প্রোজ্জ্বল আলোকবর্তিকা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

 

-আফতাব চৌধুরী

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মহান চরিত্রের অধিকারী, সুন্দর ও মার্জিত স্বভাবের প্রতিচিত্র। মহানবী (সা.) এর চরিত্র সকলের জন্যে নমুনা ও আদর্শ চরিত্র। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে: ‘‘আর আপনি তো মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত। (সূরা আল কালাম: ৪)

মহানবী (সা.) বলেন- শিষ্টাচার, মার্জিত আচরণ ও উত্তম চরিত্রসমূহের সমাপন ও পরিপূরণের উদ্দেশ্যে আমি প্রেরিত হয়েছি। বিশ্বনবী (সা.) এর চরিত্র হচ্ছে কোমল, উদার, অতিসুন্দর। কর্কশ, কঠিন ও শিষ্টাচারবর্জিত ব্যবহার মহানবী (সা.) থেকে প্রকাশ পায়নি। পরনিন্দা, অশ্লীল ও অশিষ্ট বাক্য তাঁর পবিত্র মুখ থেকে নিঃসৃত হয়নি।’’ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন ‘আল্লাহর রহমতে’ আপনি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলেন, যদি আপনি রূঢ় ও কঠোর চিত্ত হতেন তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত।’’ (সূরা আলে ইমরান: ১৫৯)

মহানবী (সা.) কারো মনে কষ্ট দিতেন না, উচ্চস্বরে বা শোরগোল করে কথা বলতেন না। তাওরাত কিতাবেও মহানবী (সা.) এর এসব গুণের উল্লেখ রয়েছে। ইমাম বুখারী (র.) এ বিষয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) থেকে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন (বুখারী শরীফ, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৮৭ দ্রষ্টব্য)। সাহাবীদের সাথে মহানবী (সা.) খোলাখুলিভাবে মেলামেশা করতেন। সাহাবীদের মনোরঞ্জনের জন্য বাস্তব হাসি-উপহাসও করতেন। তিনি বলতেন: ‘‘বাস্তব কৌতুকে কোনো দোষ নেই।’ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রফুল্লচিত্ত, উদার ও হাস্যরসপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন।’’ উল্লেখ্য, মহানবী (সা.)-এর ব্যক্তিত্বের অসাধারণ গাম্ভীর্যও ছিল। মহানবী (সা.) বলেন, ‘‘এক মাসের দূরত্ব পর্যন্তও আমার প্রভাব ও প্রতিপত্তির দ্বারা লোক প্রভাবিত হতো। এভাবে আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেছেন।’’

 মহানবী (সা.) এর হাসি-রসিকতা হতো অর্থপূর্ণ। একবার মহানবী (সা.) তাঁর ফুফু হযরত সাফিয়া (র.)-কে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘‘কোনো বুড়ো মহিলা জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’’ তা শুনে হযরত সাফিয়া (র.) বিষন্ন হৃদয়ে ফিরে যেতে উদ্যত হলে মহানবী (সা.) তাঁকে বললেন ‘‘বুড়ো মহিলা জান্নাতে যাবে না এ কথাটির ব্যাখ্যা হলো-আল্লাহ তাআলা জান্নাতী মহিলাদের সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন- আমি এদের সৃষ্টি করেছি বিশেষ রূপে। ওদেরকে করেছি কুমারী, সোহাগিনী ও সমবয়স্ক। (সূরা ওয়াকিয়া: ৩৫-৩৭)

একবার এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর কাছে সওয়ারির উদ্দেশ্যে একটি উট চাইলে তিনি বললেন- ‘‘আরোহনের জন্যে আমি তোমাকে একটি উটের বাচ্চা দেব।’’ সে ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি উটের বাচ্চা নিয়ে কি করব? মহানবী (সা.) বললেন, ‘‘সকল উটই প্রথমে বাচ্চারূপে জন্মায়।’’ একজন মরুবাসী, যার নাম উযায়হর (রা.), মহানবী (সা.) তাঁকে ভালোবাসতেন। সে গ্রাম থেকে মদীনায় এলে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্যে উপহার সাথে করে নিয়ে আসত। শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহও (সা.) তাঁকে উপহার দিতেন। একবার উযায়হর (রা.) তাঁর কিছু পণ্যদ্রব্য বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে মদীনার বাজারে এলেন এবং  বাজারে পণ্য বিক্রয় করছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) সন্তর্পণে পিছন থেকে এসে উযায়হরের চোখে হাত রেখে সাদরে জড়িয়ে ধরলেন। উযায়হর (রা.) প্রথমে চিনতে না পেরে হাউমাউ করে বলতে লাগল, ‘কে হে, আমাকে ছেড়ে দাও।’ এদিকে মহানবী (সা.) কৌতুক করে বললেন- ‘‘এ দাসটিকে কেউ ক্রয় করবে?’’ উযায়হর (র.)-এর সাথে কৌতুককারী ব্যক্তি যে স্বয়ং মহানবী (সা.) এবার তিনি তা উপলব্ধি করতে পারলেন। তাই উযায়হর (রা.) বললেন, ‘আমার মতো অধমকে কেই-বা ক্রয় করবে, আর আপনি আমাকে বিক্রয় করে কি পাবেন? আমার মূল্যই বা কত হবে? মহানবী (সা.) বললেন, ‘‘উযায়হর, আল্লাহর কাছে কিন্তু তোমার অনেক মূল্য।’’

হযরত আয়িশা (রা.) বলেন : ‘কোনো এক সফরে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সফর সঙ্গিনী হলাম। তখন আমি খুব একটা মোটাসোটা ছিলাম না। রাসূলুল্লাহ (সা.) সাথীদের বললেন, ‘‘তোমরা অগ্রগামী হও।’’ তাঁরা সামনে এগিয়ে গেলেন, কিছুদূর গেলে পর রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে দৌড় প্রতিযোগিতায় আহ্বান জানালেন। প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হল। প্রতিযোগিতায় আমি জিতে গেলাম। মহানবী (সা.) উপস্থিত ছিলেন। রাসূল (সা.)-এর একপাশে আমি, আর একপাশে ছিলেন সাওদা। আমি সাওদাকেও পায়েস খেতে বললাম কিন্তু তিনি সম্মত হলেন না। আমি বললাম, খেতে হবে, নতুবা আমি মুখমন্ডলে পায়েস মেখে দেব, তবুও তিনি আহার করতে রাজি হলেন না। আমি ঠিকই তাঁর মুখমন্ডলে পায়েস মেখে দিলাম। মহানবী (সা.) আমার কান্ড উপভোগ করে হাসলেন। অতঃপর সাওদাকে বললেন, ‘‘তুমিও এর প্রতিশোধ নাও।’’ তিনি আমার মুখমন্ডলে পায়েস মেখে দিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের এ কান্ড দেখে হাসলেন। আয়িশা (রা.) বলেন, আমার বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে আমার দেহও কিছুটা মোটা হলো।

অন্য আরেক সফরে অনুরূপভাবে মহানবী (সা.) আমাকে দৌড় প্রতিযোগিতায় আহ্বান জানালে আমি তাতে রাজী হলাম এবং দৌড় হলো। এবার প্রতিযোগিতায় মহানবী (সা.) বিজয়ী হলেন। আমি হলাম পরাজিত। মহানবী (সা.) হেসে বললেন, ‘‘এবার আগের প্রতিযোগিতার শোধ নেওয়া হলো।’’ হযরত আয়িশা (রা.) আরেকটি ঘটনার কথা বর্ণনা করেন: ‘‘একবার আমি পায়েসের মতো এক রকম খাদ্য তৈরি করে মহানবী (সা.)-এর সমীপে উপস্থিত করলাম। তখন উম্মুল মু’মিনীন সাওদা (রা.)-ও ছিলেন। মহানবী (সা.) তিনটি কাজ থেকে নিজেকে সব সময় বিরত রাখতেন-এক. লোক দেখানো কর্মকান্ড, দুই. অহংকার করা ও তিন. অনর্থক কাজ। খাদ্যদ্রব্যের নিন্দা বা অতিপ্রশংসা করা থেকে মহানবী (সা.) নিজেকে বিরত রাখতেন।

কারো মনে আঘাত দেওয়া, কারো প্রতি জোরযুলুম করাকে মহানবী (সা.) পাপ ও অপরাধ বলে গণ্য করতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আবি বকর (রা.) আরব নিবাসী জনৈক ব্যক্তির ঘটনাও বর্ণনা করেন। তাঁর ভাষ্য মতে, ‘‘হুনায়ন যুদ্ধে আমার পায়ে ছিল ভারী জুতো। ঘটনাক্রমে আমার পদচাপে মহানবী (সা.)-এর পায়ে আঘাত লাগল। অন্যায়ের জন্য মহানবী (সা.) আমাকে কষাঘাত করলেন। আমি আমার অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হলাম এবং অনুশোচনায় রাত কাটালাম। ভোরে দেখি কেউ আমাকে সন্ধান করছেন। বললেন, ‘‘অমুক ঘরে আছেন কি?’’ আমি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বের হলাম। মহানবী (সা.)-কে দেখে আমি বিস্ময় ও আনন্দে নির্বাক। মহানবী (সা.) বললেন, ‘‘গতকাল আমি তোমাকে কশাঘাত করেছি। তাই আজ আমি একটি বেতের পরিবর্তে আশিটি বেত নিয়ে এসেছি, তুমি এগুলো দিয়ে তোমার আঘাতের বদলা নাও।’’

ওফাতের আগে মহানবী (সা.) তাঁর এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘‘আমি যদি কাউকে কোনো সময় আঘাত দিয়ে থাকি তবে সে যেন অবশ্যই আঘাতের প্রতিশোধ গ্রহণ করে। তোমরা ক্ষমার পথ অবলম্বন করো, সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং অজ্ঞ লোকদের থেকে বিমূখ থাকো।’’ উক্ত আয়াতটি যখন অবর্তীণ হয়, তখন হযরত জিবরাইল (আ.) মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘আপনার  প্রতি আপনার প্রতিপালকের নির্দেশ হচ্ছে যে, আপনার সাথে যে সম্বন্ধ জুড়বে, আর যে আপনাকে বঞ্চিত করবে আপনি তাকে দান করবেন, অনুগ্রহ করবেন, আর যে ব্যক্তি আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করবে আপনি তাকে ক্ষমা করবেন।’

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘‘মুমিনের আচরণ যতক্ষণ না অনুরূপ হবে ততক্ষণ সে প্রকৃত মুসলিম হবে না।’’ একবার জনৈক মরুবাসী মহানবী (সা.)-এর পবিত্র গলায় চাদর পেঁচিয়ে টানতে লাগল। ফলে মহানবী (সা.)-এর গলায় ফাঁস পড়ার উপক্রম হলো। সে বলল : ‘হে মুহাম্মদ (সা.) আমাকে কিছু দাও।’ তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তার দিকে ফিরে হেসে হেসে তাকে কিছু দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। একবার এক মরুবাসী মসজিদে প্রস্রাব করতে লাগল। উপস্থিত সাহাবীগণের কেউ তাকে মারধর করতে চাইলে মহানবী (সা.)  তাদের এরূপ করতে নিষেধ করলেন। তিনি বললেন, ‘‘তাকে মারধর না-করে প্রশ্রাবের পর পানি এনে মসজিদ পরিস্কার করো (কারণ সে-অজ্ঞ, মসজিদের আদব জানে না)। তোমরা মানুষের প্রতি সরল ব্যবহারের জন্যে এসেছো কঠোর ব্যবহারের জন্য নয়’’।

কয়েকজন ইয়াহুদী একবার মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে ধূর্তামি করে ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর পরিবর্তে ‘আসসামু আলাইকুম’ বললো, যার অর্থ তোমার মৃত্যু হোক। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা (রা.) তাদের এ চালাকীর উত্তরে বললেন ‘‘তোমাদের মৃত্যু হোক, আর বর্ষিত হোক তোমাদের ওপর আল্লাহর লানত ও ক্রোধ।’’ মহানবী (সা.) বললেন ‘‘হে আয়িশা! থামো, কঠোরতা ও কটুবাক্যের পরিবর্তে নম্রতা অবলম্বন কর।’’ তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল। ইয়াহুদী কি বলেছে তা কি আপনি শুনেননি?’ মহানবী (সা.) বললেন, ‘‘আমি উত্তরে বলেছি, عليكم, এটা কি তুমি শোননি? আমার দুআ আল্লাহর নিকট কবূল হবে কিন্তু এদের দুআ কবূল হবে না। (এটাই যথেষ্ট)

এক মন্দ স্বভাবের লোককে একবার মহানবী (সা.)-এর কাছে আসতে দেখে মহনবী (সা.) হযরত আয়িশা (রা.)-কে বললেন, আগন্তুক ব্যক্তিটি মন্দ লোক বটে, কিন্তু সে এলে মহানবী (সা.) হাসিমুখে তাকে অভ্যর্থনা জানালেন, ভালো ব্যবহার করলেন, খোলাখুলিভাবে তার সাথে আলাপ করলেন। লোকটি চলে গেলে হযরত আয়িশা (রা.) মন্দ লোকের সাথে এরূপ ব্যবহারের হেতু জানতে চাইলে মহানবী (সা.) বললেন, ‘‘হে আয়িশা, তুমি আমাকে কবে উগ্র কঠোর পেয়েছ এবং দুর্বাক্য ব্যবহার করতে দেখেছ? মন্দ স্বভাবের জন্য যাকে লোকে বর্জন করে, আল্লাহর কাছে সেই অধিক নিকৃষ্ট ব্যক্তি।’’

 

 [লেখক: প্রবীণ সংবাদিক;

জীবন সদস্য, বাংলা একাডেমী, ঢাকা ও সিলেট প্রেসক্লাব]

শেয়ার করুন:
  • জনপ্রিয়
  • সাম্প্রতিক

নির্বাচিত

Don`t copy text!