রাসূলে পাক (সা.)-এর ওয়ালাদাত শরীফ -শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)

 

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মের সন নিয়ে ইখতিলাফ রয়েছে। অধিকাংশের মতে এ বছর ছিল ‘আমুল ফিল’ তথা হস্তিবর্ষ। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এরূপ বলেছেন। আলিমদের মধ্যে কেউ কেউ এ বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে বলেও বর্ণনা করেন আর তারা বলেন, এর বিপরীত সকল বক্তব্য ধারণাপ্রসূত। প্রসিদ্ধ মত হলো, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হস্তি বাহিনীর ঘটনার পঞ্চাশ দিন পর জন্মগ্রহণ করেছেন। সুহায়লীসহ একদল উলামায়ে কিরাম এ অভিমত পোষণ করেন। (পক্ষান্তরে) দিময়াতিসহ অন্য একদল থেকে পঞ্চান্ন দিনের কথা বর্ণিত হয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মের মাস নিয়েও ইখতিলাফ রয়েছে। প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী এ মাস হলো রবিউল আউয়াল। এটি জমহুর উলামার মত। ইবনুল জাওযী এ বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে বলে বর্ণনা করছেন। অনুরূপভাবে রবিউল আউয়ালের কোন তারিখে তাঁর জন্ম হয়েছে তা নিয়েও ইখতিলাফ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এ তারিখটি নির্দিষ্ট নয়। তবে তিনি রবিউল আউয়াল মাসের সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। জমহুর উলামার মতে, তারিখ সুনির্দিষ্ট রয়েছে। কারো কারো মতে, তিনি ২ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেছেন। আবার কারো কারো মতে, তিনি রবিউল আউয়ালের ৮ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন। শায়খ কুতবুদ্দীন কস্তলানী’র মতে অধিকাংশ মুহাদ্দিসীনে কিরাম এ মতটি গ্রহণ করেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস ও জুবায়র ইবনে মুতইম (রা.) থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অধিকাংশের নিকটও গ্রহণযোগ্য অভিমত এটি। হুমায়দী ও তাঁর শায়খ ইবনে হাযামও এ অভিমত গ্রহণ করেছেন। কুযায়ী ‘উয়ূনুল মাআরিফ’ গ্রন্থে এ বিষয়ে জীবনীকারদের ইজমা রয়েছে বলে বর্ণনা করেছেন। যুহরী হযরত মুহাম্মদ ইবনে জুবায়র ইবনে মুতইম (র.) থেকে এ মতটি বর্ণনা করেছেন। আর মুহাম্মদ ইবনে জুবায়র ইবনে মুতইম আরবের নসবনামা ও ইতিহাস সম্পর্কে অধিক অবগত ছিলেন। কারো কারো মতে এ দিনটি ছিল রবিউল আউয়ালের ১০ তারিখ। আবার কারো কারো মতে ১২ তারিখ। আর এ অভিমতটিই (১২ তারিখ) প্রসিদ্ধ। মক্কাবাসীদের অভিমতও এটি। মক্কাবাসীগণ এখনো এ দিনে (১২ রবিউল আউয়াল) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মস্থান পরিদর্শনে যান। তীবী বলেন, মুসলমানগণ একমত যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবিউল আউয়ালের বার তারিখ সোমবার জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমাদের পূর্বের আলোচনার ভিত্তিতে তাঁর ‘একমত’ কথাটির উপর ভিন্নমত পরিলক্ষিত হয়।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মের সময় নিয়েও ইখতেলাফ রয়েছে। তবে প্রসিদ্ধ অভিমত হলো, তিনি সোমবার দিনের বেলা জন্মগ্রহণ করেছেন। হযরত কাতাদা আল আনসারী (রা.) থেকে বর্ণিত যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সোমবারের রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেছিলেন: এদিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এদিন আমার উপর নবুওয়াত (ওহী) নাযিল হয়েছিল।

ইমাম মুসলিম (র.) এটি বর্ণনা করেছেন। এ বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিবাভাগে জন্মগ্রহণ করেছেন।

মুসনাদ (মুসনাদে আহমদ) এর মধ্যে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবার জন্মগ্রহণ করেছেন, সোমবারেই তাঁর নবুওয়াতের ঘোষণা (ওহী) এসেছে, মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের উদ্দেশ্যে তিনি বের হয়েছেন সোমবার এবং হজরে আসওয়াদও পুনস্থাপন করেছেন সোমবার।

(অন্য বর্ণনানুযায়ী) মক্কা বিজয় ও সূরা মায়িদা অবতীর্ণ হয়েছেও সোমবারে।

কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজর উদিত হওয়ার সময় (সুবহে সাদিকের সময়) জন্মগ্রহণ করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনিল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মাররুয যাহরান এলাকায় আয়েছ (عيص) নামক শাম দেশীয় এক পাদ্রী বাস করতেন। তিনি বলতেন, হে মক্কাবাসীগণ, শীঘ্রই তোমাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করবেন যার দ্বীন আরববাসী গ্রহণ করবে এবং তিনি অনারবদেরও বাদশাহ হবেন। তাঁর আগমনের যুগ এটিই। যখনই মক্কায় কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করতো তখন মানুষ উক্ত পাদ্রীকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেদিন জন্মগ্রহণ করেন সেদিন ভোরে আবদুল মুত্তালিব [রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাদা] পাদ্রী আয়েছ-এর নিকট গিয়ে তাকে ডাকলেন। তখন আয়েছ (পাদ্রী) তাকে স্বাগত জানালেন এবং বললেন, আমি তোমাদের যে শিশুর সম্পর্কে আলোচনা করতাম যে, সে সোমবার দিনে জন্মগ্রহণ করবে, সোমবারে ওহীপ্রাপ্ত হবে এবং সোমবারেই ইন্তিকাল করবে, সে শিশু তোমাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে। (আমি চাই) তুমিই সে শিশুর পুর্বপুরুষ হও। তখন আবদুল মুত্তালিব জানালেন, আজ রাত সুবহে সাদিকের সময় আমার ঘরে এক শিশু জন্ম নিয়েছে। তখন আয়েছ জিজ্ঞাসা করলেন, এ শিশুর নাম কী রেখেছ? আবদুল মুত্তালিব জবাব দিলেন, মুহাম্মদ। আয়েছ বললেন, আল্লাহর কসম, হে বায়তুল্লাহ’র প্রতিবেশী! আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল এ শিশুটি তোমাদের মধ্যেই জন্ম নিবেন। তিনটি বিষয় দ্বারা আমি তাঁকে পরিচয় করতে পেরেছি। ১. গত রাতে তাঁর জন্মের তারকা উদিত হয়েছে, ২. আজই (সোমবার) তাঁর জন্ম হয়েছে এবং ৩. তাঁর নাম রাখা হয়েছে মুহাম্মদ।

ইমাম আবূ জাফর ইবনে আবি শায়বা এটি বর্ণনা করেছেন। আর আবূ নুআইম তদীয় ‘দালাইলুন নুবুওয়াহ’ গ্রন্থে দুর্বল সনদে তা উল্লেখ করেছেন।

কেউ কেউ বলেন, গাফর (غفر) উদয়ের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম হয়েছে। গাফর হলো তিনটি ছোট তারকাবিশেষ, যাদের কাছাকাছি চাঁদ পরিভ্রমণ করে। নবীদের জন্মের সময়ও এটি। সময়টি সৌরমাসের বসন্তকাল ছিল এবং এর মাত্র বিশ দিন অতিবাহিত হয়েছিল।

কেউ কেউ হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসের ভিত্তিতে বলেন, তিনি রাত্রিবেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন। শায়খ বদরুদ্দীন যারকাশী বলেন, বিশুদ্ধ মত হলো, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম দিবাভাগেই হয়েছে। আর তাঁর জন্মের সময় তারকা ঝুঁকে পড়ার যে বর্ণনা এসেছে ইবনু দাহিয়া তা দুর্বল বলেছেন, কারণ তা জন্ম রাত্রিবেলায় হয়েছে বুঝায়। (ইবনু দাহিয়ার) এরূপ ব্যাখ্যা সঠিক নয়। কারণ, নবুওয়াতের সময়কালে অলৌকিক ঘটনা হতেই পারে বিধায় দিনের বেলাও তারকা ঝুঁকে পড়া সম্ভব।

অধম বান্দার (লেখকের) বক্তব্য হলো, রাতে তারকা ঝুঁকে পড়া দ্বারা সে রাতও হতে পারে যে রাতের ভোরবেলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মের রাতে তারকা ঝুঁকে পড়া বা নিক্ষিপ্ত হওয়া সংক্রান্ত ঐতিহাসিকদের যে সকল বর্ণনা রয়েছে এগুলোর মূল অর্থ এটিই।

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মের রাত শবে কদরের চেয়ে উত্তম

যদি আমরা বলি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে জন্মগ্রহণ করেছেন তাহলে সে রাতটি নিঃসন্দেহে শবে কদরের চেয়ে উত্তম। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মের রাত তাঁর নিজের আবির্ভাবের রাত আর শবে কদর তাঁকে প্রদান করা হয়েছে। স্বয়ং মহিমান্বিত সত্তার আবির্ভাবের কারণে যে মর্যাদা লাভ হয়েছে সে মর্যাদা তাঁর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত  মর্যাদার চেয়ে বেশি।

শবে কদরের মর্যাদার আরেকটি দিক হলো, এ রাতে ফেরেশতা অবতরণ করেন বলে তা মহিমান্বিত হয়েছে আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের রাত মহিমান্বিত হয়েছে তাঁর আবির্ভাবের কারণে। শবে কদর শুধু উম্মতে মুহাম্মদীর নিকট মর্যাদাবান আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের রাত সকল সৃষ্টির নিকট মর্যাদাবান। কেননা তাঁকে আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টিজগতের জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছেন এবং তাঁরই ওসীলায় আসমান ও যমীনের অধিবাসী সকল সৃষ্টির উপর সাধারণভাবে নিয়ামত দান করেছেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর শুভজন্মে আনন্দ প্রকাশের উপকারিতা

সুওয়াইবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দুধ পান করিয়েছেন, যিনি আবূ লাহাবের আযাদকৃত দাসী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের সুসংবাদ দেওয়ার কারণে আবূ লাহাব তাকে আযাদ করে দিয়েছিলেন। আবূ লাহাবের মৃত্যুর পর জনৈক ব্যক্তি তাকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার অবস্থা কি? জবাবে আবূ লাহাব বলেন, আমি দোযখে আছি, তবে সোমবার রাতে আমার আযাব হালকা করা হয় এবং আমি এ দুটি আঙ্গুল থেকে পানি চোষতে পারি। এ কথা বলে তিনি নিজের দুটি আঙ্গুলের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, সুওয়াইবিয়া যখন আমাকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের সুসংবাদ দিয়েছিল এবং তাঁকে দুধ পান করিয়েছিল তখন আমি যে তাকে আযাদ করে দিয়েছিলাম সে কারণে আমি এ উপকার লাভ করছি।

ইবনুল জযরী বলেন, অবিশ্বাসী আবূ লাহাব, যার নিন্দায় কুরআন শরীফের আয়াত নাযিল হয়েছে, সেও যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের রাতে আনন্দিত হবার কারণে দোযখে থেকেও প্রতিদান লাভ করে তাহলে তাঁর উম্মতের অন্তর্ভুক্ত যে মুসলিম তাঁর শুভজন্মে আনন্দিত হয় এবং তাঁর ভালোবাসায় সাধ্যমতো খরচ করে আমার জীবনের কসম দয়াময় আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর প্রতিদান হলো, নিশ্চয়ই তিনি তাকে মহান অনুগ্রহে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।

রবিউল আউয়াল মাসে মুসলিম উম্মাহ’র আমল

মুসলমানগণ সর্বদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শুভ জন্মের মাসে মাহফিল করেন, সুস্বাদু খাবার তৈরি করেন, এ মাসের রাতসমূহে বিভিন্ন ধরনের দান-খয়রাত করেন, আনন্দ প্রকাশ করেন, বেশি পরিমাণে নেকীর কাজ করেন এবং তারা তাঁর পবিত্র জন্মের ইতিহাস পাঠের ব্যবস্থা করেন। এর বরকত হিসেবে তাদের উপর ব্যাপক অনুগ্রহ বর্ষিত হয়। এর অজ্ঞিতালব্ধ বিশেষ ফলাফল হলো, এটি সারা বছরের জন্য নিরাপত্তা এবং মনোবাসনা ও উদ্দেশ্য পূরণে দ্রুত সুসংবাদ লাভের মাধ্যম হয়। আল্লাহ সে ব্যক্তির উপর রহম করুন যে রবিউল আউয়ালের রাতসমূহকে ঈদ হিসেবে গ্রহণ করে, যাতে যাদের অন্তরে রোগ ও বক্রতা রয়েছে তা যেন আরো বৃদ্ধি পায়।

ইবনুল হাজ্জ মালিকী তদীয় ‘আল মুদখাল’ গ্রন্থে মীলাদ শরীফের কর্মসূচি পালন করতে যেয়ে মানুষ যে সকল বিদআত, মনগড়া বিষয় ও হারাম নিষিদ্ধ বাদ্যযন্ত্র দিয়ে গান বাজনা আবিষ্কার করেছে এর ভিত্তিতে অস্বীকার করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাকে তার নেক নিয়তের সওয়াব প্রদান করুন এবং সুন্নতের উপর আমাদের পরিচালিত করুন।  তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনিই উত্তম অভিভাবক।

হালীমা (রা.) এর তত্ত্বাবধানে প্রিয়নবী (সা.)

(পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সুওয়াইবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দুধ পান করিয়েছেন, যিনি আবূ লাহাবের আযাদকৃত দাসী ছিলেন) এরপর হযরত হালীমা সা’দিয়া (রা.) তাঁকে দুধ পান করানোর গৌরব ও সৌভাগ্য অর্জন করেন। তাবারানী, বায়হাকী ও আবূ নুআঈম প্রমুখের বর্ণনা অনুযায়ী হযরত হালীমা (রা.) বলেন, দুর্ভিক্ষের বছর আমি বনী সা’দ গোত্রের এক দলের সাথে দুগ্ধপায়ী শিশুর খোঁজে মক্কায় আসলাম। আমি আমার একটি গাধীর উপর সওয়ার হয়ে আসলাম। আমার সাথে আমাদের একটি শিশু আর একটি বুড়ো উটনী ছিলো।  আমার বুকে এতটুকু দুধ ছিলো না যা শিশুটিকে পরিতৃপ্ত করতে পারে আর উটনীর মধ্যেও এতটুকু দুধ ছিলো না যা তার খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পারে। আল্লাহর কসম, আমার জানামতো আমাদের মধ্যে এমন কোনো মহিলা ছিলো না যার নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পেশ করা হয়নি। কিন্তু তারা তাকে নিতে অস্বীকার করেছে যখনই শুনেছে যে তিনি ইয়াতীম। আল্লাহর কসম, আমি ছাড়া আমার সাথীদের সকলেই কোনো না কোনো শিশু সংগ্রহ করে নিলো। আমি যখন তাঁকে (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছাড়া আর কোনো শিশু পেলাম না তখন আমার স্বামীকে বললাম, কোনো শিশু না নিয়ে সাথীদের মধ্যে যেতে আমার খারাপ লাগছে। আমি ঐ এতীম শিশুটির নিকট যাব এবং অবশ্যই তাঁকে গ্রহণ করবো। আমি তাঁর নিকট গেলাম। তখন তিনি দুধের চেয়ে সাদা একটি কাপড়ে জড়ানো ছিলেন। তাঁর থেকে মিশকের খুশবু ছড়াচ্ছিলো। তার নিচে ছিলো সবুজ রেশমি বিছানা আর তিনি কাঁধের উপর শুয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাঁর সৌন্দর্য ও মাধুর্যের কারণে তাঁকে ঘুম থেকে জাগানোতে আমার করুণা হলো। ফলে আমি তাঁর একটু নিকটবর্তী হলাম এবং আস্তে আস্তে তাঁর বুকে হাত রাখলাম। তখন তিনি মুচকি হেসে দুচোখ খুলে আমার দিকে তাকালেন। আমি দেখলাম, তাঁর দুচোখ থেকে নূর বের হয়ে আকাশে গিয়ে প্রবেশ করলো। আমি তাঁর দুচোখের মাঝখানে চুমু খেলাম অতঃপর আমার ডান স্তন তাঁকে এগিয়ে দিলাম। তিনি তা থেকে ইচ্ছামতো দুধ পান করলেন। এরপর তাঁকে বাম দিকে ফিরালাম কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলেন। পরবর্তীতেও তাঁর এ অবস্থা ছিলো। উলামায়ে কিরাম বলেন, আল্লাহ তাআলা তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁর একজন দুধ ভাই আছেন। সুতরাং তার প্রতি ইনসাফের ব্যাপারে খেয়াল রাখুন। হালীমা (রা.) বলেন, তিনি ও তাঁর দুধ ভাই দুধ পান শেষ করলে আমি তাঁকে গ্রহণ করলাম এবং আমাদের কাফেলায় নিয়ে আসলাম। আমার স্বামী লক্ষ্য করলেন আমাদের বুড়ো উটনীর স্তন দুধে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। তিনি দুধ দোহন করলেন, নিজে পান করলেন, আমিও পান করলাম এবং আমরা পরিতৃপ্ত হলাম। আর আমরা এক উত্তম রাত কাটালাম। হালীমা (রা.) বলেন, এরপর লোকেরা একে অন্যের নিকট থেকে বিদায় নিলো আর আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মায়ের নিকট থেকে বিদায় নিলাম। এরপর আমি আমার গাধীর উপর আরোহন করলাম এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমার কোলে লইলাম। তখন লক্ষ্য করলাম, আমার গাধীটি কা’বার দিকে ফিরে তিনবার সিজদা করলো এবং এরপর আকাশের দিকে মাথা উঠিয়ে চলতো শুরু করলো। এমনকি এক পর্যায়ে আমার সাথীদের বাহনের আগে চলে গেলো। এতে তারা আশ্চর্যান্বিত হলো আর বলতে লাগলো, নিশ্চয় এর উচ্চ মর্যাদা রয়েছে। হালীমা (রা.) বলেন, আমরা সা’দ গোত্রে আমাদের বাড়িতে আসলাম। তখন আল্লাহর দুনিয়ায় এ এলাকার চেয়ে অধিক দুর্ভিক্ষ কবলিত কোনো এলাকা আছে বলে আমার জানা ছিলো না। তাঁকে নিয়ে আসার পর থেকে দেখলাম আমার বকরীগুলো প্রতিদিন বিকালে দুধে পরিপূর্ণ হয়ে ঘরে ফিরে আসছে। আমরা দুধ দোহন করি এবং পান করি। অথচ তখন অন্য কোনো মানুষ এক ফোটা দুধ দোহন করতে পারতো না এবং তাদের বকরীর স্তনেও কোনো দুধ পেতো না। আমাদের এলাকার লোকেরা তাদের রাখালদের বলতো, আবূ যুবায়বের কন্যার রাখাল যেখানে বকরী চরাও তোমরাও সেখানে বকরী চরাও। কিন্তু এরপরও তাদের বকরীগুলো বিকেলে উপোস অবস্থায় দুধশূন্য হয়ে বাড়ি ফিরতো আর আমাদের বকরীগুলো পরিতৃপ্ত ও দুধে পরিপূর্ণ হয়ে বাড়ি ফিরতো। হালিমা (রা.) এভাবে সর্বদা কল্যাণ ও সৌভাগ্য লাভ করতে থাকেন এবং উত্তম ও অধিক নিয়ামতের মাধ্যমে সফলতা লাভ করতে থাকেন।

لَقَدْ بَلَغْتْ با الْهَاشِمِيِّ حَلِيْمَةُ

مَقَامًا عُلَا فِيْ ذَرْوَةِ الْعِزِّ والْمَجْدِ

وَزَادَتْ مَوَاشِيْهَا وَأَخْصَبَتْ رَبْعُهَا

وَقَدْ عَمَّ هَذَا السَّعْدُ كُلَّ بَنِيْ سَعْدِ

-হাশিমী গোত্রে হালীমা সম্মান ও মর্যাদার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছেন। তাঁর জীবিকা বৃদ্ধি পেয়েছে আর প্রাণীগুলো হয়েছে সতেজ-সবল। সৌভাগ্যের ক্ষেত্রে তিনি  বনু সা’দের সকলকে অতিক্রম করে গেছেন।

ইবনুল র্জারাহ (রা.) বলেন, আমি আবূ আবদিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনিল মুআল্লা আল-আযদী (র.) এর ‘আত-তারকীস’ গ্রন্থে হালীমা (রা.) এর একটি কবিতা দেখেছি, যা আবৃত্তি করে তিনি নবী করীম (সা.) কে ঘুম পাড়াতেন। তা হলো:

يَا رَبِّ إِذْ أَعْطَيْتَهُ فَأبْقِهِ

وَأَعْلِهِ إِلَى الْعُلَا وَأرْقِهِ

وَأدْحِضْ أَبَاطِيْلَ الْعَدىٰ بِحَقِّهِ

-হে আমার প্রতিপালক! তুমি যখন তাঁকে আমায় দান করেছো তাঁকে বাঁচিয়ে রেখো। আর তাঁকে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ও উন্নত করো। তাঁর ওসীলায় শত্রæদের অপচেষ্টাকে দমন করো।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দুধবোন শায়মা তাঁকে কোলে নিতেন, ঘুম পাড়াতেন আর বলতেন:

هَذَا أَخٌ لِّيْ لَمْ تَلِدْهُ أُمِّيْ

وَلَيْسَ مِنْ نَسْلِ أَبِيْ وَعَمِّيْ

فَدَيْتُهُ مِنْ مُخَوِّلي مُّعِمِّيْ

فَأَنِمْهُ اللّٰهُمَّ فِيْمَا تَنْمِيْ

-এ আমার এমন ভাই, যে আমার মায়ের উদরজাত নয় আর আমার বাবা চাচার ঔরসজাতও নয়; তবুও আমি আমার মামা ও চাচাকে তাঁর সম্মানে উৎসর্গ করলাম। হে আল্লাহ! আপনি তাঁকে যথাযথরূপে প্রতিপালন করুন।

ইমাম বায়হাকী, সাবুনী, খতীব আল-বাগদাদী ও ইবনে আসাকির (র.) প্রমুখ হযরত আব্বাস ইবনে আবদিল মুত্তালিব (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনার দীন গ্রহণে আপনার নুবুওয়তের একটি নিদর্শন আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমি দেখেছি, দোলনায় আপনি চাঁদের সাথে কথা বলতেন, আপনি আপনার আঙ্গুলি দিয়ে যেদিকে ইশারা করতেন চাঁদ সেদিকে সরে যেতো! নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, আমি তার সাথে কথা বলতাম এবং সেও আমার সাথে কথা বলতো আর সে আমাকে কান্না থেকে ভুলিয়ে রাখতো। সে যখন আরশের নিচে সিজদাবনত হতো আমি তার আওয়াজ শুনতাম।

ইমাম সাবুনী (র.) বলেন, এ হাদীস সনদের দিক থেকে গরীব। তবে মুজিযার ক্ষেত্রে এর মতন (মূল ভাষ্য)  হাসান স্তরের।

ইমাম বায়হাকী ও ইবনে আসাকির (র.) বর্ণনা করেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হালিমা (রা.) বলতেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে যখন দুধ ছাড়িয়েছিলাম তখন প্রথম তিনি যে কথা বলেছিলেন তা হলো:

اَللهُ أَكْبَرُ كَبِيْرًا٬ وَّالْحَمْدُ لِلّٰهِ كَثِيْرًا٬ وَّسُبْحَانَ اللهِ بُكْرَةً وَّأَصِيْلًا.

-আল্লাহ সর্বমহান, সর্বাধিক প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আমি সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতার ঘোষণা করছি।

তিনি যখন তিনি একটু বড় হলেন তখন বাইরে যেতেন। কিন্তু খেলাধুলায় মগ্ন শিশুদের থেকে দূরে থাকতেন।

তিনি আরো বর্ণনা করেন, হযরত হালীমা (রা.) কখনো তাঁকে দূরে যেতে দিতেন না। একদিন তিনি তাঁর থেকে কিছুটা গাফিল ছিলেন। সেদিন দুপুর বেলা তিনি দুধবোন শায়মার সাথে চারণভ‚মির দিকে চলে গিয়েছিলেন। হালিমা (রা.) তাঁকে খুঁজতে বের হলেন এবং তাঁকে বোনের সাথে পেয়ে গেলেন। তখন তিনি বললেন, এমন প্রখর রৌদ্রতাপে বেরিয়ে পড়েছো? শায়মা বললেন, হে মা, আমার ভাইতো মোটেই রোদে হাটেননি। আমি দেখলাম, এক খন্ড মেঘ তাঁকে ছায়া দিচ্ছে। তিনি দাঁড়ালে তাও স্থির দাঁড়িয়ে যায় আর তিনি হেঁটে চললে তাও হাঁটতে শুরু করে। এ স্থান পর্যন্ত এভাবেই এসেছে।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্রুত বেড়ে উঠছিলেন যেরকম অন্যান্য শিশুরা সাধারণত বেড়ে ওঠে না। হালিমা (রা.) বলেন, প্রথম যখন তাঁকে দুধ ছাড়ালাম তখন আমরা তাঁকে নিয়ে তাঁর মা (আমিনা) এর কাছে গেলাম। তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত বরকতের কারণে আমার মন চাচ্ছিল তাঁকে যেন আরো কিছুদিন আমাদের কাছে রাখি। তাই তাঁর মায়ের সাথে কথা বলি। আমরা বলি, যদি তাঁকে আমাদের সাথে (আবার) দিয়ে দেন তাহলে তিনি আরও সুঠাম হয়ে উঠবেন। অন্যদিকে (এখানে থাকলে) আশঙ্কা করছি মক্কার রোগবালাই হয়তো তাঁকে পেয়ে বসতে পারে। অবশেষে তিনি তাঁকে আমাদের কাছে আবার দিয়ে দিলেন। আমরা তাঁকে নিয়ে ফিরে এলাম। (সংক্ষেপিত)

[হযরত শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)-এর

‘মা সাবাতা বিস সুন্নাহ ফী আয়্যামিস সানাহ’ গ্রন্থ থেকে অনূদিত।

অনুবাদক: প্রভাষক (আরবী), বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল (এম.এ) মাদরাসা]

শেয়ার করুন:
  • জনপ্রিয়
  • সাম্প্রতিক

নির্বাচিত

Don`t copy text!