দুরূদ শরীফ : নাজাতের ওসীলা
নূর মোহাম্মদ তালুকদার
আহমদ মুজতাবা, মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর প্রতি দুরূদ শরীফ পাঠের জন্য মহান রাব্বুল আলামীনের নির্দেশ এবং ইহা পাঠের বরকত ও উপকারিতা প্রসঙ্গে অনেক বাণী উচ্চারিত হয়েছে। স্বয়ং রহমাতুল্লীল আলামীনের পবিত্র যবান হতে। নবী প্রেমিকগণ ইহজীবন ও পরজীবনে নাজাত লাভ করেছেন দুরূদ শরীফের মাধ্যমে। পবিত্র দুরূদ পাঠের প্রতি আমাদের আগ্রহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে পূর্ববর্তীদের উপকৃত হওয়ার কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
১. বনি ইসরাঈলের জনৈক গুনাহগার ব্যক্তির ইন্তিকাল হলে লোকেরা অবজ্ঞাভরে তার লাশ আবর্জনার স্ত‚পে নিক্ষেপ করলো। এতে আল্লাহ পাক ওহী পাঠালেন, হে মূসা! এই ব্যক্তিকে সেখান থেকে তুলে এনে গোসল দাও এবং জানাযার নামায পড়। মুসা (আ.) আরজ করলেন, হে আল্লাহ! এ লোকটি আজীবন তোমার নাফরমানী করেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা বললেন হ্যা, তাই করেছে। কিন্তু সে যখন তাওরাত কিতাব খুলতো এবং মুহাম্মদের নামের উপর তার দৃষ্টি পড়তো, তখন সেটিতে ভক্তি ভরে চুম্বন করতো, তার উপর চোখ রাখতো এবং তাঁর প্রতি দুরূদ প্রেরণ করতো। আমি তার এ আমল কবূল করে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। ৭০জন হুরও তার বিবাহে দান করেছি। (খাসায়েসুল কুবরা)
২. হযরত ইমাম শাফিঈ (র.)-এর ইন্তিকালের পর একাধিক বুযুর্গ ব্যক্তি তাঁকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ পাক আপনার সাথে কি ব্যবহার করেছেন, তিনি জবাব দিলেন, আল্লাহ পাক আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আমার জন্য বেহেশত এমনভাবে সজ্জিত করেছেন, যেমন নববধুকে সজ্জিত করা হয়। জানতে চাওয়া হলো, কোন কাজের জন্যই এই মর্যাদা? বলা হলো দুরূদ শরীফের ওসীলায়। অপর বর্ণনায় উল্লেখ আছে, আল্লামা ইবনে জওযী (র.) বলেন, ইমাম শাফীর ইন্তিকালের পর আমি রাসূলে করীম (সা.)-কে স্বপ্নে দেখে আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইমাম শাফিঈ ইন্তিকাল করেছেন, মৃত্যুর পর তিনি আপনার পক্ষ থেকে বিশেষ কোন পুরস্কার লাভ করেছেন কি? হুযূরে পাক (সা.) ইরশাদ করলেন, হ্যাঁ, আমি আল্লাহর নিকট দু‘আ করেছি, হাশরের দিন যেন তাঁকে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়া হয়। আমি আবার জানতে চাইলাম, কোন আমলের দরুণ তিনি এত বড় সৌভাগ্য লাভ করলেন? শাফিয়ে মাহশার (সা.) বললেন- সে আমার প্রতি এমন একটা দুরূদ পাঠ করতো, যা আজ অবধি অন্য কেউ পাঠ করে নি। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, ঐ দুরূদটা কি? নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন- আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা মুহাম্মাদিন কুল্লামা যাকারাহুজ যাকিরুন ওয়া সাল্লি আলা মুহাম্মদ কুল্লামা গাফালা আন যিকরিহিল গাফিলুন।
৩. জনৈক গরীব ধার্মিক ব্যক্তি তিন হাজার দীনার ঋণ ছিলেন। ঋণ পরিশোধে তিনি অক্ষম হয়ে পড়ায় ঋণদাতা আদালতের শরণাপন্ন হলো। কাজী সাহেব ঋণ গৃহীতাকে আল্লাহ ওয়ালা দেখে এক মাসের সময় দিয়ে দিলেন। সে ব্যক্তি আদালত থেকে ফিরে এসে ঋণ আদায়ের প্রচেষ্টায় নতুনভাবে আত্মনিয়োগ করলো এবং সাথে সাথে দু’জাহানের সম্রাটের প্রতি দুরূদ পাঠ করতঃ আল্লাহ পাকের দরবারে আহাজারি করতে লাগল। এভাবে গত হয়ে গেলো ২৬দিন কোন সংস্থান হলো না ঋণ পরিশোধের। তারপর ২৭ তারিখের রাতে স্বপ্নে নবী করীম (সা.)-এর দীদার নসীব হলো। তিনি তাঁর অসহায় উম্মতকে বললেন, তুমি উযীর আলী ইবনে ঈসার কাছে যাও এবং বল, ঋণ পরিশোধের লক্ষ্যে আমাকে তিন হাজার দীনার দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। সেই পরহেজগার ব্যক্তি বলেন, যখন আমি জাগ্রত হলাম, তখন নিজের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্যের ভাব অনুভব করলাম। কিন্তু মনে সন্দেহ দেখা দিলো এই বলে যে, যদি উযীর এই আদেশের প্রমাণ চান, তবে কি বলবো? এরূপ চিন্তা করে সেদিন উযীরের কাছে গেলাম না। দ্বিতীয় রাত্রিতে পুনরায় সেই স্বপ্ন দেখে অত্যন্ত আনন্দিত মনে জাগ্রত হলাম। কিন্তু মানবসূলভ দুর্বলতাবশতঃ আজও আলী ইবনে ঈসার নিকট যেতে পারলাম না। তৃতীয় রাত্রিতে আবার দেখলাম, প্রিয়নবীজী (সা.) আমাকে না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করছেন, আরজ করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে কোন প্রমাণ চাই। এ কথা শুনে হুযূরে পাক (সা.) আমাকে ধন্যবাদ দিলেন এবং বললেন যদি সে তোমার কাছে প্রমাণ চায়, তবে বলে দিয়ো, আপনি প্রতিদিন ফজরের নামাযের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত কারও সাথে কথা বলার পূর্বে পাঁচ হাজার বার দুরূদ শরীফের উপহার রাসূলে করীম (সা.)-এর নিকট প্রেরণ করেন। এ সংবাদ পৃথিবীর কোন ব্যক্তি জানে না। এরপর জাগ্রত হয়ে আমি উযীরের কাছে গিয়ে স্বপ্নের কাহিনী প্রমাণসহ বর্ণনা করলাম। বিবরণ শুনে তিনি আবেগে আপ্লূত হয়ে বললেনঃ প্রিয়নবীজী (সা.)-এর দূতকে আন্তরিক মুবারকবাদ। অতঃপর তিনি আমাকে তিন হাজার দীনার দিয়ে বললেন, এগুলো দিয়ে ঋণ শোধ করবেন। এরপর আরও তিনহাজার দীনার দিয়ে বললেন এগুলো নিজের পরিবার পরিজনের জন্য ব্যয় করবেন, এ ছাড়া আবারও তিন হাজার দীনার বললেন-এগুলো ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়োজিত করবেন। তারপর উযীর আমাকে কসম দিয়ে বললেন আমাদের মধ্যকার মহব্বতের সম্পর্ক কখনও ছিন্ন করবেন না। আপনার যখন যা প্রয়োজন হবে, আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন। অতঃপর আমি কাযীর নিকট গেলাম, যাতে তার সামনে ঋণ পরিশোধ করি। তখন দেখলাম ঋণদাতা উদ্বিগ্ন হয়ে কাযীর দরবারে উপস্থিত হলো। আমি তিন হাজার দীনার গণনা করলাম এবং কাযীর প্রশ্নের জবাবে আদ্যেপান্ত ঘটনা তাদেরকে শুনিয়ে দিলাম। বর্ণনা শুনে কাযী সাহেব বললেন, এই মাহাত্ম উযীরকে দেয়া হবে কেন? আমিই এঋণ তোমার পক্ষ থেকে শোধ করে দিচ্ছি। একথা শুনে কর্জদাতা বলে উঠলেন। এ ব্যাপারে উযীর এবং আপনার চেয়ে আমিই অধিক হকদার। অতএব আপনাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে আমি তাঁকে মাফ করে দিলাম। কাযী পুনরায় বললেন, আল্লাহ ও রাসূলের জন্য যা দিতে মনস্ত করেছি, তা আমি আর ফিরিয়ে নেবো না। এরপর সমস্ত ধন-সম্পদ নিয়ে আমি আনন্দিত মনে বাড়ি ফিরে আল্লাহ পাকের নিয়ামতের অসংখ্য শুকরিয়া আদায় করলাম। (জযবুল কুলূব ইলা দিয়ারিল মাহবূব)
৪. মূসা যরীর (র.) নামক এক বুযুর্গ ব্যক্তি বলেন- একবার সামুদ্রিক সফরে আমাদের জাহাজ প্রচন্ড ঝড়-তুফানে পতিত হয়। এমন ঝড়ে সাধারণতঃ কোন জাহাজই দুর্ঘটনার কবল থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়। তখন ভীত সন্ত্রস্ত যাত্রীদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেলো। চরম নৈরাশ্যের মধ্যে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে আমিও মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে লাগলাম। এ অবস্থাতেই একটু তন্দ্রাছন্ন হলে পর স্বপ্নে দেখলাম, ইমামুল আম্বিয়া (সা.) আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন জাহাজের আরোহীগণকে দুরূদ তুনাজ্জীনা এক হাজার বার পাঠ করতে বলো। সাথে সাথে চোখ খুলে গেলো এবং সকলকে জানিয়ে দিলাম প্রিয় নবীজীর নির্দেশের কথা। ব্যাকুলভাবে সবাই সেই দুরূদ শরীফ পাঠ করতে শুরু করলো। মাত্র তিনশ বার পড়ার পরই আবহাওয়া স্বাভাবিক হয়ে আমাদের জাহাজ সম্পূর্ণ বিপদ মুক্ত হয়ে গেলো। (ফাদ্বায়েলে দুরূদ শরীফ)
৫. বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি হজ্জের তওয়াফ সায়ী ও অন্যান্য কর্মে নির্দিষ্ট দু‘আর পরিবর্তে দুরূদ শরীফ পাঠ করতে লাগলো। মানুষ তাকে দুআ পরিত্যাগ করে দুরূদ পড়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বললোঃ আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, নফল ইবাদতসমূহের মধ্যে যতক্ষণ সম্ভব দুরূদ শরীফই বেশী করে পড়বো। এর কারণ এই যে, আমার পিতার ইন্তিকাল হয়েছিলো সফরে রাতের বেলায়। মৃত্যুর পর লক্ষ্য করলাম, তাঁর মুখমন্ডল বিকৃত হয়ে বীভৎস গাধার চেহারা ধারণ করেছে। এতে আমি খুবই মর্মাহত হলাম এবং কাপড় দ্বারা মুখ ঢেকে নিলাম। ইতিমধ্যে আমার নিদ্রা এলো। তখন স্বপ্নে দেখলাম, উত্তম পোষাক পরিহিত এক জ্যোতির্ময় পুরুষ এসে আমার পিতার মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে তার মুখের উপর হাত বুলিয়ে দিলেন, তখন চেহারা স্বাভাবিক হয়ে গেলো। এ মহাপুরুষ প্রস্থাপনের জন্য উদ্যত হলে আমি তাঁর আচল ধরে কৃতজ্ঞচিত্তে নিবেদন করলাম, আপনি কে? তিনি বললেন- আমি আল্লাহ পাকের প্রেরিত রাসূল। প্রিয়নবীজী (সা.) আরো বলেন- তোমার পিতা ছিলো সুদখোর, মৃত্যুর পর থেকে সুদখোরদের উপর এধরনের আযাবই হয়ে থাকে। তবে তোমার পিতা প্রত্যহ নিদ্রার পূর্বে আমার প্রতি অন্ততঃ একশবার দুরূদ শরীফ পাঠ করতো। তাই আমি আজকের এই মুসীবতে হাযির হয়েছি এবং ঐ ব্যক্তির আর্তনাদে আমি সাড়া দেই, যে আমার উপর অধিক পরিমাণে দুরূদ পাঠ করে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙ্গে গেলো, আমি তাকিয়ে দেখলাম বাবার চেহারা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে পূর্ণিমার চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করছে। (এইয়াউল উলূম)
৬. এক ব্যক্তি বিশাল মরুভ‚মিতে একাকী সফর করছিলো। হঠাৎ তার সওয়ারী জানোয়ার পা ভেঙ্গে গেলো। লোকটা এ জনমানবহীন প্রান্তরে একেবারে নিরুপায় হয়ে একান্ত মনে হুযূরে পাক (সা.)-এর প্রতি দুরূদ শরীফ পড়তে লাগলো। কিছুক্ষণ এভাবে অতিবাহিত হলে পর সে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লো এবং দেখতে পেলো যে, তিনজন লোক অপর দিক থেকে এসে তার সামনে থেমেছেন। তন্মধ্যে একজন একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং দুজন এসে সোয়ারীর পায়ে কি যেন প্রয়োগ করে একেবারে আরোগ্য করে দিলেন। নিঃসঙ্গ এ মুসাফির তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে বিনীতভাবে তাঁদের পরিচয় জানতে চাইলো। সামনের দু’জন পরিচয় দিলেন যে, তাঁরা ইমাম হাসান ও হোসাইন (র.) আর অনতি দূরে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি তাঁদের নানাজান আল্লাহর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সা.)।
স্বপ্নযোগে রাসূলুল্লাহ (সা.) এ আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তি লাভ করার অন্যতম মাধ্যম দুরূদ শরীফ। তাই আমরা যেন বেশী পরিমাণে দুরূদ শরীফ পাঠের আমল করতে পারি। আর এটা যেন হয় আমাদের নাজাতের ওসীলা। রাব্বুল আলামীনের দরবারে এই দু‘আ।