যার দোয়া ও নেক নজরের বরকত সব সময় অনুভব করি
এ এম এম বাহাউদ্দীন
যখন টেলিফোনে তার সাথে আমার শেষ কথা হয়, আমি তখন খুব সংকটকাল পার করছিলাম। সংগঠন, ইনকিলাব ইত্যাদি সব বিষয়েই বিদ্বেষ ও শত্রুতার শিকার ছিলাম। অনেক বড় ব্যক্তি ও শক্তি আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছেন। ক্ষমতা ও শক্তিমত্তার অধিকারী বহু মানুষের ধাক্কা আমাকে সইতে হয়েছে। বহু মন্ত্রী মিনিস্টারের মামলা মাথায় নিয়ে চলতে হয়েছে। এখনো নানা ধরনের অনেক মামলা চলছে। সীমাহীন বিপদ আপদ মাথার উপর দিয়ে গেছে। সংগঠন নিয়ে বড় বড় ধাক্কা এসেছে। ইনকিলাব-এর বিরুদ্ধে মারাত্মক সব ঝড় মোকাবেলা করতে হয়েছে। আদালতের প্রাঙ্গণে যাতায়াত ও হাজিরা দেওয়ার অগ্নিপরীক্ষা চলেছে। প্রাণনাশের চেষ্টা ও হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে। আল্লাহর রহমতে সব কিছুই পার হয়ে এসেছি। পীর মাশায়েখ ও উলামায়ে কেরামের দোয়ার বরকতে আল্লাহ টিকিয়ে রেখেছেন। খাস করে সাহেব কেবলা ফুলতলীর এই মুমূর্ষু অবস্থার বাহ্যিক দুর্বল অথচ আধ্যাত্মিক দৃঢ়তাপূর্ণ গভীর প্রত্যয়ী বাক্য আমাকে দৈনন্দিন জীবনে নিরন্তর প্রেরণা যোগায়। কানে ভেসে আসে ‘বাবা, আল্লাহর রহমতে কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমি দোয়া করছি।’
ব্যক্তিগতভাবে আমি একটি ঐতিহ্যবাহী উলামা মাশায়েখ পরিবারের সন্তান। আমার দাদাজি হযরত আল্লামা শাহ মুহাম্মাদ ইয়াসিন রহ. ছিলেন ঐতিহাসিক ফুরফুরা দরবারের প্রথম দিককার খলিফা। শর্ষিনার প্রথম শায়েখ হযরত শাহ নেসারউদ্দীন রহ. এর সমসাময়িক ও পীর ভাই দাদাজি সেই সময় তাজী ঘোড়ায় চড়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলামের আদর্শ বা কোরআন সুন্নাহর আলোকে মানুষের জীবন বিধান প্রচার করতেন। শিরিক ও গোমরাহীতে নিমজ্জিত বাঙালি মুসলমানকে উন্নত জীবন উপহার দেওয়ার কঠিন সংগ্রাম সাধনা ছিল তাদের জীবনের মিশন। অমুসলিম সম্প্রদায়ের মারাত্মক জুলুম, অমানবিক শোষণ, দুর্ব্যবহার, রাজা জমিদারদের অবর্ণনীয় পাশবিক আচরণের শিকার বাংলার মুসলমানদের পর্যুদস্ত জীবন ও অর্থনীতি রক্ষা এবং পুনরুজ্জীবনের মহান কাজটি আমার দাদা সাহেব ও তাঁর মতো মর্দে মুজাহিদ, সমাজকর্মী, লোকশিক্ষক, পীর-মাশায়েখরাই আঞ্জাম দিয়েছেন। তাঁর এক ভাই হযরত শায়েখ খলিলুর রহমান সাহেবও ফুরফুরার প্রধান পীর হযরত আবু বকর সিদ্দিক কোরায়শী রহ. এর খলীফা ছিলেন। তখনকার সময়ের পীর মাশায়েখগণ দুনিয়াত্যাগী ও আল্লাহমুখী ছিলেন। কোনোরূপ স্বার্থ চিন্তা ছাড়া সম্পূর্ণ আল্লাহর ওয়াস্তে তারা দীনের খেদমত করতেন। সাহেব কেবলা ফুলতলী হযরত মাওলানা আবদুল লতিফ চৌধুরী রহ.ও ছিলেন একই পথের পন্থি। তখনকার বড় বড় সব দরবারের একই নীতি আদর্শ ছিল। বর্তমান যুগের অনেকের মতো পীর মুরিদি, মানুষের হেদায়েত ও জনকল্যাণ ভাবনা বাদ দিয়ে পূর্বকার প্রভাব প্রতিপত্তি ও জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে অঢেল অর্থ সম্পদ উপার্জন করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। দুনিয়াবিমুখ সেই বুযর্গদের আজ খুব বেশি প্রয়োজন। সাহেব কেবলা ফুলতলী রহ. তাঁর সুযোগ্য সন্তানদের নিজ আদর্শের ওপর গড়ে তুলে দুনিয়াবিমুখ আধ্যাত্মিকধারা বজায় রেখেছেন। শুধু দেশে নয়, ইউরোপ আমেরিকায়ও তাঁর শিক্ষা প্রসার ও আদর্শিক আলোর বিচ্ছুরণ সমানভাবে ঘটেছে। তাঁর জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
আমার পিতা হযরত মাওলানা এম এ মান্নান রহ. নিজেও ছিলেন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। ছোটবেলা থেকে দেশের বরেণ্য উলামা মাশায়েখ ও পীর আউলিয়াদের মায়া মমতা ও আদর স্নেহে আমি বড় হয়েছি। নিজের জীবনও তাদের সান্নিধ্যে থেকে তাদের খেদমতের মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছি। ঢাকায় খতিব উবায়দুল হক জালালাবাদী রহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ও বিশেষভাবে মাওলানা মোহাম্মদ আমীনুল ইসলাম রহ. আমাকে বেশি স্নেহ করতেন। শর্ষিনাসহ দেশের প্রখ্যাত সকল দরবারের পীর সাহেবান আমার খুবই নিকটের ও শ্রদ্ধাভাজন। তবে আমার ব্যক্তিগত জীবনে সাহেব কেবলা ফুলতলী রহ.-এর স্নেহ ছায়া একটু ভিন্ন মাত্রার। আমার আব্বাও পীর সাহেব কেবলার ভক্ত ও আদর্শের সৈনিক ছিলেন। মনে পড়ে, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে যখন আমরা অনেকটাই দিকভ্রান্ত, দিশেহারা তখন সকল ষড়যন্ত্র ও বাধা বিপত্তি মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দিয়েছেন তিনি। তাঁর ঐতিহাসিক লংমার্চের ঘটনা আমি কোনোদিন ভুলবো না। তিনি প্রবল আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ও আল্লাহ প্রদত্ত দূরদৃষ্টির অধিকারী ছিলেন। তাঁর দোয়া ও আশ্বাসবাণী আমাকে অবিশ্বাস্য শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে। আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। তাঁর উত্তরাধিকারী সকলের প্রতিও আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব। সভাপতি, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন।
সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব, প্রকাশের সময় : ১৫ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০৪ এএম