শায়খ আবু বকর আল মাশহুর রহ.: সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য

 

-হাসান আহমদ

দ্বীনি তাহযীব-তামাদ্দুন প্রতিষ্ঠায়, তালিম-তরবীয়ত প্রচারে, শিক্ষা-দীক্ষা ও ইসলামী হুকুম-আহকাম সমাজে কায়েম করতে মুসলিম উম্মার ১৪০০ বছরের ইতিহাসে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তাঁরা হচ্ছেন উলামায়ে কেরাম ও পীর-মাশায়েখ। যাঁরা তাঁদের জীবনের বেশিরভাগ সময় নিরলস সংগ্রাম ও নীরব সাধনায় মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও সংশোধনের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি স্থানে তাঁদের ত্যাগ-সাধনা ও মেহনতের ফলে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়েছে এবং তা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। পৃথিবীর যেখানেই মুসলিম উম্মাহর জাগরণ ও পুনরুত্থান পরিলক্ষিত হয় সেখানেই এর নেপথ্যে আলেম-ওলামা ও পীর মাশায়েখদের অবদান সবচেয়ে বেশি থাকে। যারা আড়ালে অবস্থান করে নীরবে-নিভৃতে একেবারে তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত দ্বীনী তা’লীম-তরবিয়ত, ইসলাহ ও তাযকিয়া-তাসাউফের কাজ করেন। পতনোম্মুখ একটি জাতিকে কিভাবে উন্নতি ও অগ্রগতির সর্বোচ্চ শিখরে নিতে হয় তার বাস্তব নমুনা পীর-মাশায়েখ ও আউলিয়া কেরামের জীবনীতে পরিলক্ষিত হয়। ঘুনেধরা ও ধ্বংসপ্রায় একটি সমাজকে, পাপা-পঙ্কিলতায় পরিপূর্ণ একটি জাতিকে দ্বীনি তারবিয়ত ও তা’লীম ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে কিভাবে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা, ভ্রাতিত্ব ও খোদাভীতি প্রতিষ্ঠা করা যায় যুগে যুগে পীর-মাশায়েখ ও উলামায়ে কেরামগণ তা দেখিয়ে গেছেন। তাঁদের সেই তাযকিয়া, তা’লীম ও তরীকতের ধারা এখনো পৃথিবীর প্রত্যেকটি স্থানে চলমান রয়েছে। সেই সকল দুনিয়াবিমুখ ও উম্মাহর কল্যাণকামী ব্যক্তিদের অন্যতম হচ্ছেন ইয়ামানের বিখ্যাত আলেম সুফি সাইয়্যিদ আবু বকর আল আদানী ইবনে আলী আল মাশহুর রহ.। তিনি যেমন একজন বিখ্যাত আলেম ও মুফাসসির ছিলেন তেমনিভাবে একজন দুনিয়াবিমূখ সুফি সাধক ছিলেন। ইলমী খেদমতে যেমন তাঁর প্রত্যক্ষ পদচরণা ছিল ঠিক তেমনিভাবে তাসাউফ-তাযকিয়ার ময়দানেও তাঁর সরব পদচারণা ছিল। তাঁর খেদমত ও ইলমী সুনাম-সুখ্যাতি পুরো আরব বিশ্বে সর্বজন বিদিত ছিল।

জন্ম ও প্রতিপালন :
ইয়ামানের এই বিখ্যাত আলেম ও সূফী পূর্ব ইয়েমেনের হাদরামাউতের বালাউয়ী পরিবার থেকে এসেছেন। তিনি দক্ষিণ ইয়ামেনের আবিয়ান জেলার আহওয়ার শহরে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে (১৩৬৬ হিজরি) একটি বিখ্যাত আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। যারা যুগ যুগ ধরে পূর্বপুরুষদের ইলমী ও আমলী মিরাছ বহন কর চলেছেন। তাঁর বাবা একজন প্রসিদ্ধ আলেম, বিখ্যাত দায়ী ও আহওয়ার শহরের মুফতি ছিলেন। তাঁদের বংশ পরম্পরা হুসাইন বিন আলী বিন আবি তালিব রা পর্যন্ত সম্পৃক্ত। তাঁর পরিবার ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের (1919-1967) বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও আন্দোলনের জন্য পরিচিত ছিল।

 শিক্ষা-দীক্ষা :
সাইয়্যিদ আবূ বকর ইবনে আলী আল মাশহুর রহ. আহওয়ার এবং আল-মাহফাদ শহরে তাঁর শৈশব অতিবাহিত করেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি পিতা আলী বিন আবি বকর বিন আলাউয়ী আল মাশহুরের হাতে। পিতার কাছেই কোরআন হিফজ করেন এবং আহওয়ার শহরের আল মাদরাসাতুল মাইমূনায় তাঁর কাছ থেকে প্রাথমিক শরয়ী জ্ঞান ও ভাষাগত দক্ষতা অর্জন করেন। আহওয়ার ও আল-মাহফাদ শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। অতঃপর এডেন শহরে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তিনি তাঁর শহর আহওয়ার ও অন্যান্য ইয়েমেনি শহরের অনেক শায়েখদের কাছে পড়াশোনা করেছেন।
তিনি একদিকে যেমন সে সময়ের বড় বড় শায়েখদের কাছ থেকে সরাসরি তাঁদের সোহবত ও তত্ত্বাবধানে থেকে ইলম অর্জন করেছেন তেমনিভাবে সমসাময়িক একাডেমিক শিক্ষাও গ্রহণ করেছেন। এডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অনুষদের আরবি ভাষা বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর সেখান থেকে ফিকহশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এডেন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট প্রদান করে এবং ইসলামী ও মানবিক চিন্তাধারাকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টার ভূয়সি প্রশংসা করে।

ইলমের জন্য সফর :
ইলম অর্জনের উদ্দেশ্যে সফর ইসলামী ইতিহাসের আলেম-উলামাদের একটি চিরাচরিত রীতি। তাঁরা ইলম অর্জনের জন্য শহর থেকে শহরে, দেশ থেকে দেশে কখনো পায়ে হেঁটে কখন বা বাহনে করে সফর করতেন । শায়খ আবু বকর ইবনে আলী আল মাশহুরও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। ইলম অন্বেষণের নিমিত্তে তিনি ইয়ামেনে আহওয়ার , তারইয়াম ও এডেন শহরে সফর করেন এবং সেখানকার আলেম ও মাশায়েখদের কাছ থেকে ইলমে দীন অর্জন করেন। সেখানকার শায়খদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে সালেম আল বায়হানী।
এমনিভাবে তিনি মিশর, শাম, জর্ডান ও শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশে সফর করছেন এবং সেখানকার  নামকরা বিশিষ্ট শায়েখদের কাছ থেকে দ্বীনি তা’লীম-তরবিয়ত গ্রহণ করেন।

দাওয়াত ও কর্মজীবন :
আবু বকর আল মাশহুর রহ. দীনি দাওয়াত ও দরস-তাদরীসের ময়দানে একজন নিবেদিত প্রাণ মনীষী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পরে যৌবনের শুরুতেই তিনি দীনী খেদমত ও তালীমের অঙ্গনে প্রবেশ করেন। আহওয়ার শহরের আল মাদরাসাতুল মাইমুনায় দরস শুরু করেন। অতঃপর এডেন শহরের বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
তিনি আহওয়ার, আল-মাহফাদ এবং এডেন সহ বিভিন্ন অঞ্চলে দীনী খেদমত ও সামাজিক কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের একজন প্রশিক্ষকও ছিলেন।
তিনি ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে সৌদি আরবে সফর করেন। সেখানে বিশিষ্ট শায়েখগণের নিকট আবার পড়াশোনা শুরু করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- আব্দুল কাদির ইবনে আহমদ আল-সাক্কাফ রহ, আলাউয়ী তরিকার ইমাম ও শায়েখ সাইয়্যিদ মুহাম্মদ আলাউয়ী আল-মালিকি রহ, মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল-শাতিরী রহ। পাশাপাশি জেদ্দা শহরের মসজিদে ইমামতি ও দাওয়াতের কাজ করেছেন।
তিনি একাধারে ১২ বছর সৌদি আরবে অবস্থান করেন। অতঃপর যখন নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে দেশের দুটি অংশের (দক্ষিণ ও উত্তর) মধ্যে ইউনিয়ন ঘোষণা করা হয় তখন তিনি ইয়েমেনে ফিরে আসেন এবং দাওয়াত, ওয়াজ-নাসিহতে ও দ্বীনি দিকনির্দেশনার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা :
শিক্ষা-দীক্ষা ও দ্বীনি তা’লীম-তরবীয়ত এবং ইসলামী তাহজিব-তামাদ্দুন ও সংস্কৃতি-সভ্যতা বিস্তারে তাঁর অবদান ছিল উল্লেখ করার মতো। তিনি “ইসলামী শিক্ষাসংঘ” নামে কয়েক ডজন শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। যেগুলিতে তৎকালীন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এসে ভিড় জমাত। সেখানে অনেক স্বেচ্ছাসেবক ও দাতাদের সহযোগিতায় তাদের আবাসন এবং খাবারের বন্দোবস্ত করা হতো।
মেয়েদের শিক্ষার জন্য “দারুয যাহরা” নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু করেন এবং বিভিন্ন জেলায় এর একাধিক শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। শিশুদের কুরআন মুখস্থ করার জন্য ‘মাদরাসাতুল ফিতইয়ান’ নামে একটি হিফজ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
এমনিভাবে আবু বকর আল মাসহুর রহ বেশ কয়েকটি গবেষণাকেন্দ্র ইয়েমেনের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ইসলামিক বিজ্ঞান ও মানবিকের জন্য “আল-ওয়াসাতিয়াহ আশ শারইয়াহ ইউনিভার্সিটি” প্রতিষ্ঠা করেন। যার কাজ ২০১৬ হাদরামাউতে শুরু হয়।
তিনি বিশেষ দাওয়াত ও ইলমী প্রকল্প নিয়ে কাজ করেছেন। যেগুলোকে ফিকহুত তাহাউলাত, সুন্নাতুল মাওয়াকিফ ও সুন্নাতুদ দালালাহ নাম দিয়েছেন। গুণীজন এগুলোকে ইলমু ফিকহিদ দাওয়ার অঙ্গনে এক প্রশংসনীয় সংযোজন বলে মনে করেন।
তিনি ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করার জন্য مدرسة الابداع للدراسات وخدمة التراث নামে একটি সৃজনশীল ও ব্যতিক্রমধর্মী গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ‘ওয়াদিয়ে হাদরামাওত’ ফোরাম সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ফোরামও প্রতিষ্ঠা করেন।

আখলাক ও আকিদা :
ইয়ামানের এই বিখ্যাত আলেম ও বুজুর্গ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ পালনের পাশাপাশি তাঁর আখলাক ও চরিত্র, মুআমালাহ ও আচরণ উম্মাহর সামনে উপস্থাপন এবং তাদেরকে শেখানোর ব্যবস্থা করে গিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আশআরী  আকীদার। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা বিরোধী মত ও মতবাদকে প্রতিরোধ করতে তাঁর প্রশংসনীয় ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে ওয়াহাবীবাদ ও সালাফীবাদের বিরুদ্ধে তাঁর বিশেষ ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সালাফী ও ওয়াহাবীদের খন্ডনে  “شروط الاتصاف لمن یرید مطالعة کتب الاسلاف” কিতাবসহ বিভিন্ন লেখনি রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ প্রচার ও বিস্তারে এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা ও বিশ্বাস প্রমাণে তিনি “আনোয়ারে মাজাল্লাহ” নামে একটি সাময়িকী বের করেছিলেন। এই সাময়িকীর শাবান মাসের সংখ্যায় ওসিলা, ইস্তেগাছাহ এবং আউলিয়া কেরামের বিভিন্ন নিদর্শন হতে বরকত হাসিল করার ব্যাপারে তিনি আলোকপাত করেছেন এবং এক্ষেত্রে ওহাবী ও সালাফীদের ভ্রান্ত মতবাদ ও বাড়াবাড়ি খন্ডন করেছেন।

তার লিখিত গ্রন্থসমূহ :
ইয়েমেনের এই বিখ্যাত আলেম ও বিশিষ্ট দাঈ আবু বকর মাশহুর রহ. তাঁর কাজ শুধু তালিম-তরবিয়ত ও ওয়াজ-নসিহতে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং দ্বীনি প্রয়োজন ও তাগিদে বিভিন্ন বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি অঙ্কন এবং প্লাস্টিক শিল্পের অনুশীলনও করেছেন বলে জানা যায়। তিনি চিন্তা, শিক্ষা, ফিকহুদ দাওয়া, ইতিহাস, জীবনী, ফিকহ ও সাহিত্য বিষয়ে বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন।

 

তাঁর গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে :

  • الأسس والمنطلقات في تحليل غوامض سنة المواقف وفقه التحولات.
  • إحياء لغة الإسلام العالمية.
  • دوائر الإعادة ومراتب الإفادة.
  • سلسلة أعلام مدرسة حضرموت.
  • المستشرقون والتنويريون.
  • المناصرة والمؤازرة.
  • مستجدات فقه الدعوة إلى الله في المرحلة المعاصرة.
  • فقه الدعوة للمرأة المسلمة.
  • الطرف الأحور في تاريخ مخلاف أحور.

 

তাঁর বেশ কিছু কবিতা সংকলন রয়েছে:

  • المورد العذب
    •  الحواشي
    •  الوشاح الأحمر
    •  بكاء القلم

তাঁর কিছু গল্প ও উপন্যাস রয়েছে :

  • مدينة الفحارير
    •  الخروج من الدائرة الحمراء
    •  الحفر على جدار الذكريات


ইন্তেকাল :
সাইয়্যিদ আবু বকর আল মাশহুর রহ. ছিলেন একজন অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় বুজুর্গ। দ্বীন ও মিল্লাতের এই একনিষ্ঠ মহান খাদেম জীবনের শেষ মুহূর্তে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হন। ২০২২ সালের ২৭ জুলাই জর্ডানের রাজধানী আম্মানের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। অতঃপর তাঁকে তাঁর দেশ ইয়ামানে নিয়ে আসা হয়। ২৯ জুলাই ইয়েমানের তারইয়াম শহরের বিখ্যাত জাব্বানহ মসজিদ প্রাঙ্গণে লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে তাঁর জানাযা সম্পন্ন হয়। আল্লাহ তাআলা তাঁর এই মহান ওলীর জীবনের সকল খেদমতকে কবুল করুন এবং তাঁকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। আমিন। 

 

শেয়ার করুন:
  • জনপ্রিয়
  • সাম্প্রতিক

নির্বাচিত

Don`t copy text!