অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানে প্রিয় নবীজী (সা.)-এর আদর্শ

 

মোস্তফা মনজুর

আদর্শ বা মডেল শুনলে নানা মনীষীর কথা আমাদের স্মৃতিতে জাগরিত হয়। যাঁরা মানবতাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন, চিন্তা-চেতনায় প্রভাবিত করেছেন কিংবা মানবকল্যাণে নিজ জীবন উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু স্থান-কাল ও পাত্র বিবেচনায় সার্বজনীনতা পেয়েছেন এমন মনীষী খুব কমই আছেন। কেউ হয়ত তাঁর যুগের জন্য আদর্শ ছিলেন, বর্তমানের এই প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের যুগে তাঁর মতবাদ অচল। আবার কেউ ছিলেন কোন স্থানের প্রেক্ষিতে মহামানব, অন্য স্থানে যার আবেদন নেই বললেই চলে। যাঁরা ব্যাপ্তি ও সময়ের উর্দ্ধে উঠেছিলেন তাঁদের মধ্যে আমাদের প্রিয় নবীজী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সর্বপ্রধান ও সর্বোত্তম। মাইকেল এইচ. হার্ট তাঁর The Hundred  গ্রন্থে এমন শত মনীষীর নাম এনেছেন যারা মানবতাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবান্বিত করেছিলেন। তাঁর এই তালিকায় আমাদের নবীর (সা.) নাম আছে সর্বাগ্রে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মহানবী (সা.) এর প্রভাব বা কৃতিত্ব মূল্যায়ন করা যেমন এক অসম্ভব ব্যাপার, তেমনই তাঁকে (সা.) কারো সাথে তুলনা করাও সাজে না। মহানবী (সা.) নিজেই ছিলেন নিজের তুলনা, সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুক- আল্লাহ তা‘আলার পরই যাঁর স্থান। তিনি (সা.) ছিলেন সর্বযুগের সর্বকালের জন্য মানবতার আদর্শ।

প্রশ্ন হতে পারে, কেমন ছিল তাঁর আদর্শ? সহজ ভাষায় কিংবা এককথায় বলা যায়, কল্যাণকর, যুগোপযুগী ও বাস্তবসম্মত। যিনি নিজেই ছিলেন ‘সারা বিশ্বের রহমত’ তাঁর আদর্শও রহমত ছাড়া আর কিইবা হবে! ইন্তিকালের প্রায় সাড়ে চৌদ্দশত বছর পরও তাঁর আদর্শ একেবারেই সজীব, সতেজ ও নতুন। তা ছিল, আছে এবং থাকবেও। মানব জীবনের এমন কোন দিক নেই যেখানে তাঁর সুন্দর আদর্শ ও দিক নির্দেশনা নেই। মানব জীবনের অন্যতম প্রধান দিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সম্পর্কেও রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্দর ও বাস্তবসম্মত দিক নির্দেশনা সমুজ্জ্বল। দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বৈষম্য দূরীকরণ, আর্থিক অনাচার-অত্যাচার রোধ, সুষ্ঠু ব্যবসা-বাণিজ্য নীতিমালার প্রয়োগ ইত্যাদি সামগ্রিক ক্ষেত্রে তাঁর নির্দেশনা আজও আমাদের পাথেয়। তিনি (সা.) নিজে যেমন এক্ষেত্রে আদর্শ ও উদাহরণ রেখে গেছেন, তেমনই দিয়ে গেছেন নৈতিক ও বিধানগত নির্দেশনা। কুরআন, হাদীস ও সীরাত বিশ্লেষণ করে উলামায়ে কিরাম রাসূলুল্লাহর (সা.) এর আদর্শ আমাদের সামনে উপস্থাপন করে গেছেন, লিখেছেন বইয়ের পর বই। সামান্য এই কলেবরে প্রিয় নবীর (সা.) অর্থনৈতিক দিক নির্দেশনার শতাংশও তুলে ধরা সম্ভব নয়। তারপরও কিছু মৌলিক বিষয়ের উল্লেখ আমাদের সুন্দর ও ন্যায়সম্মত অর্থনীতি পরিচালনায় আগ্রহী ও উৎসাহিত করে তুলতে পারে।

অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রধানত দু’ধরণের হয়ে থাকে। প্রথমত, সকল প্রকার অবৈধ ও অনৈতিক কর্মকাÐের মূলোৎপাটন; দ্বিতীয়ত, জনগণের সার্বিক আর্থিক কল্যাণার্থে কর্মকাÐ পরিচালনা। এ নিরাপত্তা যেমন নৈতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, তেমনই আইনগত বা বিধানগতভাবে বিদ্যমান। উভয়দিক থেকেই এ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে সার্বিকভাবে মানব কল্যাণ কখনোই সম্ভব নয়। রাসূলুল্লাহ (সা) এতদুভয় ক্ষেত্রেই উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।

সীরাত পর্যালোচনায় দেখা যায়, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যপ্তিতে মহানবী (সা.) এর জীবনকালকে আমরা দু’ভাগে বিভক্ত করতে পারি। নবুওয়াত প্রকাশের পূর্ব সময় ও নবুওয়াত প্রকাশের পরবর্তী কাল। নবুওয়াত প্রকাশের পূর্ব কালে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কার্যাবলীকে আমরা দু’ভাবে ভাগ করতে পারি। প্রথমত, তাঁর ব্যক্তিগত আদর্শ ও অর্থনৈতিক কর্মকাÐ। রাসূল (সা.) ছিলেন একাধারে দাতা, দয়ালু, পরোপকারী, অনাথ-দরিদ্রের আশ্রয়স্থল। গরীব, দুঃখী, অসহায় মুসাফির, মযলুম কেউই তাঁর সাহায্য-সহায়তা থেকে বঞ্চিত হতো না। দাস-দাসী, ইয়াতীম, অক্ষম ও পথশিশুদের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ দৃষ্টি। নবুওয়াত প্রকাশের সময় হযরত খাদীজা (রা.) এর উক্তি থেকে আমরা তাঁর (সা.) ব্যক্তিগত অনুশীলন সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারি। রাসূলকে (সা.) তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই আপনাকে লাঞ্চিত করবেন না; আপনি তো আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায় দুর্বলদের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন, মেহমানের আতিথেয়তা করেন ও দুর্দুশাগ্রস্থকে সহায়তা করেন’ (বুখারী)।      

দ্বিতীয়ত, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সামাজিক ও সামষ্টিক কার্যক্রম। এক্ষেত্রে আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে রাসূল (স) এর ব্যবসা সংক্রান্ত আদর্শের উল্লেখ করা যেতে পারে। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় সততা, মিথ্যা-প্রতারণার আশ্রয় না নেওয়া, শ্রমের যথাযথ মূল্য প্রদান, সকল প্রকার শ্রমকে উৎসাহ দান, পণ্য আদান প্রদান ও লেনদেনে উদারতার প্রকাশ, ক্ষতিপূরণ দান ইত্যাদি বিষয়ের বাস্তবায়ন মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে। তাছাড়া তিনি (সা.) ছিলেন আল আমীন। সততা, বিশ্বস্ততা ও আমানতদারিতার জন্য তিনি (সা.) নানাজনের, এমনকি কাফির ও বিপক্ষীয় লোকদেরও, সম্পদের রক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন; যেন তিনি (সা.) একাই ছিলেন জাহিলী যুগের একমাত্র ব্যাংক, একমাত্র নির্ভরযোগ্য আমানতদার প্রতিষ্ঠান। অন্যায়-অত্যাচার আর নীতি-নৈতিকতাহীন স্রোতের বিপরীতে তিনিই (সা.) ছিলেন মানব সমাজে অর্থনৈতিক সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

জাহেলি যুগে আর্থিক অনাচার প্রতিরোধে তাঁর (সা.) একটি বিশেষ উদ্যোগের কথা আমরা সবাই জানি। ‘হিলফুল ফুযুল’ প্রতিষ্ঠা ও এর মাধ্যমে সমাজের নানা অনিয়ম, অনাচার প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগ সে সময়ে সারা বিশ্বের আর্থ-সামাজিক পরিমÐলে শুধু বিরলই নয়, বরং অদ্বিতীয়ই বলা চলে। এ সংগঠনের শর্তসমূহের মধ্যে ছিল, হকদারদের হক যথাযথভাবে পৌঁছে দেওয়া এবং কোনো যালিম যেন মযলুমের ওপর প্রাধান্য লাভ করতে না পারে এর নিশ্চয়তা বিধান করা [নবীয়ে রহমত, সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (র.)]। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানে সে অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়েও প্রিয়নবী (সা.)-এর এমন উদ্যোগ তাঁর মানবকল্যাণমূখী মানসিকতারই প্রমাণ।

নবুওয়াত পরবর্তী সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কর্মকাÐ অনেকটা প্রশাসনিক রূপ লাভ করে। ইসলামের নানা আহকাম (বিধি বিধান) এর প্রবর্তন ও নবগঠিত মদীনা রাষ্ট্রের নিয়ম-শৃঙ্খলা বিধানে রাসূল (সা.) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিরাট বিপ্লবের সূচনা করেন। সর্বপ্রকার অন্যায়, অবিচার, অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি (সা.) সর্বাত্মকভাবে রুখে দাঁড়ান। তিনি সুদ, জুয়া, ঘুষ, মজুদদারী, প্রতারণা, ওজনে কম দেওয়া, ফটকাবাজি, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিসহ সবরকমের আর্থিক দূর্নীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। শুধু ইসলামী রাষ্ট্রেই নয়, বরং যে কোন সমাজে যে কোন মুসলিমের জন্যই তা নিষিদ্ধ হিসেবে বিবেচিত। পাশাপাশি তিনি (সা.) বৈষম্য দূরীকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সকলের জন্য সুযোগ ও অংশগ্রহণের সমতাসহ নানাবিধ যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শুধু রাসূল হিসেবেই নয়, একজন সংস্কারক বা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও তাঁর এসব কর্মকান্ড আদর্শ হিসেবে সর্বকালের জন্য বিবেচ্য হতে পারে। 

মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানে তিনি যেসব পন্থা প্রচলন করেছিলেন তন্মধ্যে ‘যাকাত’ ব্যবস্থা ছিল সর্বাগ্রে। দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থের সঞ্চালন ও গতিশীলতা আনয়ন এবং সর্বোপরি বৈষম্য ও শ্রেণি সংঘাত দূরীকরণে ‘যাকাত’ একটি অনুপম ও কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে প্রমাণিত হয়। গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে ‘যাকাত’কে ইসলামের পঞ্চভিত্তির তৃতীয় ভিত্তি হিসেবেই ঘোষণা করা হয়। আল কুরআনে এ সম্পর্কিত নানাবিধ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে; যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “তোমরা সালাত কায়েম কর এবং যাকাত আদায় করো” (দ্রষ্টব্য: সূরা বাকারাহ: ৪৩; সূরা নিসা: ৭৭; সূরা নূর: ৫৬; সূরা আহযাব: ৩৩, সূরা মুয্যাম্মিল: ২০)। এছাড়াও আল কুরআনে আরও বহু আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাকাতের পরিশুদ্ধতা (সূরা তাওবা: ১০৩), ফযীলত (সূরা রূম: ৩৯), যাকাত না দেয়ার ভয়ংকর পরিণাম (সূরা হামীম: ৬-৭) উল্লেখ করেছেন। সামষ্টিক পর্যায়ে যাকাত দেওয়ার সুন্দর নীতিমালা বর্ণনা করেও আল্লাহ তা‘আলা আয়াত নাযিল করেছেন (সূরা আম্বিয়া: ৭৩; সূরা হজ্ব: ৪১), যেন এর দ্বারা পরিকল্পিত উপায়ে মানুষ তাদের নিজেদের আর্থসামাজিক কার্যকলাপ পরিচালনা করতে পারে। এমনকি বণ্টনের খাত নির্ধারণ করে দিয়ে দারিদ্য বিমোচনের প্রধান ও কার্যকর মাধ্যম হিসেবে যাকাতকে উপস্থাপন করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল ইয্যত বলেন, “সাদাকা তো পাওনা হলো দরিদ্র ও অভাবীগণের, যে সকল কর্মচারীর উপর আদায়ের ভার আছে তাদের, যাদের মন সত্যের প্রতি স¤প্রতি অনুরাগী হয়েছে, গোলামদের মুক্তির জন্যে, ঋণগ্রস্তদের জন্যে, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্যে। এটি আল্লাহর তরফ হতে ফরয এবং আল্লাহ সব জানেন ও সব বুঝেন” (সূরা তাওবা: ৬০)।

আল্লাহ তাআলার নির্দেশনা অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত সুন্দর ও সুচারুভাবে যাকাত আদায় ও বণ্টনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি (সা.) রাষ্ট্রীয়ভাবে ধনীদের নিকট থেকে যাকাত আদায় করে গরীবদের কাছে পৌঁছে দিতেন।  এজন্য রাসূলে করীম (সা) ও পরবর্তীতে তাঁর অনুসারী খুলাফায়ে রাশিদীন (রা.) যাকাত ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন। এ দপ্তরের কাজ ছিল যাকাতের অর্থ সামগ্রী ও গবাদি পশু সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণ। এজন্য আট শ্রেণির লোক নিযুক্ত করা হতো; যেমন- সায়ী (গবাদি পশুর যাকাত সংগ্রাহক), কাতিব (খাতাপত্র লেখার করণিক), কাসসাম (বন্টনকারী), আশির (যাকাত প্রদানকারী ও যাকাত প্রাপকদের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনকারী), আরিফ (যাকাত প্রাপকদের অনুসন্ধানকারী), হাসিব (হিসাব রক্ষক), হাফিয (অর্থ ও দ্রব্যসামগ্রী সংরক্ষক), ও  কায়াল (যাকাতের পরিমাণ নির্ণয়কারী ও ওযনকারী) [এস. এ. সিদ্দিকী, পাবলিক ফিন্যান্স ইন ইসলাম]।

যাকাতের পাশাপাশি রাসূল (সা.) ফল-ফসলের যাকাত, যা উশর নামে পরিচিত, প্রদানেরও বিধান প্রচলন করেন।  আল কুরআনের নির্দেশনা (সূরা আনআম: ১৪১, সূরা বাকারাহ: ১৬৭) অনুসারে উশরের বিধান বর্ণনা করে রাসূলে করীম (সা.) বলেন-“যে সব জমি বৃষ্টির পানিতে সিক্ত হয় তাতে উশর (দশ ভাগের একভাগ) আর যেসব জমি সেচের সাহায্যে সিক্ত হয় তাতে নিসফ উশর (বিশ ভাগের একভাগ) আদায় করতে হবে” (বুখারী, আবূ দাউদ)। বস্তুত রাসূলুল্লাহ (সা.) এর এই বিধানের কার্যকারিতা এমনই ছিল যে, মাত্র সাত থেকে আট দশকের মধ্যেই, উমর ইবনু আবদিল আযীযের (র.) শাসনামলে আরবে যাকাত দেওয়ার মত দরিদ্র খুঁজে পাওয়া যায়নি।  

অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানকল্পে রাসূল (সা.) বেশ কিছু নতুন নীতিমালার উদ্ভাবন করেন। ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় যেগুলো ইসলামের স্বকীয় অবদান হিসেবেই স্বীকৃত। যেমন, দান-সাদাকা, হাদিয়া, হেবা, ওয়াকফ, ওসীয়্যাত ব্যবস্থা ইত্যাদি। এছাড়া মানুষের মারা যাওয়ার পর পরিত্যক্ত সম্পত্তির বণ্টনের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও বাস্তবসম্মত নির্দেশনা স্বরূপ মীরাসী আইন প্রবর্তনও রাসূল (সা.) এর মানবিক আদর্শের প্রমাণ।

তাছাড়া সামাজিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে রাসূল (সা.) নানা শ্রেণির মানুষ, যেমন- শ্রমিক, প্রতিবেশী, অমুসলিম, ব্যবসায় অংশীদার প্রমুখদের হক আদায়ের জন্য বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি পেট পুরে খায়, আর পাশেই তার প্রতিবেশী অভূক্ত অবস্থায় রাত কাটায়, সে মু’মিন নয় (বাযহাকী ও তাবরানী)। তিনি আল কুরআনের বাণী- ‘আর ধন সম্পদ দান করবে আল্লাহর ভালোবাসায়, ইয়াতিম, অভাবী, নিঃস্ব পথিক, সাহায্যপ্রার্থী ও দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ লোকদের মুক্তির জন্যে, এতে পূণ্য রয়েছে’ (সূরা বাকারা: ১৭৭) বাস্তবায়নে খুবই গুরুত্বারোপ করেন। ফলে পরবর্তীতে তাঁরই (সা.) আদর্শ অনুসরণ করে খুলাফাগণ অসুস্থ, বৃদ্ধ, অক্ষম, প্রতিবন্ধী, বেকার ইত্যাদি শ্রেণির মানুষদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা, কর মওকুফ, বিশেষ চিকিৎসা সেবা ইত্যাদিরও প্রচলন করেন। সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতকল্পে রাসূল (সা.) এর আরও একটি অন্যতম পদ্ধতি ছিল করজে হাসানা। সুদী সমাজের ভয়াবহতা লক্ষ্য করে প্রিয় নবী (সা.) এ করজে হাসানা পদ্ধতিতে ঋণদান ও আর্থিক সাহায্যের পথ সুগম করেন। এতে সুদের কুফল থেকে মানুষ মুক্তি লাভ করে ও পারস্পরিক হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায়।

শুধু অর্থনৈতিক কাজের মাধ্যমেই নয় বরং নীতিগত ও তাত্ত্বিকভাবেও তিনি মানব জীবনের অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছেন। নিজে সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবন যাপনে অভ্যস্ত হলেও রাসূল (সা.) দরিদ্রতার কুফল ও ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে উম্মতকে সতর্ক করেছেন। নানা হাদীসের মর্মকথায় এটি পরিষ্কার যে, দারিদ্র মানুষকে কুফরীর পর্যায়ে নিয়ে যায়। এজন্য প্রিয় নবীজী (সা.) নিজে দরিদ্রতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন। তিনি বলতেন, আল্লাহুম্মা ইন্নী আ‘উযুবিকা মিনাল কুফরী ওয়াল ফাকরী- হে আল্লাহ আমি কুফর ও দারিদ্র্য থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি (আবূ দাউদ, আহমদ)।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি জাহিলী ও বস্তুবাদী বিশ্বাসের আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি ব্যক্তি মালিকানার স্বেচ্ছাচারিতা থেকে মুক্ত করে সকল কিছুর প্রকৃত মালিকানা মহান আল্লাহর বলে ঘোষণা করেন। আর মানুষকে আল্লাহ তাআলার খলীফা হিসেবে ব্যবহারিক মালিক হিসেবে পরিচয় দান করেন। তিনি তাকদীরে বিশ্বাস, তাওয়াক্কুল, রিযকের পূর্বনির্ধারণের ধারণা ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক হতাশা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার পথনির্দেশ করেছেন। পাশাপাশি মানুষকে শ্রম ও উপার্জনের জন্যও নানাভাবে নির্দেশনা প্রদান করেছেন। একটি ঘটনা আমরা সবাই জানি, একদা এক গরীব লোক প্রিয় নবীজীর (সা.) নিকট সাহায্য চাইলে তিনি লোকটির নিকট যা আছে তা নিয়ে আসতে বলেন। লোকটি তাঁর একমাত্র সম্বল একটি কম্বল নিয়ে আসে। তখন রাসূল (সা.) তাকে কম্বলটি বিক্রি করে অর্থ যোগাড় করে তা দিয়ে কুঠার কিনে আত্ম-কর্মসংস্থানমূলক কাজে নিয়োজিত হতে উপদেশ দিলেন। নবীজী (সা.) এর পরামর্শে লোকটি একটি কুড়াল কিনে কাঠ কেটে এনে বাজারে বিক্রি করে সে অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন। ফলে লোকটির দারিদ্র্য ঘুচে যায়। এটাই ছিল মহানবীর (সা.) আদর্শ। আত্মমর্যাদার সাথে কাজ করা, তা যত ছোটই হোক না কেন, নবীজী (সা.) পছন্দ করতেন। অন্যদিকে ভিক্ষা করা, সক্ষম হয়েও কারো কাছে হাত পাতা কিংবা সাহায্য কামনা করা তিনি খুবই অপছন্দ করতেন। তিনি (সা.) বলেছেন, যে হাত পাতে অথচ তার নিকট এমন সম্বল রয়েছে যা তাকে এ থেকে বাঁচাতে পারে, সে নিশ্চয় আগুন সংগ্রহ করেছে (আবূ দাউদ)। এভাবে মহানবী (সা.) ইসলামের মানবতাবাদী অর্থনৈতিক দর্শন আমাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।

প্রকৃতপক্ষে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মানবতার মহান আদর্শ। মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে তাঁর প্রদর্শিত নীতি-পদ্ধতি, নৈতিক শিক্ষা, বিধানাবলী সবই এককথায় কল্যাণকর। প্রায় সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বে তিনি (সা.) যে ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন, তা এখনকার সভ্য সমাজেও বিস্ময়কর। শুধু দারিদ্র্য বিমোচন নয় বরং সকল মানুষেরই অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানে যে তিনি অতুলনীয় উপমা দেখিয়েছেন তাঁর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন আমাদের এই সমস্যা সংকুল সমাজেও শান্তি ও মুক্তির বাণী ছড়িয়ে দেবে নিঃসন্দেহে। এজন্য, প্রথমে দরকার তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ ভালোভাবে জানা, অতপর সে শিক্ষা নিজ জীবনে, সমাজে, সর্বস্তরে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা। আর এর মাধ্যমেই দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বিক কল্যাণ অর্জন করা সম্ভব। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর রাসূলের (সা.) পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]

শেয়ার করুন:
  • জনপ্রিয়
  • সাম্প্রতিক

নির্বাচিত

Don`t copy text!