মূল: শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)
অনুবাদ : মাওলানা মুমিনুল হক
হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নূরানী চেহারা মোবারক জামালে এলাহীর দর্পন ও অসীম নূরের বহিঃপ্রকাশের আধার। বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত বারা ইবনু আযিব (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) মানবকুলের মধ্যে সর্বাধিক সুন্দর ও কমনীয়। হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর চেয়ে সুন্দর কোনো কিছুই আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) তাঁর বক্তব্যে ‘কোনো কিছুই দেখিনি’ কথাটি উল্লেখ করেছেন। তিনি কিন্তু কোনো মানুষকে দেখিনি অথবা কোনো পুরুষকে দেখিনি-এরূপ বলেননি। তাঁর বর্ণনার মধ্যে অধিক ব্যাপকতা রয়েছে। নবী করীম (সা.) এর আঙ্গিক সৌন্দর্য বোঝানোই তাঁর উদ্দেশ্য। মোটকথা, মহানবী (সা.) এর সৌন্দর্য ও কমনীয়তা সমস্ত কিছুর উপর অগ্রগণ্য ছিলো। এ মর্মে তিনি আরও বলেছেন, নবী করীম (সা.) এর নূরানী চেহারাখানা এতো উজ্জ্বল যে, সূর্যের উজ্জ্বলতাও তার কাছে হার মেনেছে। যেমন কবি বলেন, রাতের পর এমন কোনো দিবসের অভ্যুদয় ঘটেনি যা মহানবী (সা.)-এর নূরানী চেহারার চেয়ে উজ্জ্বল। মোটকথা তাঁর নূরানী চেহারার জ্যোতির্ময়তার তুলনায় অন্য সবকিছুর উজ্জ্বলতা নেহায়েতই নগণ্য।
সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে উল্লেখ আছে, হযরত বারা ইবনু আযিব (রা.) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, হুযূর আকরাম (সা.) এর নূরের আভাকে স্বচ্ছতা ও উজ্জ্বলতার দিক দিয়ে কি তরবারীর সাথে তুলনা করা যেতে পারে? তিনি বলেন, না। বরং তাঁর চেহারার উজ্জ্বলতা ছিলো চন্দ্রের ন্যায়। তরবারীর সাথে চেহারার তুলনা যথাযথ হতে পারে না। কেননা তরবারিতে গোলাকৃতি অনুপস্থিত। তাই তিনি চেহারা মুবারককে চন্দ্রের সাথে তুলনা করেছেন। চন্দ্রের মধ্যে চাকচিক্য আছে, তদুপরি গোলাকৃতিও বিদ্যমান।
সহীহ মুসলিম শরীফের বর্ণনায় রয়েছে, তিনি (বারা ইবনু আযিব) উত্তরে বললেন, না। বরং হুযুরের চেহারা মুবারক চন্দ্র ও সূর্যের ন্যায় ছিলো। অর্থাৎ গোলাকার। যদিও চন্দ্রের তুলনায় সূর্যের মধ্যে কিরণ ও চাকচিক্য অধিক, তথাপিও চন্দ্রের মধ্যে যে লাবণ্য বিদ্যমান সূর্যে তা নেই। আর লাবণ্য এমন এক সৌন্দর্য যা দেখলে অবর্ণনীয় পুলকানুভূতি লাভ করা যায় এবং অন্তর আকৃষ্ট হয়- যার অনুভূতি লাভ কেবল সুস্থ সৌন্দর্যবোধ-বিশিষ্ট ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। সীরাত বিশেষজ্ঞগণ উজ্জ্বলতা ও লাবণ্য শব্দ দু’টির মধ্যে পার্থক্য নিরূপন করে থাকেন। ‘ছাবাহাত’ হযরত ইউসুফ (আ.) এর গুণ ছিলো আর ‘মালাহাত’ গুণটি হুযূর আকরাম (সা.) এর শানে প্রযোজ্য হয়ে থাকে। এ মর্মে স্বয়ং হুযূর (সা.) ইরশাদ করেছেন ‘আনা মালিহ ওয়া আখি আছবাহ’- অর্থাৎ আমি লাবণ্যময় আর আমার ভাই [ইউসুফ (আ.)] উজ্জ্বল।
‘নবী করীম (সা.) এর চেহারা মুবারক গোল ছিলো’ একথার অর্থ এই নয় যে, চেহারা বৃত্তের ন্যায় ছিলো। কেননা বৃত্তাকার গোল হওয়াটা রূপ ও সৌন্দর্যের পরিপন্থী। বরং চেহারা মুবারক গোল ছিলো মানে এমন এক ধরণের গোল ছিলো যা দেখতে লম্বা নয়। এ ধরণের চেহারা রূপ, লাবণ্য, পৌরুষ ও মহত্বের নিদর্শন। বর্ণিত আছে যে, তাঁর চেহারা মুবারক ছিলো مكلثم ‘মুকালছাম’; مطهم ‘মুতহাম’ নয়। ‘মুকালছাম’ গোলগাল চেহারাকে বলা হয়। কাযী আয়ায (র.) কর্তৃক রচিত ‘কিতাবুশ শিফা’ গ্রন্থে ‘মুকালছাম’ এর বর্ণনা দেয়া রয়েছে এরূপ: যার চেহারায় চিবুক ছোট হয়ে থাকে তাকে মুকালছাম বলে। আর চিবুক ছোট হওয়া মানে চেহারা গোলগাল হওয়া। কেননা চিবুক লম্বা হওয়ার কারণেই চেহারা লম্বাটে হয়। আর ‘মুতহাম’ বলা হয় মাংশল চেহারাকে যা দৃশ্যতঃ স্ফীত বলে মনে হয়।
অভিধানে ‘মুকালছাম’ শব্দটি বৃত্তাকার ও সমন্বিত করা অর্থেও এসেছে। আবার উক্ত শব্দটির অর্থ ‘দুর্বল’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এদুটি অর্থই সৌন্দর্যের পরিপন্থী। নবী করীম (সা.) এর চেহারা মুবারকের এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি মুলায়েম মৃত্তিকাখÐ সদৃশ ছিলেন। سهل ‘সহল’ নরম ও সমতল ভূমিকে বলা হয়। কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় سيل الحديت ‘সাইলুল হাদীত’ প্রবাহিত গন্ড। سيلان ‘সাইলান’ ‘প্রবাহিত হওয়া’ শব্দ থেকে যার উৎপত্তি। মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া কিতাবে হযরত ইবনু আছীর (রা.) এর বর্ণনায় পাওয়া যায় اساله درخدين যার অর্থ গন্ডদেশ এমন লম্বা ছিলো যা উঁচু নয়; বেরিয়ে পড়ে এমনও নয়।
শায়খ ইবনু হাজার আসকালানী (র.) বলেন, উপরোক্ত বর্ণনা অনুসারে প্রত্যেকের এ অনুসন্ধিৎসা হওয়া স্বাভাবিক যে, নবী করীম (সা.) এর চেহারা মুবারক তরবারীর মতো ছিলো কি না? ব্যাপারটি চিন্তা ভাবনার দাবী রাখে।
কোনো কোনো হাদীসে নবী করীম (সা.) এর চেহারা মুবারকের উপমা স্বরূপ’ ‘এক ফালি চাঁদ’ বা ‘অর্ধচন্দ্র’ ইত্যাদির বর্ণনা এসেছে। বিভিন্ন কবিতায়ও এরকম উপমা উপস্থাপন করা হয়েছে। হযরত কা’ব ইবনু মালিক (রা.) যিনি সাহাবাগণের মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত কবি ছিলেন- তাঁর কবিতায়ও এ ধরণের উপমা দৃষ্টিগোচর হয়। কাজেই এর প্রয়োগ ও যথার্থতার ব্যাপারে একটি সামঞ্জস্যশীল সমাধানে পৌঁছানো উচিত। সুতরাং সমাধানস্বরূপ কেউ কেউ এরকম বলেছেন যে, উপরোক্ত উপমাসমূহ দ্বারা হুযূর পাক (সা.) কখনও কারো প্রতি পূর্ণ অভিমুখী হয়েছেন বা কারও প্রতি আংশিকভাবে মুখ ফিরিয়েছেন- সকল অবস্থা গুলিকেই বুঝানো হয়েছে। এ জাতীয় সমাধানের পক্ষে সহায়ক দলীল স্বরূপ তিবরানী শরীফে প্রাপ্ত হযরত জুবায়র ইবন মুতইম (রা.) এর হাদীসখানা গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের দিকে এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন, মনে হলো যেনো একখানা অর্ধচন্দ্র। তবে সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান এটাই যে, চন্দ্র বা অর্ধচন্দ্র বা একফালি চাঁদ-এ জাতীয় যে উপমাগুলি উপস্থাপন করা হয়েছে, তা হুযূর পাক (সা.) এর ললাট মুবারকের উপমা। অর্থাৎ তাঁর ললাটখানি ছিলো যেমন একফালি চাঁদ। সহীহ বুখারী শরীফে হযরত কা’ব ইবন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত আছে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ললাট মুবারকে যখন ভাঁজ পড়তো তখন চেহারা মুবারক চন্দ্রের ফালির মতো ঝকমক করতো। ‘সাররাহ’ নামক আরবী অভিধানে ‘দু ফাতহাযোগে’ শব্দটির অর্থ লিখা হয়েছে ‘ললাটে ভাঁজ পড়া’। তার বহুবচন হচ্ছে اسرار ‘আসরার’ আর মুনতাহাল জুমু হচ্ছে اسارير ‘আসারীর’। হাদীস শরীফে পাওয়া যায় যে, তাঁর নূরানী কপাল মুবারকের ভাঁজগুলি চমকাতে থাকতো। হুযূর পাক (সা.) এর চেহারা মুবারককে একফালি চাঁদের সাথে উপমা দেয়ার ব্যাপারটিকে কেউ কেউ এভাবে সমাধান দিয়েছেন যে, এক ফালি চাঁদে যেরূপ কলংক খুঁজে পাওয়া যায় না, তেমনি হুযূর পাক (সা.) এর চেহারা মুবারক ছিলো কলংকহীন। এধরণের সমাধান অবশ্য দুর্বল তাতে সন্দেহ নেই। কেননা, কোনো কিছুর সৌন্দর্যকে যখন চন্দ্রের সাথে তুলনা করা হয়, তখন চন্দ্রের কলঙ্ককে বাদ দিয়ে শুধু তার জ্যোতির্ময়তাকে বুঝানো হয়ে থাকে।
সায়্যিদুনা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চেহারা মুবারক ছিলো আলোকোজ্জ্বল বৃত্তাকার চন্দ্রের ন্যায়। دائره قمر ‘দায়েরায়ে কামার’ বলা হয় পূর্ণিমার চন্দ্রকে। ফারসী ভাষায় যাকে বলা হয় খিরমনশাহ। (আল্লামা শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (র.) বলেন,) আমার মনে হয় চন্দ্রের জ্যোৎ¯œাকে এবং তার আলোকময় বৃত্তকে দেহের সাথে তুলনা করার মাধ্যমে হুযূর পাক (সা.) এর চেহারার ঐ আভার প্রতিই প্রকাশ্যভাবে ইঙ্গিত করা হয়েছে যা নূরের আকৃতিতে চন্দ্রের বৃত্তের ন্যায় চেহারা মুবারককে বেষ্টন করে নিয়েছে। উপমা প্রদান করাটা হচ্ছে হুযূর পাক (সা.) এর নূরের ধারার পূর্ণ কিরণ, তাঁর মহত্বের ভাবগাম্ভীর্যতা এবং শান-শওকত প্রকাশের একটা পদ্ধতি মাত্র। চেষ্টা করে ও লক্ষ্য করে দেখতে হবে, উক্ত উপমার প্রতি আত্মিক দৃষ্টি প্রদান করার পর কি অবস্থা উদ্ভাসিত হয়। আর দৃষ্টিপাতকারীর দৃষ্টিতে তাঁর সৌন্দর্য ও শান-শওকত কিভাবে প্রতিভাত হয়। কেননা এ আত্মিক দৃষ্টি নয়নযুগলকে পরিতৃপ্ত করে আর অন্তরকে মহানবী (সা.) এর প্রেম-ভালবাসা ও আযমতের নূর দ্বারা কানায় কানায় ভরপুর করে দেয়।
হযরত কা’ব ইবনু মালিক (রা.) এর হাদীসেও ‘চন্দ্রের বৃত্ত’ এই উপমা বিদ্যমান। আর চন্দ্রের সাথে যেসব উপমা এসেছে সেগুলি দ্বারা সাধারণত পূর্ণিমার চন্দ্র বুঝানো হয়েছে এবং এটাই প্রসিদ্ধ। যেমন ইমাম বায়হাকী (র.) হযরত আবূ ইসহাক থেকে বর্ণনা করেছেন, একদা এক হামাদানী মহিলা আমাকে বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে হজ্জ করেছি। তা শুনে আমি তাকে বললাম তাহলে তাঁর চেহারা মুবারকের বর্ণনা দাও দেখি। তখন মহিলাটি বললেন, তাঁর চেহারা মুবারক পূর্ণিমার শশীর ন্যায় সুন্দর। আমি এরূপ সৌন্দর্য পূর্বেও দেখিনি, পরেও দেখিনি।
অনুশীলনকারী সন্ধানীগণ সর্বদাই তাঁর ললাটে নূরের জ্যোতির্ময় ধারাকে আত্মিক দর্শনের মাধ্যমে অবলোকন করে শুক্লপক্ষের রজনীর ন্যায় আলোক প্রাপ্ত হতেন। এমন আত্মিক দর্শন থেকে কখনও অমনোযোগী হতেন না, কখনও বিচ্ছিন্ন হতেন না। কেননা ‘দীদার’ হচ্ছে নগদলভ্য।
হযরত ইবন আবী হালা (র.) বর্ণিত হাদীসে আছে, দর্শনকারীর দৃষ্টিতে হুযূর পাক (সা.) ছিলেন একজন মহিমান্বিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর চেহারা মুবারক পূর্ণিমার শশীর ন্যায় ঝকমক করতো।
দুজাহানের সৌন্দর্য হুযূর পাক (সা.) কে সূর্যের সাথে উপমা না দিয়ে চন্দ্রের সাথে উপমা দেয়ার কারণ সম্পর্কে সীরাত বিশেষজ্ঞগণ অভিমত প্রদান করেছেন। তাঁরা বলেন, চন্দ্র তার জ্যোৎ¯œার মাধ্যমে চোখকে শীতল করে, হৃদয়কে পুলকানুভূতি প্রদান করে। মনে আনে প্রেম-ভালোবাসা এবং অনুভবে আনে পরম আস্বাদ। জ্যোৎ¯œার প্রতি দৃষ্টিপাত করা সম্ভব। কিন্তু সূর্যের আলোর দিকে তাকানো সম্ভব নয়। এতে চোখ ঝলসে যায়। অন্তরে বিস্বাদ সৃষ্টি হয়। অবশ্য হুযূর পাক (সা.) কে সূর্যের সাথে উপমা দেয়া যেতে পারে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে। তা হচ্ছে এই, হুযূর পাক (সা.)-এর ব্যক্তিত্ব, মহান গুণাবলীর প্রকাশস্থল, শান শওকত ও অবিসংবাদী কর্তৃত্বের দিক দিয়ে তিনি সূর্যের মতো। পৃথিবীপল্লবী আলোর ছটায় সূর্য যেমন জগতকে বেষ্টন করে নেয় তিনিও তেমনি তাঁর নূরের কিরণের মাধ্যমে সারা জাহানকে বেষ্টন করে নিয়েছেন। মহানবী (সা.) এর ব্যক্তিসত্তার হাকীকতের (প্রকৃত তত্তে¡র) রহস্য অবহিত হতে মানুষ অক্ষম। এ দিক দিয়েও তিনি সূর্যের মতো। দূরবর্তী বা নিকটবর্তী যে কেউ হোক না কেন, তাঁর মর্যাদা ও পূর্ণতার শেষপ্রান্ত সম্পর্কে অবহিত হতে বা অনুধাবন করতে সকলেই অক্ষম ও সামর্থহীন-এদিক দিয়েও তাঁকে সূর্যের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যেমন কবির ভাষায় বলা হয়েছে, ‘মুহাম্মদ (সা.) এর যথাযথ মর্যাদা নিরূপণ করতে সৃষ্টজগত অক্ষম’। দূরের ও নিকটের কেউই তাঁর প্রকৃত পরিচিতি লাভ করতে পারে না। তিনি এক সূর্যতুল্য মহান সত্তা, যা দূর থেকে ক্ষুদ্রাকৃতিতে মানুষের দৃষ্টিতে প্রতিভাত হয়। কিন্তু সোজাসুজি কেউ যদি তাঁর প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করে তাহলে দৃষ্টি অবসন্ন হয়ে যাবে। ফলকথা তিনি হচ্ছেন এমন এক উজ্জ্বল রবি, যার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করতে সৃষ্টিকূল অক্ষম।
এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে এসেছে সূর্যের উপমা। তবে অবলোকন ও অনুভূতির দিক দিয়ে চন্দ্রের উপমাই শোভনীয়।
মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়াহ গ্রন্থে নেহায়া কিতাব থেকে সংকলিত হয়েছে, হুযূর পাক (সা.) যখন আনন্দিত হতেন, তখন তাঁর চেহারা মুবারক আয়না সদৃশ হয়ে যেতো। এমনকি দেয়াল-দরজার নকশী ও মানুষের চেহারার প্রতিবিম্ব তাতে ঝলমল করতো।
হযরত জাবির ইবন সামুরাহ (রা.) বলেন, একদা এক চাঁদনী রাতে আমি হুযূর পাক (সা.) কে দেখলাম। তখন তাঁর শরীর মুবারকের উপর দু’খানি লাল কাপড় ছিলো। আমি কখনও তাঁর দেহ মুবারকের প্রতি তাকাই আবার কখনও চাঁদের জ্যোৎ¯œার প্রতি তাকাই। আল্লাহর কসম চাঁদের উজ্জ্বলতা অপেক্ষা রাসূলে পাক (সা.) কেই আমার কাছে বেশি সুন্দর মনে হলো। বর্ণনাকারী সাহাবীর ‘আমার কাছে’ শব্দটিতে নবী করীম (সা.) এর রূপ-লাবণ্যের দ্বারা তিনি যে পরম আস্বাদ উপভোগ করছিলেন তার ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায়। এটি তাঁর আনন্দ উপভোগের বহিঃপ্রকাশ বটে। তবে প্রকৃত অবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। রাসূল (সা.) এর রূপ লাবণ্য সর্বাধিক-এতে কোনো সন্দেহ নেই।
হুযূর আকরাম (সা.) এর উন্নত মানের গুণাবলী কবিত্বের দৃষ্টিকোণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা কাব্যিক ধারণা ও স্বভাবের অন্তর্গত। নতুবা তাঁর চারিত্রিক সৌন্দর্যাবলী এবং আঙ্গিক গুণাবলীর তুলনা তো হতেই পারে না।
পবিত্র আঁখিযুগল
হুযূর আকরাম (সা.) এর নয়ন মুবারকের আলোচনা দুটি দিক দিয়ে উপস্থাপিত হতে পারে। প্রথম আলোচনা হুযূর পাক (সা.) এর নয়ন মুবারকের অবস্থানস্থল এবং আকৃতি কেমন ছিলো, তার গঠন কেমন ছিলো-এ প্রসঙ্গে। দ্বিতীয় আলোচনা, তাঁর দৃষ্টিশক্তির প্রশংসা সম্পর্কে। আলোচনার প্রথম প্রসঙ্গ সম্পর্কে হযরত আলী (রা.) থেকে প্রাপ্ত বর্ণনা এরূপ-তিনি বলেন, তাঁর পবিত্র চক্ষু ছিলো ডাগর ডাগর এবং চোখের ভ্রæ ছিলো দীর্ঘ। ডাগর চক্ষু বা বড় চক্ষু বলার উদ্দেশ্য ‘তাঁর চোখ ছোট ছিল না’ একথা বুঝানো। আবার বড় অর্থ এও নয় যে, অস্বাভাবিক বড় যা কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছে। মহানবী (সা.) এর অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বর্ণনার ব্যাপারে মৌলিক বিষয় এটাই যে, তাঁর সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিলো মধ্যম ধরণের স্বাভাবিক ও সামঞ্জস্যশীল। কেননা, রূপ-সৌন্দর্য, মর্যাদা ও পূর্ণতার ভিত্তি হলো মধ্যম ও স্বাভাবিক অবস্থা বিদ্যমান থাকা।
অন্য এক হাদীসে এসেছে, তাঁর নয়ন যুগলের পুতুলির রং ছিলো ‘আশকালুল আইনাইন’ সাদা ও লাল মিশ্রিত। অর্থাৎ চোখের পুতুলির সূ² সূ² রগগুলি ছিলো লাল রঙের। তাঁর চক্ষুদ্বয়ের স্বরূপ বর্ণনায় কালো ও লাল রঙ শব্দটির ব্যবহার খুব কম পাওয়া যায়। তবে নেহায়া নামক কিতাবে বলা হয়েছে, হুযূর পাক (সা.) এর আঁখিদ্বয়ের রং ছিলো কালো ও লাল মিশ্রিত। হ্যাঁ, এটাও প্রিয়জনের চোখের সৌন্দর্যের একটি দিক। তবে প্রসিদ্ধ বর্ণনা হচ্ছে اشكل العينين ‘আশকালুল আইনাইন’। অবশ্য বিভিন্ন কবিতায় উদ্যমী নওজোয়ানদের প্রশংসার ক্ষেত্রে شهله ‘শাহলাহ’ শব্দের ব্যবহার এসেছে। অভিধান গ্রন্থে اشكل ‘আশকাল’ এর অর্থ করা হয়েছে লাল ও সাদা রঙ্গে মিশ্রিত যৌথ বর্ণ-যার সাদা বর্ণের উপর রক্তিমাভা ঝিলিক দেয়। شكله ‘শাকলাহ’ কে سحره ‘সাহরা’ও বলা হয় যা سحر ‘সেহের’ (যাদু করা) শব্দ থেকে উৎপন্ন হয়েছে, যাকে বলা হয় মায়াবী চোখ। কেননা এ ধরণের চোখ মানুষের চিত্তকে আকর্ষণ করে। কোনো কোনো ব্যাখ্যাকার ‘আশকালুল আইনাইন’ এর ব্যাখ্যা করেন طويل شق العينين ‘তাবীলু শাককিল আইনাইন’ অর্থাৎ দীর্ঘ সরু চোখ। অভিধান গ্রন্থেও এরকম অর্থ করা হয়েছে। কাযী আয়ায মালিকী (র.) এর বর্ণনাও এরকম। শামাইলে তিরমিযীতেও এরূপ বর্ণনা এসেছে। আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (রা.) এর ভাষা عظيم العينين ‘আযীমুল আইনাইন’ (বড় চোখ) ও বাহ্যত উপরোক্ত অর্থই প্রদান করে। প্রকৃত তত্ত¡ আল্লাহ তাআলাই জানেন।
এক বর্ণনায় এসেছে ادمج العينين ‘আদমাজুল আইনাইন’। ঘন কালো চোখকে ادمج ‘আদমাজ’ বলা হয়। অভিধানে এর অর্থ করা হয়েছে প্রশস্ত। অন্য এক বর্ণনায় আছে اكحل العينين ‘আকহালুল আইনাইন’ সুরমাযুক্ত চোখ। অর্থাৎ হুযূর পাক (সা.) এর লোচনদ্বয় সুরমা ছাড়াই সুরমাযুক্ত পরিদৃষ্ট হতো।
দ্বিতীয় আলোচনা হযূর পাক (সা.) এর দৃষ্টিশক্তির প্রশংসা সম্পর্কিত। এমর্মে হযরত ইবন আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, হুযূর আকরাম (সা.) দিবালোকে যে রকম দেখতে পেতেন ঠিক তেমনি দেখতে পেতেন রাতের অন্ধকারে। হাদীসখানা বুখারী শরীফ থেকে সংগৃহীত। বায়হাকী শরীফেও হযরত আয়শা সিদ্দীকা (রা.) থেকে এরকম বর্ণনা পাওয়া যায়। কাযী আয়ায (র.) ‘কিতাবুশ শিফা’ তে এরূপ বর্ণনা করেছেন। হুযূর পাক (সা.) এর দৃষ্টিশক্তি এতো প্রখর ছিলো যে, সুরাইয়া নক্ষত্ররাজির অভ্যন্তরে এগারটি নক্ষত্র তিনি পরিস্কার দেখতে পেতেন। সুহাইলীর বর্ণনায় বারোটি দেখতে পেতেন। তাঁর দৃষ্টি আকাশের তুলনায় যমিনের দিকেই অধিকতর নিবদ্ধ থাকতো। নবী করীম (সা.) যে অতুলনীয় লজ্জাশীলতার অধিকারী ছিলেন এটি হচ্ছে তার দলীল। বিভিন্ন হাদীসে যদিও এরূপ বর্ণনা এসেছে যে, হুযূর (সা.) আকাশের দিকে দৃষ্টি উত্তোলন করতেন। কখনও কম করতেন আবার কখনও বেশি করতেন। এগুলো ছিল সাধারণত ওহী প্রাপ্তির অপেক্ষায়।
[মাওলানা মুমিনুল হক অনূদিত হযরত শাহ আব্দুল হক
মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)-এর মাদারিজুন নবুওত থেকে সংকলিত]