গওসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলাইহি

অধ্যাপক  হাসান আবদুল কাইয়ূম

শরী’আত তরীকত হকীকত ও মা’রিফাতের সমন্বয়ে যে ইলম সমন্বিত ও বিকশিত হয়েছে তাকে বলা হয় ‘ইলমে তাসাওউফ বা তাসাওউফ বিজ্ঞান। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম থেকেই ইলমে তাসাওউফ চর্চা সূচিত হয়েছে। 

কুরআন মজীদে যে তাযকী য়ায়ে নফ্স এবং হাদীস শরীফে যে ইহ্সানের কথা বলা হয়েছে সেটাই মূলত তাসাওউফের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। তাসাওইফ চর্চায় বিভিন্ন পদ্ধতি কালক্রমে কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিন্যাসিত হয়েছে যেগুলো তরীকা নামে পরিচিত। কাদিরীয়া তরীকা তরীকাসমূহের মধ্যে বহুল প্রচলিত। 

কাদিরীয়া তরীকার ইমাম হচ্ছেন গওসুল আযম আবূ মুহম্মদ মুহিউদ্দীন সৈয়দ আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি। তিনি গওসুল আযম হিসেবেই বিশ্বজুড়ে সমধিক পরিচিত। বাংলাদেশে তাঁকে বড়পীর বলা হয়। 

গওসুল আযম হযরত আবদুল কাদির জিলানীর ওফাত দিবস পালিত হয় ফাতিহায়ে ইয়াজদহম নামে। ৫৬১ হিজরী মুতাবিক ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ রবিউস সানী সোমবার রাতের শেষ প্রহরে তিনি ইন্তিকাল করেন। যে কারণে এই ইয়াজদহম অর্থাৎ ১১ বলতে ১১ রবিউস সানীকেই বুঝানো হয় এবং ইয়াজদহম বা ১১ এমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় যে, অনেক কাদিরীয়া খানকা শরীফে প্রত্যেক আরবী মাসগুলোর ১১ তারিখে এগারো শরীফ বা গিয়ারা শরীফ পালিত হয়। 

গওসুল আযম আবূ মুহম্মদ মুহিউদ্দীন সৈয়দ আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে আবির্ভুত হন যখন গ্রিক ও ভিনধর্মী দর্শন মুসলিম শিক্ষা ও চিন্তা জগতে বিভ্রান্তির কালো থাবা বিস্তার করছিল। শিরক, কুফর ও বিদ’আত নিত্যনবরূপে সঞ্চারিত হচ্ছিল মুসলিম মননে। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। তওহীদ ও রিসালতের পথ থেকে কেউ কেউ ছিটকে পড়ার উপক্রমে নিপাতিত হচ্ছিল। অন্যদিকে খ্রীস্টান জগত তদানিন্তন মসুলিম দুনিয়াকে ধ্বংস করবার জন্য সংঘবদ্ধ হবার চেষ্টায় মেতে উঠছিল। সেই সময় তাঁর মতো একজন মুজাদ্দিদের, একজন মহান সংস্কারকের, একজন পথ প্রদর্শকের, একজন মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হওয়া খুবই জরুরী হয়ে পড়েছিল। একজন মহান গওস, একজন গওসুল আযম, একজন দ্বীনকে পুনর্জীবিতকারি  তথা মুহিউদ্দীন হয়ে তিনি আবির্ভূত হলেন। 

তিনি জন্মগ্রহণ করে ১০৭৭ খ্রিস্টাব্দ মুতাবিক ৪৭০ হিজরীর রমাদান মাসের পহেলা তারিখ সাহরীর ওয়াক্তে পারস্যের অনত্মর্গত কাস্পিয়ান সাগরের উপকূলবর্তী জিলান বা গীলান অঞ্চলের নায়ক নামক স্থানে হযরত ইমাম হাসান রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুর বংশ ধারায় এক ঐতিহ্যবাহী সৈয়দ পরিবারে। তার আম্মাজান সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতিমা রহমাতুল্লাহি আলায়হাও ছিলেন হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুর বংশধারার এক ঐতিহ্যবাহী সৈয়দ পরিবারের কন্যা। 

গওসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হির আব্বাজান সৈয়দ আবূ সালিহ্ মূসা জঙ্গি রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন সে যুগের একজন বিখ্যাত সূফী এবং আম্মাজানও ছিলেন মশহুর হাফিজা ও আবিদা। 

গওসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হি শৈশবেই পিতৃহারা হন, অতি শৈশবেই তিনি কুরআন মজীদ হিফজ করেন। ভিন্নমতে মাতৃগর্ভ থাকাকালেই কুরআন মজীদের ১৮ পারা হিফজ করেন কারণ তাঁর আম্মাজান হাফিজা ছিলেন, তাঁর অসাধারণ প্রতিভার কথা তাঁর শৈশবকালেই ছড়িয়ে পড়ে। 

তিনি মায়ের কাছ থেকে কুরআন-হাদীসের প্রাথমিক ইলম হাসিল করেন এবং স্থানীয় মাদরাসায় ভর্তি হয়ে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে লেখাপড়া করে ইসলাম বিষয়ে প্রচুর জ্ঞান লাভ করেন অতঃপর উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য বাগদাদ শরীফ গমন করেন। বাগদাদ শরীফে যাবার পথে তিনি একদল ডাকাতের মুখোমুখি হন। তাঁর সত্যবাদিতা দেখে ডাকাত দল বিস্ময়ে অভিভূত হয় এবং তওবা করে ডাকাতি করা ছেড়ে দেয় ও পুরো ইসলামী জীবনে ফিরে আসে। ডাকাত দলের মধ্যে এই পরিবর্তন আনয়ন করা যে গওসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হির একটা বড় কারামত তা বলাই যায়। 

তিনি বাগদাদ শরীফে এসে এখানকার যুগ শ্রেষ্ঠ আলিমগণের কাছ থেকে উচ্চতর বিদ্যা অর্জন করেন এবং ইলমে জাহিরের সর্ববিষয়ে অগাধ পান্ডিত্য অর্জন করেন। প্রথমে তিনি ইলমে তাসাওউয়ের তা’লীম গ্রহণ করেন বিখ্যাত সূফী হযরত আবুল মুহম্মদ আদ্দাব্বাস রহমাতুল্লাহি আলায়হির নিকট থেকে। হযরত আবূ খায়ের মুহম্মদ আদ্দাব্বাস রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর রূহানী শক্তির ঔজ্জ্বল্য অবলোকন করে বলেছিলেন : আবদুল কাদিরের মধ্যে এমন এক প্রতিভা রয়েছে যা তাঁকে অচিরেই কামালিয়তের উচ্চ-মাকামে অধিষ্ঠিত করবে এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সূফীতে পরিণত করবে। 

গওসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হি আল্লাহ্‌র নৈকট্য ও সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য কামালতের উচ্চ মাকামে পৌঁছুতে কঠোর পরিশ্রম করেন। এমনকি জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে মুরাকারা-মুশাহাদা রত হন। তিনি এই সময় খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দেন, গাছের পাতা খেয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করেন। জানা যায়, অনেক বছর তিনি বাগদাদ শরীফের বাইরে টিলার উপর একটা জীর্ণ কুটিরে অবস্থান করে ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেন। একদিন তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, ৪১ দিন তিনি পানাহার করবেন না। যদি আল্লাহ্‌র তরফ থেকে কেউ এসে তাঁর মুখে খাবার নিজ হাতে খাবার তুলে দেন তাহলে তিনি খাদ্য গ্রহণ করবেন। এইভাবে চল্লিশ দিন অতিবাহিত হলো। এক চল্লিশ দিনে বাগদাদ শরীফের প্রখ্যাত আলিম ও পূর্ণ কামালত প্রাপ্ত সূফী হযরত আবূ সাঈদ মাখযুমী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এসে তাঁর মুখে নিজ হাতে খাবার তুলে দিলে তিনি তা গ্রহণ করলেন। তিনি তাঁকে নিজ গৃহে নিয়ে গেলেন এবং তাঁর মুরীদ করে নিলেন। এই মহান সূফীর কাছ থেকে জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাসাওউফে পূর্ণতা হাসিলের সনদ প্রাপ্ত হন এবং পীরত্বের খিরকা লাভ করেন। 

মুহিউদ্দীন সৈয়দ আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির কামালিয়তের কথা বিদ্যুৎ বেগে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর দরবারে লোকজনের ভিড় দিনকে দিন বাড়তেই লাগল। একদিন স্বপ্নে সরকারে দোলাম নূরে মুজাসসাম প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাকে ওয়াজ করে মানুষকে সৎপথের দিশা দিবার নির্দেশ দিলেন। এরপর থেকে তিনি সপ্তাহে তিনদিন ওয়াজ মহফিলের আয়োজন করতেন। তাঁর ওয়াজ শোনবার জন্য সর্বস্তরের মানুষ দলে দলে এসে সমবেত হতো। তিনি অতি উত্তম বাগ্মিপুরুষ  ছিলেন। লোকজন তাঁর মধুর বাণী এবং সুমিষ্ট ওয়ায ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোহিত হয়ে শুনত। তাঁর ওয়াজে এমন এক মোহনীয় শক্তি ছিল যা শুনে সবাই লাভবান হতো। 

গওসুল আযম আবূ মুহম্মদ মুহিউদ্দীন সৈয়দ আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বিন্যাসিত কাদিরীয়া তরীকা তিন ধারায় এসে তাতে সমন্বিত হয়েছে। প্রত্যেক ধারার মূল উৎস প্রিয় নবী সাল্লাল্লহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। একটি ধারা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম থেকে হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহু হয়ে পরম্পরাগতভাবে গওসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হি পর্যন্ত পৌঁছে। একইভাবে দ্বিতীয় ধারাটি হযরত আবূ বকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু হয়ে তাঁর নিকট পৌঁছে। তৃতীয় ধারাটি হযরত খিযির আলায়হিস সালামের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই তিনটি নিসবত লাভ করেন গওসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হি। এই তিনটি নিসবতের সমন্বয় ঘটেছে কাদিরীয়া তরীকা। কাদিরীয়া তরীকা প্রসারিত হয়েছে পৃথিবীর সর্বত্র। এটাই শ্রেষ্ঠ তরীকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সারা পৃথিবীতে কাদিরীয়া তরীকার নিসবত বা সম্বন্ধ অনুযায়ী অসংখ্য খানকা শরীফ রয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় সবগুলো দেশে বিশেষ করে মিসর, লিবিয়া, সুদান, নাইজার, নাইজিরিয়া, মালী, তিউনিসিয়া, মরক্কো, মৌরিতানিয়া প্রভৃতি দেশে এই তরীকার ব্যাপক চর্চা রয়েছে। এশিয়া মহাদেশে এবং ইউরোপ ও আমেরিকাতেও এর চর্চা রয়েছে। বাংলাদেশে কাদিরীয়া তরীকা বয়ে আনেন হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহি আলায়হি। 

বাংলা ভাষায় গওসুল আযমের কয়েকখানি গ্রন্থের তরজমা বের হয়েছে। এ ছাড়াও এখানে কাদিরীয়া তরীকার ওপর বেশ কয়েকখানি বই প্রকাশিত হয়েছে। 

গওসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হির গ্রন্থরাজির মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে : ফতহুল গায়ব, ফতহুর রাব্বানী, সিররুল আসরার, গুনিয়াতুত্‌ ত্বালিবীন, কাসিদায়ে গাউসিয়া প্রভৃতি। 

তিনি বছরের পর বছর ‘ঈশার সালাতের অজু দিয়ে ফজরের সালাত আদায় করতেন। ফারুকে আযম যেমন হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু ইমামে আযম যেমন ইমাম আবূ হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি তেমনি গওসুল আযম হচ্ছেন হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি। তিনি তাঁর এক কাসিদায় বলেছেন: ওয়া আলামি কুলিস্ন রাসিল জিবালি – প্রতিটা পর্বত শীর্ষে ওড়ে বিজয় পতাকা আমার। 



লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর

শেয়ার করুন:
  • জনপ্রিয়
  • সাম্প্রতিক

নির্বাচিত

Don`t copy text!