শায়খ আহমদ হিজাযী মক্কী (র.) : সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
খায়রুল হুদা খান
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুযুর্গ, উস্তাযুল উলামা ওয়াল মুহাদ্দিসীন, রঈসুল কুররা ওয়াল মুফাস্সিরীন শামসুল উলামা হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ছিলেন ইলমে দ্বীনের বহুমুখী এক প্রতিভা। ইলমে হাদীস, ইলমে তাসাওউফ এবং ইলমে কিরাতে তাঁর সনদ সুপ্রসিদ্ধ। প্রত্যেকটি বিষয়েই তাঁর উস্তাদগণ ছিলেন জগদ্বিখ্যাত ও সুপরিচিত। ইলমে কিরাতে তিনি তিন তিনটি সনদে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে সম্পৃক্ত। তাঁর কিরাতের উস্তাদগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মক্কা শরীফের প্রখ্যাত বুযুর্গ, মালিকী মাযহাবের সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ, হারামাইন শরীফাইনের কারীগণের প্রধান, শায়খ আহমদ হিজাযী মক্কী (র.)। আজকের এ নিবন্ধে তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো।
জন্ম ও বংশ পরিচিতি
তিনি হলেন হাফিয ফকীহ শায়খ আহমদ হিজাযী বিন আবদুল্লাহ বিন মাহমুদ বিন আবূ তালীহ আবদুল ‘আল আত-তাহতাওয়ী। বংশসূত্রে হিজাযী। তিনি ১৩০৩ হিজরী (১৮৮৫ইং) সালে মিশরের সোহাগ প্রদেশের তাহতা শহরে একটি রক্ষণশীল ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ আরবের জুহাইনাহ গোত্রীয় ছিলেন, যারা হিজায থেকে মিশরে পাড়ি জমিয়েছিলেন। এ কারণে তিনি হিজাযী নামে পরিচিত হন। শৈশবকালেই তিনি মা-বাবা হারিয়ে এতীম অবস্থায় প্রতিপালিত হন।
শিক্ষাজীবন
তিনি সোহাগ শহরেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং প্রথমে সাত কিরাতে কুরআন মজীদ হিফয করেন এবং পরে দশ কিরাতে পারদর্শিতা লাভ করেন। তিনি ইমাম হাফস (র.)-এর কিরাত অনুযায়ী তাজবীদ শাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি মিশরের বিশ্বখ্যাত আল আযহার বিশ^বিদ্যালয়ে ‘আল ফিকহ ওয়াল উলূম আদ দ্বীনিয়্যাহ’ অধ্যয়ন করেন এবং তাঁর শায়খ ও মুরব্বী শায়খ আল্লামা আযহারী আহমদ আদ-দারদীর (র.)-এর তত্ত্বাবধানে একজন হাফিয, কারী এবং ফকীহ হিসেবে ডিগ্রী লাভ করেন।
মক্কা শরীফে আগমন
ডিগ্রী অর্জনের পর শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) হিজাযে ফিরে আসেন। সে সময় হিজায তুর্কী শাসনাধীন ছিল। বাল্যকালে প্রবল রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মরণাপন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। এ সময় তিনি সুস্থ হলে আল্লাহর ঘরের পাশে বসবাস করার মানত করেন। তাঁর মানত অনুযায়ী তিনি হজ্জ আদায় এবং মক্কা শরীফে বায়তুল্লাহর পাশে বসবাসের সংকল্প নিয়ে যখন মক্কা শরীফে ফিরে আসেন তখন তাঁর বয়স ছিল ১৮ বছর।
পারিবারিক জীবন
শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) মক্কা শরীফে বসবাস করছিলেন কিন্তু প্রথমে বিবাহ করতে চাননি। পরবর্তীতে আত্মীয়-স্বজনের পীড়াপীড়িতে তিনি সারহান গোত্রে বিবাহ করেন; তবে তাঁর সে স্ত্রী ছিলেন বন্ধ্যা। ফলে পরবর্তীতে তিনি আল-আব্বাস সায়্যিদ নাজমুদ্দীন কারী এর মেয়েকে বিবাহ করেন। তাঁর এ স্ত্রীর ঘরে মুহাম্মদ আমীন এবং আবদুল্লাহ নামে দুই ছেলে এবং আমীনাহ, নাঈমাহ ও খায়রিয়াহ নামে তিনজন কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তাঁর এ স্ত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ইন্তেকাল করেন। পরবর্তীতে তিনি আরেকটি বিবাহ করেন, যা বেশি দিন টিকেনি। পরবর্তীতে তিনি তাঁর সর্বশেষ স্ত্রী রাহমাকে বিবাহ করেন, যিনি ছিলেন তায়েফের অধিবাসী উমর সাব্বাগের মেয়ে। এ স্ত্রীর ঘরে তাঁর সাতজন কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তাঁরা হলেন ফাতিমা, যায়নাব, আসমা, খাদীজাহ, নাযীমাহ, হুদা এবং সাফিয়্যাহ।
দৈহিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি
শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) ছিলেন সুঠাম দেহী, প্রশস্ত কপাল, উচ্চ বক্ষ ও বিস্তৃত গর্দান বিশিষ্ট। তাঁর চেহারা ছিলো জ্যোতির্ময়, আলোকোজ্জ্বল। তিনি ছিলেন সৎকর্মশীল, পরোপকারী, নেক কাজে সবসময় সচেষ্ট। তাঁর চেহারায় বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানের রশ্মি সবসময় বিরাজ করত। তিনি বাগ্মীতা, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা এবং সুমিষ্ট বয়ানে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। বাল্যকাল থেকে তিনি প্রখর দৃষ্টি, দীর্ঘ সাঁতার এবং নদীর গভীরে ডুব দেয়ায় প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন।
ইলমে কিরাতে তাঁর অবদান
হযরত আহমদ হিজাযী মক্কী (র.) অত্যন্ত সুমধুর আওয়াজের অধিকারী ছিলেন। তাঁর সুমধুর ও সুললিত কন্ঠে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত শ্রবণ করার জন্য মক্কা শরীফের হারাম এবং পাশর্^বর্তী এলাকার জনসাধারণ, শিক্ষার্থী এবং হারাম শরীফে হজ্জ-উমরাহ আদায়কারীগণ প্রতিদিন আসর এবং মাগরিব নামাযের পরে মসজিদে হারামে বাবে আজইয়াদের নিকটে তাঁর চতুর্পাশের্^ ভীড় করতেন। তাঁর চিত্তাকর্ষক আওয়াজ এতো উচ্চ ছিল যে মসজিদে হারামের বাইরে থেকে তাঁর কুরআন তিলাওয়াত শোনা যেত। অথচ তখন পর্যন্ত মাইক বা লাউড স্পীকারের সূচনা হয়নি। তাছাড়া তিনি মসজিদে
হারামের বাবে বনী শায়বার সম্মুখে প্রতিদিন বিভিন্ন কিরাতে হাফিযে কুরআনদের সবক গ্রহণ করতেন।
তাজবীদ ও তারতীলসহ তাঁর সুমধুর তিলাওত এবং হিফযে কুরআনে পারদর্শিতা দেখে তৎকালীন মক্কা শরীফের তুর্কি গভর্নর আকৃষ্ট হন এবং তাঁর হাতে কুরআন মজীদ শিক্ষা গ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) তুর্কী গভর্নরকে কুরআন শিক্ষা দিতে রাজী হন এবং ইমাম হাফস (র.)-এর কিরাত অনুযায়ী কুরআন শিক্ষা দিতে আরম্ভ করেন। তুর্কি গভর্নরের প্রভাবে অনেক শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে গেলে শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) তাদেরকেও শিক্ষা দিতে থাকেন। কিছুদিন পর তুর্কী গভর্নর শায়খ আহমদ হিজাযী (র.)-কে তায়েফে অবস্থিত সেনাবাহিনী হেডকোয়ার্টারের ইমাম মনোনীত করলেন এবং সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষকে কুরআন শিক্ষা দেয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করলেন। এর ফলে তায়েফবাসীগণ তাঁর হাতে কুরআন মজীদ শিক্ষা ও হিফ্য করার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করল। তাঁর এ নিরলস ও একনিষ্ঠ খিদমতের মাধ্যমে তিনি তায়েফবাসীর ভালবাসার পাত্রে পরিণত হলেন।
কিন্তু শায়খ আহমদ হিজাযী (র.)-এর মন মসজিদে হারামে ফিরে আসার জন্য ছটফট করতে লাগল। ১৩৩১ হিজরীর শেষ দিকে এবং ১৩৩২ হিজরীর প্রথমদিকে (১৯১৩ ইং) তুর্কী শাসনের অবসান হয়ে গেলে শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) মক্কা শরীফে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে তিনি কুরআন শিক্ষা দানের জন্য পূর্ব এশিয়ায় সফর করেন। সে সময় তিনি ক্রুআন কারীমের প্রতি মালয় এবং সিঙ্গাপুরের সুলতানগণ এবং সাধারণ জনসাধারণের নিখাঁদ ভালোবাসা, কুরআন মজীদ শিক্ষা ও হিফ্যের জন্য তাঁদের প্রচেষ্টা এমনকি কুরআন কারীমের সম্মানার্থে তাদের বিভিন্ন মাহফিল আয়োজন দেখে অভিভূত হন। ফলে তিনি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে বিভিন্ন শহরে শহরে এবং গ্রামে গ্রামে সফর করতে থাকেন এবং কুরআন মজীদ শিক্ষা দিতে থাকেন। তিনি যেখানেই যেতেন বিভিন্ন বয়সী কুরআন পিপাসু শিক্ষার্থীরা তাঁর পাশে এসে জড়ো হতেন।
হাশিমী শাসনকালে (১৯১৬-১৯২৫) শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) মক্কা শরীফে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরে আসেন এবং হারাম শরীফের অধিবাসী ও তাঁর কাছে আগত শিক্ষার্থীদের তিনি নিজ ঘরে কুরআন শিক্ষা দিতে থাকেন। এ সময় হিজাযের শাসক শরীফ হুসাইন বিন আলীর শাসনামলে তাঁকে জেদ্দা শহরের মাদরাসায়ে রুশদিয়ার প্রাথমিক শাখার প্রধান মনোনীত করা হয়। এ মাদ্রাসায় তাঁর সাথে শিক্ষক হিসেবে ছিলেন শায়খ সাদাকাহ মানসূরী, শায়খ আবদুল হামিদ আতিয়াহ, শায়খ মুস্তাফা দাগিস্তানী, সায়্যিদ হুসাইন যায়নী প্রমুখ। এ মাদ্রাসায় তাঁর হাতে কুরআন কারীমের শিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন শায়খ উমর ইবনে আফিনদী মুহাম্মাদ নাসীফ, শায়খ মুহাম্মাদ নূর ইবনে শায়খ আহমদ নাসসহ হিজায ও জেদ্দার অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গ। তিনি জেদ্দার মাদরাসায়ে রুশদিয়াতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে ছয় বছরের বেশি সময় অতিবাহিত করেন।
১৩৪০ হিজরীতে তাঁর স্ত্রী (তাঁর ৩ সন্তানের মা) মারা গেলে তাঁকে জেদ্দার মাদ্রাসার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে মক্কা শরীফে ফিরে আসতে হয়। আগের মতোই তিনি মসজিদে হারামে এবং তাঁর নিজ ঘরে কুরআন কারীম শিক্ষা দিতে থাকেন। এ সময় সিঙ্গাপুর এবং মালয় থেকে কিছু কিরাতের শিক্ষার্থী মক্কা শরীফে আসেন এবং শায়খ আহমদ হিজাযী (র.)-কে তাদের সাথে যেতে অনুরোধ করেন, যাতে তিনি কুরআন করীমের সে র্দস পূর্ণ করেন যা তিনি পূর্বে আরম্ভ করেছিলেন। তাদের অনুরোধে পরিবারের কঠিন সময় থাকা সত্ত্বেও তিনি আল্লাহর উপর ভরসা করে ১৩৪২ হিজরীতে (১৯২৩ ইং) পূর্ব এশিয়ায় সফর করেন এবং বেশ কয়েক বছর অবস্থান করেন। ইতিমধ্যে আরবে হাশিমী শাসনের পতন হয় এবং বাদশাহ আবদুল আজিজ সৌদী শাসনের গোড়াপত্তন করেন। শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে অসংখ্য কারী, হাফিয এবং ফকীহ তৈরী করে আবার মক্কা শরীফে ফিরে আসেন।
শায়খ আহমদ হিজাযী আল ফকীহ (র.) ১৩৫৩ হিজরীতে (১৯৩৪ ইং) ফিক্হ বোর্ডের প্রধান (গ্রান্ড মুফতী) মনোনীত হন এবং শিক্ষা ও কিরাত বোর্ডের প্রধানের দায়িত্বও লাভ করেন। তদুপরি শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) কুরআন শিক্ষা দানে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। তিনি তাঁর ঘরকে কুরআন কারীমের বিশুদ্ধ তিলাওত ও হিফয শিক্ষাদানের কেন্দ্র হিসেবে পরিণত করেছিলেন, যেখানে তিনি দিনের বেশিরভাগ সময় স্থানীয় অধিবাসীদের ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, বাংলা, বুখারা, তুরস্ক ইত্যাদি দেশ থেকে হজ্জ কিংবা উমরাহ আদায় করতে আসা কুরআন পিপাসুদের কিরাত, হিফয ও ফিক্হ শিক্ষা দিতেন। সাধারণত তিনি ইমাম হাফস (র.)-এর কিরাত অনুযায়ী কিরাত শিক্ষা দিতেন। কোনো কোনো বিশেষ শিক্ষার্থীকে তিনি ইমাম শাতিবী (র.)-এর পদ্ধতি অনুযায়ী সাত কিরাতও শিক্ষা দিতেন।
শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) কিরাত ও তাজবীদ শাস্ত্রের উপর কয়েকটি কিতাব রচনা করেছেন। এর মধ্যে প্রসিদ্ধ হলো ‘আল কাউলুস সাদীদ ফী আহকামিত তাজবীদ’, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
শায়খ আহমদ হিজাযী (র.)-এর সবচেয়ে ঘনিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন একাধারে তাঁর শায়খ ও বন্ধু শায়খ আহমদ হামিদ আত-তীজী, যিনি মক্কা মুকাররামার ‘মাদরাসাতুল ফালাহ’-এ ইলমে কিরাতের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিও মক্কা মুকাররামার ‘শায়খুল কুররা’ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন।
প্রখ্যাত ছাত্রবৃন্দ
শায়খ আহমদ হিজাযী (র.)-এর হাতে অনেক বিখ্যাত কারী ও মুজাব্বিদ কিরাত শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। তাঁর প্রখ্যাত শাগরিদদের মধ্যে রয়েছেন তাঁর দুই ছেলে মুহাম্মদ আমীন ও আবদুল্লাহ, শায়খুল কুররা শায়খ আহমদ যাকী দাগিস্তানী, শায়খুল কুররা আব্বাস মাকাদিমী, শায়খুল কুররা জামীল আশী, শাইখুল কুররা মুহাম্মদ সালিহ বাহায়দারাহ, শায়খুল কুররা মুহাম্মাদ কুহায়লী, শায়খ আবদুল হামিদ হায়াত, শায়খ আহমদ সা’দুল্লাহ, শায়খ মুহাম্মদ আন-নূনূ, শায়খ আবদুল হামীদ গুন্দুরাহ, শায়খ জাফর জামীল আল বারমাকী প্রমুখ। তাঁর কাছে অনেক কুররা ও উলামা ফিক্হ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন। তাঁদের মধ্যে শায়খুল কুররা আল ফকীহ শায়খ মুহাম্মদ নূর আবুল খায়র, শায়খ উমর আল ফকীহ, শায়খ সিরাজ কারুত আল ফকীহ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
অনেক অনারবও তাঁর হাতে কুরআন মজীদ শিক্ষাগ্রহণ করে সনদ লাভ করেছেন। তাঁদের মধ্যে ইলমে কিরাতে সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন হযরত আল্লামা আব্দুল লতীফ ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.), যিনি বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কিরাত শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছেন। এছাড়া আরবের বাইরে তাঁর উল্লেখযোগ্য শাগরিদদের মধ্যে রয়েছেন- শায়খ মুহাম্মদ মাসুম, শায়খ মুহাম্মাদ তাহের জাওয়া, শায়খ আশহাদ আলী বিন মুহাম্মদ সাদির বাঙ্গালী, শায়খ মুস্তাফা রাওয়াস প্রমুখ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর নিকট থেকে ইলমে ফিকহও শিক্ষাগ্রহণ করেছেন।
আহমদ হিজাযী (র.)-এর দরবারে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)
শামসুল উলামা হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) স্বীয় পীর ও মুরশিদ হযরত শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (র.)-এর কাছ থেকে ইলমে কিরাতের সনদ লাভ করেন। পরবর্তীতে পীর ও মুরশিদের নির্দেশে হযরত শাহ আবদুর রউফ করমপুরী (র.)-এর কাছে কুরআন অধ্যয়ন করে সনদ লাভ করেন। তাঁদের দুজনেরই সনদ শায়খুল ইসলাম যাকারিয়া আল আনসারী (র.) হয়ে ইমাম আবূ আমরিদ্দানী (র.) পর্যন্ত পৌঁছেছে।
কুরআন কারীমের এ আশিক ১৯৪৪ ইং (১৩৬৩ হিজরী) সনে হজ্জ করতে মক্কা শরীফে গেলে শায়খ আহমদ হিজাযী (র.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং ইলমে কিরাতে তাঁর পারদর্শিতা ও খ্যাতির কথা শুনে তাঁর কাছে কুরআন মজীদ শিক্ষা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু ছাহেব কিবলাহ (র.) হিন্দ (ভারত) থেকে এসেছেন জানতে পেরে তিনি কিরাত শুনতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। কারণ তৎকালীন সময় এতদঞ্চলে বিশুদ্ধ তিলাওয়াত ছিল না বললেই চলে। এমনকি কোনো কোনো এলাকায় কুরআন কারীমের হরফ পর্যন্ত পরিবর্তন করে পড়া হতো। তখন হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) জানালেন যে, তিনি হযরত হাফিয আবদুর রউফ করমপুরী (র.)-এর কাছে কিরাত শিক্ষা করেছেন, যিনি শায়খ ইরকসুস আল মিসরী (র.)-এর ছাত্র। শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) ইরকসুস আল মিসরীর কথা শুনেই হযরত ছাহেব কিবলাহকে জড়িয়ে ধরলেন এবং তাঁকে কিরাত শিক্ষা দিতে আগ্রহী হলেন। এ সফরে হযরত ছাহেব কিবলাহ (র.) শায়খ আহমদ হিজাযী (র.)-এর কাছে কুরআন কারীমের অর্ধেক পাঠ করে শুনান। পরবর্তীতে ১৯৪৬ ইং (১৩৬৫ হিজরী) সনে আবার মক্কা শরীফে গিয়ে বাকি অর্ধেক পাঠ করে শুনালে শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-কে কিরাতের সনদ দান করেন। সনদ প্রদানকালে শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, “এ সনদ একটি আমানত, যে আমানত আমার ইলমে কিরাতের উস্তাদ ও বুযুর্গগণ আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আজ আমি তা তোমার হাতে সোপর্দ করলাম। যদি এ আমানতের হ্রাস-বৃদ্ধিজনিত খেয়ানত করো, তবে এর পরিণাম ফল তুমিই ভোগ করবে। কারণ আজমে (অনারব দেশে) এখন হরফের উচ্চারণ ও পঠন পদ্ধতি বিষয়ে নানারকম মতভেদ দেখা দিয়েছে।”
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) যোগ্য শায়খের যোগ্যতম শাগরিদ হিসেবে তাঁর দেয়া সে আমানত যথাযথভাবে রক্ষা করেছেন এবং বিশুদ্ধ কিরাত শিক্ষাদানের দায়িত্ব আনজাম দিয়ে গেছেন জীবনভর। যার ফলশ্রুতিতে আজ দুনিয়াব্যাপী তাঁর ইলমে কিরাতের খিদমত একটি মকবূল খিদমত হিসেবে সুপরিচিত।
শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) থেকে সনদ লাভ করে দেশে ফেরার পর হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) তৎকালীন প্রথিতযশা এক বুযুর্গ কর্তৃক স্বপ্নযোগে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছ থেকে ইশারা পেয়ে ইলমে কিরাত শিক্ষা দিতে আরম্ভ করেন। সমকালীন উলামা-মুদাররিসীন ও শিক্ষার্থীবৃন্দ তার নিকট কিরাত শিক্ষার জন্য জমা হতে থাকেন। এ সময় উলামায়ে কিরাম তাজবীদ বিষয়ক একটি কিতাবের প্রয়োজনীয়তা হযরত ছাহেব কিবলাহর কাছে উল্লেখ করলেন এবং একটি কিতাব প্রণয়নের জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। আমানতদারীর কথা চিন্তা করে হযরত ছাহেব কিবলাহ (র.) নিজের স্মৃতির উপর নির্ভর করে কিতাব লিখতে চাইলেন না। ইতিমধ্যে তাঁর সেই চিন্তার অবসান ঘটিয়ে তাঁর উস্তাদ শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) হাজীদের মাধ্যমে তাঁর নিজের লিখিত তাজবীদ বিষয়ক ২টি কিতাব হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর নিকট পাঠালেন। সাধারণ পাঠকের জন্য সহজবোধ্য নয় এমন উচ্চাঙ্গেও আরবী ভাষায় কিতাবগুলো লিখিত থাকায় হযরত ছাহেব কিবলাহ (র.) উলামা-সাধারণের জন্য সহজ উর্দূ ভাষায় কিতাবের কায়দাগুলিকে ব্যাখ্যা করে একটি কিতাব রচনা করেন। উস্তাদের কিতাবের নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তিনি এর নাম রাখলেন “আল কাউলুছ ছাদীদ ফিল কিরাআতি ওয়াত তাজবীদ”। পরবর্তীতে তাঁরই বড় ছাহেবজাদা হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী (বড় ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী) কিতাবখানার বাংলা অনুবাদ করেন। ইতিমধ্যে ইংরেজি ভাষায়ও তা অনূদিত হয়ে লাখো কুরআন পিপাসুর তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে।
ইন্তিকাল
শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) মক্কা শরীফের কারী ও ফকীহগণের প্রধান (শাইখুল কুররা ও রাঈসুল ফুকাহা) হিসেবে প্রায় ২৮ বছর মহান খেদমত আঞ্জাম দিয়ে ১৩৮১ হিজরী (১৯৬২ ইং) সালের রজব মাসের ৫ তারিখ ভোরবেলা ইন্তেকাল করেন। চিরায়ত অভ্যাস অনুযায়ী ইন্তেকালের রাতেও তিনি রাতব্যাপী কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করেন এবং ভোরবেলা মক্কা শরীফের আজইয়াদ এলাকার জাবালে সাব‘আ বানাতে নিজ ঘরে ইন্তিকাল করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তাঁর পবিত্র দেহ মক্কা শরীফের কবরস্থান ‘জান্নাতুল মুআল্লা’য় দাফন করা হয়।
সন্তান-সন্ততি
শায়খ আহমদ হিজাযী (র.) দুই পুত্র এবং দশজন কন্যা সন্তান রেখে যান। তাঁর পুত্র শায়খ মুহাম্মদ আমীন হিজাযী এবং শায়খ আবদুল্লাহ হিজাযী উভয়েই প্রথিতযশা হাফিয, কারী এবং ফকীহ; বিশেষত ফারাইয এবং মীরাস শাস্ত্রে পারদর্শী। তাঁর দশ কন্যা সন্তানের প্রত্যেকেই নেককার, উত্তম চরিত্র ও বৈশিষ্টের অধিকারী। তেমনিভাবে তাঁদের সন্তানেরাও শিক্ষা-দীক্ষা, যোগ্যতা ও পারদর্শিতায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত আছেন।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনের এ মহান খাদিমকে জান্নাতে আ’লা মাকাম নসীব করুন। আমীন।