তাসনীম বিডি ডেস্ক: মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসবসমূহের মধ্যে অন্যতম প্রধান উৎসব হচ্ছে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শুভ জন্ম উৎসব তথা ঈদে মীলাদুন্নবী। এ উৎসব বিভিন্ন দেশে মীলাদ, মাওলিদ, মেভলিদ প্রভৃতি নামে পরিচিত। শিয়া ও সুন্নী মুসলমানদের মধ্যে ঈদে মীলাদুন্নবীর তারিখ নিয়ে ভিন্নমত থাকলেওপ্রায় সকল মুসলিম দেশেই সাড়ম্বরে এ উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে, পাশপাশি যে সকল অমুসলিম দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠী বসবাস করেন, সেসব দেশেও ঈদে মীলাদুন্নবী সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়।
তুরস্কে ঈদে মীলাদুন্নবী উপলক্ষে সরকারি ছুটি পালন করা হয়। মীলাদুন্নবীর রাতে তুরস্কের মসজিদে মসজিদে এবং বাসা-বাড়িতে না’তে রাসূল পাঠ করে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করা হয়। এ বছর করোনার কারণে কোন সাড়ম্বরে অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় সে দেশের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েব এরদোগান বিগত বছরে অনুষ্ঠিত মীলাদুন্নবীর মাহফিলের ভিডিয়ো টুইট করে ভার্চুয়ালি মীলাদুন্নবী উদযাপন করেন, যেখানে তিনি বিখ্যাত তুর্কি কবি আলি উলভি কুরুচুর লেখা নাতে রাসূল আবৃত্তি করছিলেন।
তিউনিসিয়ায় ঈদে মীলাদুন্নবী উপলক্ষে জাতীয় ছুটি রয়েছে। এ দিনে স্কুল, ব্যাংক এমনকি বেশির ভাগ ব্যাবসায় প্রতিষ্ঠানও বন্ধ থাকে। তিউনিসরা সাধারণত এ দিনে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী মিলে উৎসবের আমেজে মীলাদুন্নবী উদযাপন করে থাকে। রাসূল (সা.) এর শানে বিভিন্ন কবিতা পাঠ করে, রাসূলুল্লাহর জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা করে। মীলাদুন্নবী উপলক্ষে তিউনিসিয়া বিশেষ ধরনের মিষ্টান্ন প্রস্তুত করা হয়, যা আসিদাহ যাগুগু (عصيدة الزقوقو) নামে পরিচিত। বিস্তারিত দেখুন এখানে।
মিসরে গুরুত্বের সাথে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপিত হয়ে থাকে। সে দেশের প্রধান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব শায়খুল আজহার এবং গ্র্যান্ড মুফতি উভয়েই মীলাদুন্নবী উদযাপনে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এ উপলক্ষে মিসরীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। গত বছর আল আজহারে সালেহ আল-জাফরী মসজিদ থেকে জামালিয়া এলাকায় আল আজহার প্রধানের কার্যালয়ে অভিমুখে র্যালি করে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করা হয়।
এ বছর করোনার কারণে কায়রোতে মীলাদুন্নবী উপলক্ষে র্যালি কিংভা অন্য কোন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে দেওয়া হয়নি। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে এ বছরও রাষ্ট্রপতি, শায়খুল আজহার, গ্র্যান্ড মুফতিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব উপস্থিতিতে মীলাদুন্নবী উদযাপন হয়েছে।
ইয়েমেনের বিভিন্ন অঞ্চলে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্য রয়েছে। তবে সবচেয়ে ঝাকজমকের সাথে মীলাদুন্নবী উদযাপন হয় পশ্চিমাঞ্চলে। সেখানে মীলাদুন্নবীকে বলা হয় ঈদে লাইলাতি নূর। এ রাতে ইয়েমেনের সর্বস্তরের মানুষ মসজিদে একত্রিত হয়ে কুরআন তিলাওয়াত, রাসূল (সা.) এর জীবন বৃত্তান্ত বা সীরাত সম্পর্কে আলোচনা,
যিকির-আযকার ইত্যাদি ধর্মীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে মীলাদুন্নবী উদযাপন করে। পরের দিনেও সরকারি ছুটি থাকে, এবং সারা দিন চলতে থাকে রাসূল (সা.) এর শানে না’ত পরিবেশন, যিকির-আযকার, রাসূল (সা.) এর জীবনী ও তাঁর মুজিযাসমূহ সম্পর্কে আলোচনা। এভাবে যথাযথ মর্যাদায় ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে ইয়েমেনে ঈদে মীলাদুন্নবী বা ঈদে লাইলাতুন নূর উদযাপিত হয়। সাথে থাকে বিশেষ ধরনের খাবার-দাবারেরও আয়োজন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন এই লিংকে।
ইরাকিদের দাবি, তাদের মাওলিদ উদযাপন অন্য সকলের চেয়ে ভিন্ন। কারণ তাদের উৎসব রাসূল (সা.) এর প্রতি ইরাকি জাতির ভালোবাসা থেকে উৎসারিত, এর সাথে জড়িত তাদের জাতীয় আবেগ। বাগদাদের এক মসজিদের ইমাম শায়খ ওয়ালীদ আল হায়ালী এমনটাই দাবি করেন আল জাজিরার প্রতিবেদকের নিকট। আসলে মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি সদস্যই রাসূল (সা.) এর প্রতি নিজেদের ভালোবাসাকে এভাবেই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করতে পছন্দ করেন।
মীলাদুন্নবী উপলক্ষে ইরাকিরা বিশেষ ধরনের খাবার তৈরি করে প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করেন, মসজিদে মসজিদে খতমে কুরআনের আয়োজন করা হয়, খতমে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে হাদিয়া বিতরণ করা হয়, তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় রাসূল (সা.) এর শানে বিভিন্ন ধরনের না’দ পরিবেশনের বিষয়টি। বেশির ভাগ মুসলিম দেশের মতো ইরাকেও এবারের ঈদে মীলাদুন্নবী অবশ্য ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে অন্যরকমের বিশেষত্ব লাভ করেছে। এ বছরের মীলাদুন্নবীর শোভাযাত্রায় অন্যান্য প্লেকার্ডের তুলনায় গুরুত্ব পেয়েছে إلا رسول الله লেখা প্রতিবাদী প্লেকার্ড, সবাই ছিল ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। ইরাকে কীভাবে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপিত হয়, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে আল জাজিরা আরবির এই প্রতিবেদনে।
ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর তরফ থেকে শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও নবীপ্রেমী ফিলিস্তিনিদের ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন থেমে থাকেনি এ বছরও। জেরুজালেমের অধিবাসীগণ, এবং পশ্চিম তীরের যেসকল অধিবাসী জেরুজালেমে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন, সকলেই মসজিদুল আকসা মুবারকের প্রাঙ্গনে সমবেত হয়েছিলেন মীলাদুন্নবী উদাযপন করতে। এছাড়াও নাবলুস শহরে লাখো ফিলিস্তিনির ঢল নেমেছিল মীলাদুন্নবী উদযাপন উপলক্ষে। মাওলিদ উদযাপনে গ্রামাঞ্চল থেকে মানুষ সপরিবারে চলে আসেন নাবলুস শহরে।
সেখানে চলতে থাকে মাইকে রাসূল (সা.) এর শানে না’ত পরিবেশন, তাঁর পবিত্র জীবন বৃত্তান্ত আলোচানসহ নানা আয়োজন। আসরের পর নাবলুস শহরে বিশাল শোভাযাত্রা বের হয়, তাকবীর-তাহলীল আর রাসূল (সা.) এর উপর দুরুদ পাঠের মাধ্যমে সে মিছিল বাস্তবায়িত হয়। ফিলিস্তিনে ঈদে মীলাদুন্নবী জাতীয় উৎসবে রূপ নিয়েছে। জাতীয়ভাবে সকল ফিলিস্তিনিই এ উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। বিস্তারিত দেখুন এই লিংকে ক্লিক করে।
আরব আমিরাতে ঈদে মীলাদুন্নবী উপলক্ষে সরকারি ছুটি পালিত হয়। সে দেশে মীলাদুন্নবী উপলক্ষে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত, রাসূল (সা.) এর জন্ম ও জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা, রাসূলুল্লাহর সুন্নাতের উপর গুরুত্ব প্রদান ও তাঁর আদর্শ সম্পর্কে আলোচনা, এসবের মধ্য দিয়ে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপিত হয়।
করোনা মহামারীর মধ্যেও আলজেরিয়ায় যথাসম্ভব আড়ম্বরের সাথেই উদযাপিত হয়েছে ঈদে মীলাদুন্নবী। অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো আলজেরিয়াতেও ঈদে মীলাদুন্নবী একটি ধর্মীয়-সামাজিক উৎসবে রূপ নিয়েছে। এ উপলক্ষে আলজেরীয়রা বিশেষ ধরনের খাবার প্রস্তুত করে, পরিবারের সবাই মিলে এক সাথে খাওয়া-দাওয়া করে, দরিদ্রদের মধ্যে খাবার বিতরণ করে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ঐতিহ্যবাহী প্রথা ও রীতি অনুসারে আলজেরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নভাবে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপিত হয়। করোনার কারণে এ বছর কিছুটা হলেও ব্যহত হয়েছে, তবু আলজেরীয়দের মধ্যে উৎসবের আমেজের কোন কমতি ছিল না। এদিকে এ বছর মীলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আফ্রিকা মহাদেশের বৃহত্তম ও বিশ্বের তৃতীয় বৃহ্ত্তম মসজিদের উদ্বোধন হয়েছে আলজেরিয়ায়। জামেউল জাজায়ের নামক এই মসজিদের উদ্বোধন দেশটিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আর সেটি হয়েছে পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী উপলক্ষে। বিস্তারিত দেখুন আল আরাবি ও আল জাজিরার প্রতিবেদনে।
এভাবে প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে অতন্ত গুরুত্বসহকারে পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী (সা.) উদযাপিত হয়েছে। আবার ভারত, যুক্তরাজ্য এবং এরকম অমুসলিম অধ্যুষিত দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীও সামাজিকভাবে পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করেছেন।
এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো সৌদি ও কাতার,এ দুটি দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে মীলাদুন্নবী উদযাপনে বাধা দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও এ সকল দেশের অনেক মুসলিম জনগোষ্ঠীই মীলাদুন্নবী উদযাপন করে থাকেন। মূলত ওহাবী আন্দোলনের প্রভাবে এ দুটি দেশে মীলাদুন্নবী উদযাপন বন্ধ করা হয়েছে। ওহাবীদের উত্থানের পূর্বে উসমানি খিলাফতের আমল পর্যন্ত হারামাইন শরীফাইনে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে মুসলমানদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ ধর্মীয় উৎসব উদযাপিত হতো।
ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন মুসলিম বিশ্বে কোন বিচ্ছিন্ন চর্চা নয়, বরং সৌদি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকে মুসলিম বিশ্বের সর্বজন স্বীকৃত ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপিত হয়ে আসছে। এখনো মহাবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর পবিত্র শুভ জন্ম উপলক্ষে রাসূলপ্রেমী মুসলিম জনতা ধর্মীয় ভাবাবেগে গুরুত্বসহকারে এ ঈদ উদযাপন করছে।
রাসূলের (সা.) প্রশংসাগাঁথা, সীরাত আলোচনা, কুরআন তিলাওয়াত আর শোভাযাত্রা, মিষ্টান্ন আর ঐতিহ্যবাহী খাবারের আয়োজন ও পাড়া-প্রতিবেশী এবং দরিদ্রদের মধ্যে সেসব খাবার বিতরণ, এসবই হচ্ছে আরব ও ইসলামি বিশ্বে ঈদে মীলাদুন্নবী (সা.) পালনের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি। এ বছর দুই ঈদসহ অন্য সকল ধর্মীয় উৎসবের মতো ঈদে মীলাদুন্নবীতেও আনুষ্ঠানিক আড়ম্বর ছিল স্বভাবতই অনেক কম, করোনা মহামারীই মুখ্যত এ জন্য দায়ী। তবে মীলাদুন্নবীর ধর্মীয় গুরুত্ব ও ভাবগাম্ভীর্যে একটুও কমতি ছিল না কোথাও। অবশ্য আনন্দ উৎসবের পাশাপাশি প্রতিটি মীলাদুন্নবীর মাহফিল ও শোভাযাত্রা এ বছর একই সাথে বিক্ষোভ সমাবেশেও পরিণত হয়েছে রাসূল (সা.) এর প্রতি ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় দৃষ্টতাপূর্ণ আচরণের কারণে।