে থাকেন। দেওবন্দীদের স্মরণ রাখা উচিত আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী (র.)-যাকে তারা ইমামুল আসর খেতাব দিয়েছেন, তিনি আদম (আ.) সৃষ্টির পূর্ব থেকেই রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গুরুত্বের কথা দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছেন। তিরমীযি শরীফের একটি হাদীস-
عن أبي هريرة قال قالوا يا رسول الله متى وجبت لك النبوة ؟ قال وآدم بين الروح والجسد
-হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহাহ! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আপনার জন্য কখন থেকে নবুওয়াত নির্ধারিত? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাব দিলেন, যখন আদম আলাইহিস সালাম রূহ আর দেহের মধ্যে ছিলেন। (অর্থাৎ যখন তাঁর মধ্যে রূহ ফুৎকার করা হয়নি, তখন থেকে।) (তিরমিযী, ২য় খন্ড , পৃষ্ঠা: ২০১)

উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশমিরী (র.) বলেন-
أي كان النبي ( ص ) نبياً وجرت عليه أحكام النبوة من ذلك الحين بخلاف الأنبياء السابقين ، فإن الأحكام جرت عليهم بعد البعثة
অর্থাৎ ঐ সময় থেকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবী ছিলেন এবং তাঁর প্রতি নবুওয়াতের আহকামসমূহ জারী ছিল। অন্যান্য নবীগণের ক্ষেত্রে তার বিপরীত ছিল। কারণ তাঁদের নবুওয়াতের হুকুমসমূহ তাঁদের নবুওয়াত লাভের পর থেকে কার্যকর হয়। (العرف الشذي)
হুসাইন আহমদ মাদনী সাহেবের বক্তব্য
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টির প্রথম থেকে রহমত লাভের ঝর্ণাধারা বলে বিশ^াস করাই আকাবিরীনে দেওবন্দের আকীদা ছিল। প্রমাণ স্বরূপ শায়খ মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদনী সাহেবের একটি বক্তব্য নি¤েœ তুলে ধরছি। এ প্রসঙ্গে মাদানী সাহেব তার ‘আশ-শিহাবুস সাকিব’ কিতাবে লিখেন-
“আমাদের পূর্বসুরি উলামায়ে কিরাম সকলেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্তাকে সর্বদা আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ, অসংখ্যা অগণিত রহমত লাভের ঝর্ণাধারা বলে বিশ^াস করতেন। তাঁদের বিশ^াস এই যে, সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বিশ^বাসীর উপর যত রহমত অবতীর্ণ হয়েছে এবং অবতীর্ণ হবে- হোক তা অস্তিত্বশীল বা অন্য রকম- সকলের মধ্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যাতে পাক এমনভাবে সম্পৃক্ত, যেমন সূর্য হতে চন্দ্র আলোকিত হয় এবং চন্দ্র হতে আলো হাজার হাজার কাঁচখন্ডে বিকশিত হয়। মোট কথা, হাকীকতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন বিশ্ব ও বিশ্ববাসীর সম্পূর্ণ পরিপূর্ণতা লাভের মাধ্যম। এ কথাই প্রকাশ পায় নিম্নবর্ণিত হাদীস সমূহে-
خلقت الافلاك لما ك ﻻ لو অর্থাৎ যদি আপনি না হতেন, তাহলে আমি সৃষ্টিজগতকে সৃষ্টি করতাম না। نورى الله ما خلق اول অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। الانبياء نبى انا অর্থাৎ আমি নবীগণের নবী।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ইহসান ও দান ব্যাপক। সমগ্র বিশ^ তাতে অংশীদার। (আশ-শিহাবুস সাকিব, পৃষ্ঠা: ৬৪)

শাহ ওলী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)-এর বক্তব্য
প্রখ্যাত বুযুর্গ আব্দুস সালাম বিন বশিশ (র.) তাঁর এক দু’আয় রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘হিজাবে আযম’ (বিশাল পর্দা) বলেছিলেন।
শাহ ওলী উল্লাহ দেহলভী (র.) উক্ত হিজাবে আযমের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লিখেছেন-
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্তাকে এজন্যই হিজাবে আযম বলা হয়েছে যেহেতু প্রকৃতপক্ষে তিনিই সর্বপ্রথম এবং সর্ব বৃহৎ সৃষ্টি। যেমনটি লোকেরা রাসূলে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তি ‘আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূরকে সৃষ্টি করেছেন’ বলে থাকেন এবং তা থেকেই বিভিন্ন হাকীকতের ডাল পালা বিস্তার লাভ করেছে। হকীকতে মুহাম্মদী হল হাকীকতে খোদাওন্দী এর মাধ্যম। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র রূহ নবীগণের নবী। আর এটা এজন্যই নবীগণের রূহসমূহ ইলিম এবং মারিফত তাঁর রূহের মাধ্যমে লাভ করেছে। বলা যায় নবীগণ যেমন তাঁদের উম্মতের জন্য মাধ্যম ঠিক তদ্রুপ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত রূহসমূহের (খোদায়ী ফয়েয পৌঁছানোর) মাধ্যম। (ফুয়ূযুল হারামাইন ২৯৭/২৯৬)

মাওলানা সায়্যিদ ফখরুদ্দীন আহমদ সাহেবের বক্তব্য
দেওবন্দের বিশিষ্ট আলিম, দেওবন্দ মাদরাসার প্রধান শিক্ষক জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের তৎকালীন সভাপতি সায়্যিদ ফখরুদ্দীন আহমদ সাহেব (১৩০৭-১৩৯২হিজরী) তৎপ্রণীত বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ البخاري ايضاح তে যে আলোচনা পেশ করেছেন তা উল্লেখ করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে যাবে। বুখারী শরীফে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী قاسم انا انما হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করার পরে লিখেছেন-
প্রকৃত পক্ষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়াতে আগমনের হাজার হাজার বছর আগে আল্লাহ তাআলার প্রতিনিধি হিসেবে বিদ্যমান ছিলেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবেন। এজন্য বিশে^র সকল পূর্ণতা হোক সেটা অস্তিত্বের কিংবা ইলমের, আমলের বা অন্য কিছুর, প্রকৃতপক্ষে সেটা তাঁরই পূর্ণতা। আল্লাহ তাঁকে সরাসরি তা প্রদান করেছেন। অন্যরা তার মাধ্যমে তা লাভ করেন। যেমনিভাবে সূর্যের আলো হচ্ছে আসল, আর অন্য সকল বস্তু তার আলো থেকেই আলোকিত হয়, তেমনিভাবে অস্তিত্ব জগতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অস্থিত্ব হচ্ছে মূল, বাকী সবকিছুর অস্তিত্ব হল তাঁর ছায়া ও ফয়ায। (ইযাহুল বুখারী, ১ম খন্ড , ৪৯৬ পৃষ্ঠা)

সর্বক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি আদব রক্ষা ফরয
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট এমন অনেক বিষয় আছে যা বাস্তব হলেও আলোচনা করার সময় অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়। কেননা এ সকল বিষয় আলোচনাকালে যদি কেউ ইহানত বা হেয় দৃষ্টি রাখে তাহলে কুফরী হবে। যেমন কুরআন কারীমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে বলা হয়েছে-‘তিনি আপনাকে পেয়েছেন নি:স্ব, অত:পর অভাবমুক্ত করেছেন’ এ আয়াত সম্পর্কে ইমাম যারকাশী লিখেন যে, উক্ত আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উভয় অবস্থার (নি:স্ব-ও অভাবমুক্ত) বর্ণনা আছে। এতদ্সত্তে¡ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ফকীর বা মিসকীন বলা জায়িয নয়। কেননা মহান আল্লাহর পরে তিনিই সবচেয়ে বড় ধনী। )নাসিমুর রিয়াদ, ৪র্থ খন্ড , পৃষ্ঠা: ৩৩৬)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্মলগ্ন থেকে ইয়াতীম ছিলেন। এছাড়া হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে তাঁর কাজ সম্পাদন করতেন। তিনি তার বোঝা মাথায় বহন করে নিয়ে আসতেন। সাহাবায়ে কিরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাথায় বোঝা দেখে মহব্বত এবং সম্মানের তাকীদে তার মাথা থেকে বোঝা নিতে চাইতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন বোঝার মালিক বোঝা বহন করা অধিক উত্তম।
বাস্তবতা হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াতীম ছিলেন। কখনো কখনো নিজ মাথায় নিজের বোঝা বহন করতেন। এখন যদি কেউ তুচ্ছার্থে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইয়াতীম অথবা বোঝা বহনকারী বলে তাহলে কুফরী হবে।

মীলাদুন্নবীর ক্ষেত্রে ঈদ শব্দ প্রয়োগ করা
ইমাম কাসতালানী (র.), আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) সহ অনেক আকাবির রবিউল আউয়াল মাসের রাতগুলোকে ঈদ বানানোর কথা বলেছেন। কিছু সংখ্যক নামধারী আলিম বলে থাকেন, ঈদ শব্দ কেবল দু’ ঈদের সাথে ব্যবহৃত হয়। আর কোথাও ঈদ ব্যবহার করা সঠিক নয়। ঈদ শব্দের শাব্দিক হল অর্থ আনন্দ। যে কোন ধরনের আনন্দের সময়কে ঈদ বলা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে আমরা হানাফী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য ফিকহের কিতাব ‘হাশিয়ায়ে তাহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ’ হতে কিছু আলোচনা তুলে ধরছি। উক্ত কিতাবে দু’ঈদের আলোচনা প্রসঙ্গে লিখা হয়েছে-
ويطلق على كل يوم مسرة ولذا قيل: عيد وعيد وعيد صرن مجتمعة. … وجه الحبيب ويوم العيد والجمعة.
অর্থাৎ ঈদ শব্দটি সকল আনন্দের দিনের উপরই প্রয়োগ করা যায়। আর এ জন্যই বলা হয়ে থাকে আমাদের জন্য তিনটি ঈদ একত্রিত হয়েছে। বন্ধুর চেহারা, ঈদের দিন এবং জুমুআ’র দিন।
হিদায়া কিতাবের হাশিয়ায় আব্দুল হাই লাখনবী (র.) এর ওয়ালিদ মহতরম আব্দুল হালিম লাখনবী (র.) (মৃত্যু ১২৮৫ হিজরী) জুমুআ’র দিনকে ঈদ বলা প্রসঙ্গে লিখেছেন-
سماها عيدا تبركا بقول النبي صلي الله عليه وسلم: لكل مومن في كل شهر اربعة اعياد او خمسة اعياد- او لان الجمعة يعاد اليها في كل اسبوع كما ان العيد يعاد اليه في كل سنة- او لان الله تعالي يعود الي عباده بالمغفرة فيه-
অর্থাৎ জুমুআ’র দিনকে ঈদ বলা হয়েছে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উক্তি: ‘সকল মুমিনের জন্য প্রত্যেক মাসে চারটি বা পাঁচটি ঈদ রয়েছে’ থেকে বরকত লাভের জন্য। অথবা ঈদ এ কারণে বলা হয়েছে জুমুআ’ প্রতি সপ্তাহে একবার ফিরে আসে যেমনিভাবে ঈদ প্রতি বছর ফিরে আসে। অথবা এ কারণে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা এ দিন বান্দাহর প্রতি মাগফিরাত নিয়ে ফিরে আসেন। (হাশিয়ায়ে হেদায়া, বাবুল ঈদাইন)
উপরোক্ত বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয়
১. বছরের ৫২টি দিনকে (৫২ সপ্তাহে ৫২ শুক্রবার) রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই ঈদ বলেছেন।
২. জুমুআ’কে ঈদ বলা হয় বারবার ফিরে আসার কারণে।
৩. জুমুআ’কে ঈদ বলা হয় আল্লাহর পক্ষ হতে বারবার মাগফিরাতের কারণে।
মীলাদুন্নবীর মধ্যে উপরোক্ত তিনটি কারণই বিদ্যমান রয়েছে। তাই একে ঈদ বলা অযৌক্তিক নয়।
উল্লেখ্য যে, কুরআন হাদীসে শব্দ ব্যবহারের একটি মূল নীতি হচ্ছে শব্দগুলো কোন কোন সময় প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়, আবার কোন কোন সময় রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ স্বরূপ, আল্লাহ তাআলার ক’টি সিফাতী নাম হল মাওলা। এ ব্যপারে কোন দ্বিমত নেই। অথচ এ শব্দটি বুখারী শরীফে হাদীসের সনদে অসংখ্যবার ক্রীতদাস অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এখন যদি কোন নির্বোধ বলে থাকে যে, বুখারী শরীফেই ক্রীতদাসকে আল্লাহর একটি বিশেষণের সাথে বিশেষিত করা হয়েছে, তবে তা হবে তার চরম মুর্খতার পরিচায়ক। ঠিক তদ্রুপ, ঈদ শব্দ যখন দু’ ঈদ ছাড়া অন্য কোন খুশীর দিনের জন্য ব্যবহার করা হবে, তখন তা রূপক অর্থেই ব্যবহৃত হবে এবং এরূপ ব্যবহারে কোন অসুবিধা নেই।

[লেখক: হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) এর সুযোগ্য ছাহেবজাদা;
চেয়ারম্যান, দারুল ফিকর ওয়াল ইফতা আল ইসলামী বাংলাদেশ
সুবহে সাদিক-২০১৬ থেকে গৃহীত]

শেয়ার করুন:
  • জনপ্রিয়
  • সাম্প্রতিক

নির্বাচিত

Don`t copy text!