রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সংস্পর্শ প্রাপ্তির বরকত

 আবূ নছর মুহাম্মদ কুতুবুজ্জামান

সায়্যিদুল মুরসালীন, রাহমাতুল্লিল আলামীন মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) যেমন ছিলেন আল্লাহ তাআলার সকল রহমত বরকত ও নিআমতের উৎস, সেরূপ তাঁর পরশে ধন্য ও সংশ্লিষ্ট বস্তু, স্থান ও সময়ও বরকতময়। এ বৈশিষ্ট্য জগতে প্রেরিত আল্লাহর সকল নবী-রাসূলগণের মধ্যে বিরাজমান ছিল। তাঁদের সংস্পর্শে অনুরূপ বরকত লাভ করেছে বহুজিনিস। এটি তাঁদের প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত সুমহান মর্যাদার প্রতিফলন। নবী-রাসূলগণে বিশ্বাসী উম্মতগণ তথা সালফে সালিহীনের চিন্তাধারায় এ বিষয়টির ইতিবাচক বিশ্বাসই বিদ্যমান। উক্ত বিষয়টি অজস্র দলীল প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত ও বাস্তবতার আলোকে অনস্বীকার্র্য হওয়া সত্বেও ইসলামের সঠিক আদর্শ থেকে বিপথগামী বিভ্রান্ত ওয়াহাবী ফিরকার নিকট এটি অসহনীয় ও অগ্রাহ্য। তারা নবী-রাসূলগণের সংস্পর্শপ্রাপ্ত কতিপয় বস্তুর বরকত অত্যন্ত ঠেকাবশতঃ স্বীকার করে নিলেও সংস্পর্শপ্রাপ্ত ও স্মৃতিবিজড়িত স্থানের বরকতময় হওয়াকে সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিকভাবে অস্বীকার করে থাকে। তারা এসব বিষয়কে বরকতময় মনে করাতো দূরের কথা, এগুলো বরকতময় হওয়ার কথা ভাবাকে শিরকতুল্য বিবেচনা করে। তারা আদৌ একথা ভাবে না যে বস্তু ও স্থানের মধ্যে আল্লাহর সৃষ্টি হওয়ার ব্যাপারে কোন ফারাক নেই। সুতরাং যে কারণে কোন বস্তু বরকতময় হতে পারে সে কারণে স্থানও বরকতময় হওয়াই যৌক্তিক। তাছাড়া এর বরকতের মূলে আল্লাহ প্রদত্ত সম্মান ও বরকতের যে সুনিপূন ধারা ও সম্পর্ক রয়েছে তাতো শিরকের সকল সম্ভাবনাকে সরাসরি নাকচ করে দেয় তাই বস্তুর বরকত মেনে নিয়ে অযৌক্তিকভাবে স্থানের বরকতময় হওয়াকে অস্বীকার করা যেমন নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক, তেমনি দলীল প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত এ বিষয়টি অস্বীকার করা নিরেট একগুয়েমীর নামান্তর ছাড়া আর কি হতে পারে? এটি রাসূল (সা.) এর সুউচ্চ শানের সাথে কেবল বেয়াদবী ও ধৃষ্টতা প্রদর্শনই নয় বরং সকল নবী-রাসূল (আ.) এর সাথে বেয়াদবীর ও নযীর ।
এরূপ একগুয়েমীর প্রতি ওয়াহাবীদের প্ররোচিত হওয়া সম্ভবত তাদের বিভ্রান্ত রাহবার ইবনু তাইমিয়াকে অন্ধ অনুসরণমূলক হতে পারে। কেননা ইবনু তাইমিয়াই প্রথম রাসূল (সা.) এর মুবারক রাওদ্বায়ে আতহারের সম্মানিত ও বরকতময় হওয়াকে অস্বীকার করেছেন এবং রাওদ্বায়ে আতহার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনা তায়্যিবায় সফর করা হারাম ফতওয়া দিয়েছেন, যা দুনিয়ার সকল মনীষী একযোগে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং এর প্রত্যুত্তর দিয়ে সরলপ্রাণ মুসলমানকে এহেন বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করেছেন ।
ওয়াহাবীদের থেকে রাসূল (সা.) এর পরশ-ধন্য ও স্মৃতি বিজড়িত স্থান বরকতময় হওয়াকে অস্বীকার করার বিষয়টি প্রকাশ্য। তারা হজ্জ ও উমরায় গমনকারীগণকে প্রতিনিয়ত এমন অনেক স্থানে যেতে নিষেধ কিংবা বাধা প্রদান করে থাকে যেগুলো রাসূল (সা.) এর পরশ-ধন্য ও স্মৃতি বিজড়িত স্থান হওয়া সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত। যেমন রাসূল (সা.) এর পবিত্র বেলাদত গৃহ (মাওলিদুন নবী), গারে হেরা, গারে সাওর, গাযওয়ায়ে বদর প্রান্তর, ব্যবহৃত কতিপয় নির্দিষ্ট কূপ ইত্যাদি। তারা রাসূল (সা.) এর পরশ-ধন্য ও স্মৃতি বিজড়িত বিষয় বরকতময় হওয়া অস্বীকার করে এগুলোতে যেতে নিষেধ কিংবা বাধা প্রদানে যে অজুহাত দেখায় তা হচ্ছে রাসূল (সা.) থেকে এসকল স্থান বরকতময় হওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট কোন নির্দেশনা নেই । তাদের উক্ত অজুহাত চরমভাবে মিথ্যা প্রমাণ করে বিজ্ঞ উলামায়ে কিরাম গ্রহণযোগ্য দলীল প্রমাণ পেশ করলে তারা লা-জওয়াব হয়ে কখনো কখনো পাশ কাটিয়ে মানুষকে শিরক থেকে বাঁচানোর আরেক মিথ্যা অজুহাত পেশ করে ধান্দায় ফেলে দেয়। তারা বলে এ সকল স্থানে গেলে মানুষ শিরকে লিপ্ত হয়ে যাওয়ার আাশঙ্কা রয়েছে। তাদের এহেন উদ্ভট উক্তিতে যেকোন বিবেকবান জ্ঞানী লোকের মনে এমনিতেই দু-একটি প্রশ্নের উদ্রেক হয় যা বলার অপেক্ষা রাখে না । আর তা হলো, রাসূল (সা.) এর পরশ-ধন্য ও স্মৃতি বিজড়িত স্থান বরকতময় হওয়া সম্বলিত পবিত্র কুরআন মজীদ ও প্রিয় নবীর হাদীস শরীফে বর্ণিত দলীল-প্রমাণ এমনকি এ সম্পর্কে সাহাবায়ে কিরামের কৃত আচরণ ও গৃহীত পদক্ষেপ কি তাহলে সঠিক ছিল না? (নাউযুবিল্লাহ) নাকি তাঁদের আমল বা কর্মপন্থা শিরকের প্রভাবমুক্ত ছিল না? (নাউযুবিল্লাহ) দেখুন, তাদের উদ্ভট উক্তি কিংবা ভ্রান্ত যুক্তি সরলপ্রাণ মানুষকে কিরূপ বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে? তাই আসুন! আমরা উপরিউক্ত বিষয়ের দলীল-প্রমাণ পর্যালোচনাপূর্বক তাদের প্রদত্ত উদ্ভট উক্তির অসারতা উপলব্দি করার প্রচেষ্টায় নিবিষ্ট হই।

কুরআন মাজীদের দলীল
নবী-রাসূল (আ.) গণের পরশ-ছোয়া স্মৃতি বিজড়িত স্থান বরকতময় হওয়ার বিষয়ে পবিত্র কুরআন মজীদে বর্ণিত দলীল হলোঃ
১. মহান আল্লাহ তাআলার ঘোষণা:
سبحان الذى اسرى بعبده ليلا من المسجد الحرام الى المسجد الاقصى الذى باركنا حوله….. (الخ)
অর্থাৎ মহাপবিত্র সে সত্তা যিনি স্বীয় বান্দা হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে রাত্রির কিয়দংশে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা (বায়তুল মুকাদ্দাস) পর্যন্ত নিয়ে গেলেন যার চর্তুপার্শ্বকে আমি বরকতময় করে রেখেছি । (সূরা: বনী ইসরাঈল, আয়াত: ০১)
উক্ত আয়াতে উল্লেখিত التى باركنا حوله -‘যার চর্তুপার্শ্বে আমি বরকতময় করে রেখেছি’ এর তাফসীরে মুফাসসিরীনে কিরাম বায়তুল মুকাদ্দাসের চারপাশে বরকতময় হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে তথায় বেশি সংখ্যক নবী-রাসূলের আগমণ, তাদের উপর ওহী অবতরণ, তাদের বসবাস এবং কবরস্থ হওয়ার বিষয়কে উল্লেখ করেছেন। -(তাফসীর কুরতুবী, বায়দাভী, খাযিন, কবীর, আল বাহরূল মাদীদ, নাসাফী)।
মুফাসসিরীনে কিরামের ধ্যান-ধারণায় নবী-রাসূলের আগমন, তাদের উপর ওহী অবতরণ, তাদের বসবাস এবং কবরস্থ হওয়ার স্থান বরকতময় হওয়া এবং এ বিষয়ের স্বীকৃতি দিতে বিন্দু মাত্র কুন্ঠাবোধ না করা থেকে কি একথা প্রতীয়মান হয় না যে এহেন স্থানকে বরকতময় মনে করা কিংবা এহেন স্থান থেকে বরকত অর্জন করা শিরকের সকল সম্ভাবনা থেকে মুক্ত?
২. মহান আল্লাহ তাআলার ঘোষণা:
ونجيناه و لوطا الى الارض التى باركنا فيها للعلمين
অর্থাৎ আর আমি তাকে (হযরত ইবরাহিমকে) এবং হযরত লূতকে এমন যমীনের দিকে প্রেরন করে রক্ষা করলাম যেথায় জগদ্বাসীর জন্যে আমি বরকত রেখেছিলাম। (সূরা: আম্বিয়া, আয়াত: ৭১)
উক্ত আয়াতে উল্লেখিত- فيها التى باركنا “যেথায় জগদ্বাসীর জন্যে আমি বরকত রেখেছিলাম” এর তাফসীরে পূর্বানুরূপ মুফাসসিরীনে কিরামের অনেকে শাম (সিরিয়া) দেশ বরকতময় হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে তথায় বেশি সংখ্যক নবী-রাসূলের আগমন, তাদের উপর ওহী অবতরণ, তথায় তাদের বসবাস এবং কবরস্থ হওয়ার বিষয়কে উল্লেখ করেছেন। (তাফসীরে কুরতুবী, বায়দাভী, খাযিন, কবীর, আল বাহরূল মাদীদ, নাসাফী)

হাদীস শরীফের দলীল
নবী-রাসূল (আ.) গণের পরশ-ধন্য স্মৃতি বিজড়িত স্থান বরকতময় হওয়ার বিষয়ে হাদীস শরীফে অনেক প্রমাণ রয়েছে। যেমন-
এক. বুখারী ও মুসলিম সহ বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে আছে-
عن ابن شهاب قال أخبرني محمود بن الربيع الأنصاري : أن عتبان بن مالك وهو من أصحاب رسول الله صلى الله عليه و سلم ممن شهد بدرا من الأنصار أنه أتى رسول الله صلى الله عليه و سلم فقال يا رسول الله قد أنكرت بصري وأنا أصلي لقومي فإذا كانت الأمطار سال الوادي الذي بيني وبينهم لم أستطع أن آتي مسجدهم فأصلي بهم ووددت يا رسول الله أنك تأتيني فتصلي في بيتي فأتخذه مصلى قال فقال له رسول الله صلى الله عليه و سلم سأفعل إن شاء الله. قال عتبان فغدا رسول الله صلى الله عليه و سلم وأبو بكر حين ارتفع النهار .. فصلى ركعتين
-হযরত ইবনু শিহাব থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত মাহমুদ-ইবনুর রবী আনসারী (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, হযরত ইতবান ইবনু মালিক (রা.) একবার রাসূল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)। আমার দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়েছে। আমি স্ব-গোত্রীয় লোকদের সাথে নামায পড়তে যেতাম। যখনি বৃষ্টি হয়, আমার ও তাদের মধ্যবর্তী উপত্যকা বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হওয়ার কারণে মসজিদে যেতে পারি না। ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)। আমার একান্ত কামনা যে, একবার আপনি আমার ঘরে গিয়ে (কোন স্থানে) নামায পড়ে আসলে সে স্থানকে আমি আমার নামাযের স্থান বানাব। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, অচিরেই তা করব ইনশা আল্লাহ। বর্ণনাকারী বলেন, পরবর্তী দিন প্রত্যুষে সূর্য আলো ছড়াতেই রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আবূ বকর (রা.) কে সাথে নিয়ে আমার গৃহে তাশরীফ আনলেন, এবং দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। (বুখারী, হাদীস নং- ৪১৫ ও ৫০৮; মুসলিম, হাদীস নং- ১৫৮)
উক্ত হাদীস শরীফ থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সাহাবায়ে কিরাম রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পদস্পর্শধন্য স্থানকে বরকতময় বলে বিশ্বাস করতেন। বর্ণিত হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক উক্ত সাহাবীর আবেদনে সাড়া দিয়ে তাঁর গৃহে নামায পড়ে সে স্থানকে তাঁর নামাযের স্থান বানাবার প্রস্তাব সমর্থন করা সুষ্পষ্ট। যা থেকে হুযূর (সা.) কর্তৃক উক্ত বিষয় যথার্থ হওয়ার অনুমোদন কিংবা স্বীকৃতি পাওয়া যায়। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এরূপ স্থানকে উক্ত সাহাবীর বরকতময় বলে বিশ্বাস করা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট যথার্থ বিবেচিত হয়েছে। নতুবা তিনি এর অনুমোদন কিংবা স্বীকৃতি দিতেন না। হাদীস শরীফের নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থে ব্যখ্যাকারকগণের উক্তিসমূহে এরই প্রমাণ লক্ষ্যণীয়। ইবনু বাত্তালকৃত শরহু সহীহিল বুখারী এর মধ্যে আছে-
وفيه التبرك بمصلى الصالحين ومساجد الفاضلين وفيه : أنه من دُعى من الصالحين إلى شىء يتبرك به منه ، فله أن يجيب إذا أمن الفتنة من العجب .( شرح صحيح البخارى لابن بطال:২/

তুহফাতুল আহওয়াযীর মধ্যে আছে-
وفيه التبرك بمصلى الصالحين ومساجد الفاضلين وفيه أن من دعا من الصلحاء إلى شيء يتبرك به منه فله أن يجيب إليه إذا أمن العجب- تحفة الاحوذى
মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইকমালুল মু’লিম এর মধ্যে আছে-
فيه التبرك بالفضلاء ، ومشاهد الأنبياء وأهل الخير ومواطنهم ، ومواضع صلاتهم-(اكمال المعلم شرح صحيح المسلم للقاضى عياض: ২/৩৫২

দুই. এ সম্পর্কে নাসায়ী শরীফসহ বহু হাদীস গ্রন্থে আছে-
حدثنا أنس بن مالك أن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال : أتيت بدابة فوق الحمار ودون البغل خطوها عند منتهى طرفها فركبت ومعي جبريل عليه السلام فسرت فقال انزل فصل ففعلت فقال أتدري أين صليت صليت بطيبة وإليها المهاجر ثم قال انزل فصل فصليت فقال أتدري أين صليت صليت بطور سيناء حيث كلم الله عز و جل موسى عليه السلام ثم قال انزل فصل فنزلت فصليت فقال أتدري أين صليت صليت ببيت لحم حيث ولد عيسى عليه السلام (السنن للنسائى رقم الحديث ৪৫০ بزار، طبرانى،كنز العمال، دلائل النبوة(
বর্ণিত হাদীস শরীফের সার কথা হচ্ছে যে, মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবীব (সা.) কে মিরাজ রজনীতে সূদীর্ঘ যাত্রা পথে বিরতি ঘটিয়ে এমন কতিপয় স্থানে নামায আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেগুলো ছিল তাঁর ও তাঁর পূর্বেকার নবী-রাসূলগণের পরশ ধন্য কিংবা স্মৃতি বিজড়িত বরকতময় স্থান। যথা: ইয়াসরিব (মদীনা শরীফ), মাদইয়ান (হযরত শুয়াইব (আ.) এর আবাসস্থল), তূর (আল্লাহ তাআলার সাথে হযরত মূসা (আ.) এর কথোপকথনের স্থান) এবং বায়তুল্লাহাম (হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মস্থান)। যেহেতু এগুলোর সাথে ছিল নবী-রাসূলগণের স্মৃতি চিহ্নের সম্পর্ক ছিল সেহেতু এসব স্থানে থামানো হয়েছিল। এ সকল স্থান বরকতময় হওয়ার মূল কারণও এটি।

মোটকথা, আল্লাহ তাআলার প্রিয় হাবীব (সা.) যে সকল বস্তু স্পর্শ করেছেন কিংবা ব্যবহার করেছেন সেগুলো সম্মানিত ও বরকতময় হওয়া সাহাবায়ে কিরাম ও তৎপরবর্তী সকল সালফে সালিহীন কর্তৃক স্বীকৃত। এ সম্পর্কে শিফা গ্রন্থকার বহু প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছেন। তার ভাষ্য কতই না চমৎকার তিনি লিখেছেন,
فصل ومن إعظامه وإكباره إعظام جميع أسبابه وإكرام مشاهده وأمكنته من مكة والمدينة ومعاهده وما لمسه صلى الله عليه وسلم أو عرف به وروى عن صفية بنت نجدة قالت كان لأبى محذورة قصة في مقدم رأسه إذا قعد وأرسلها أصابت الأرض فقيل له ألا تحلقها فقال لم أكن بالذى أحلقها وقد مسها رسول الله صلى الله عليه وسلم بيده، وكانت قلنسوة خالد بن الوليد شعرات من شعره صلى الله عليه وسلم فسقطت قلنسوته في بعض حروبه فشد عليها شدة أنكر عليه أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم كثرة من قتل فيها فقال لم أفعلها بسبب القلنسوة بل لما تضمنتهمن شعره صلى الله عليه وسلم لئلا أسلب بركتها وتقع في أيدى المشركين، ورؤى ابن عمر واضعا يده على مقعد النبي صلى الله عليه وسلم من المنبر ثم وضعها على وجهه، ولهذا كان مالك رحمه الله لا يركب بالمدينة دابةوكان يقول أستحيى من الله أن أطأ تربة فيها رسول الله صلى الله عليه وسلم بحافر دابة، وروى عنه أنه وهب للشافعي كراعا كثيرا كان عنده فقال الشافعي أمسك منها دابة فأجابه بمثل هذا الجواب
বর্ণিত বক্তব্যের সার কথা হলো, হুযুর (সা.) এর সংস্পর্শধন্য কিংবা ব্যবহৃত স্মৃতিচিহ্ন ধারণকারী সকল বস্তু ও স্থানকে মর্যাদা প্রদান মূলত তাঁকে সম্মান প্রদর্শনেরই নামান্তর। রাসূল (সা.) কর্তৃক স্পর্শকৃত মাথার সম্মুখ ভাগের এক গুচ্ছ চুল লম্বা হয়ে মাটি পর্যন্ত দীর্ঘ হওয়ার পরও সাহাবী আবূ মাহযুরা (রা.) কাটেননি। হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রা.) এর টুপিতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কয়েক খানা চুল লাগানো ছিল। তিনি সর্বদা উক্ত চুলসমূহকে বরকতের ওসীলা মনে করে সঙ্গে রাখতেন। সে টুপি পরিধান করে যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন, সে যুদ্ধেই বিজয়ী হতেন। বিখ্যাত সাহাবী হযরত ইবনু উমর (রা.) হুযূর (সা.) এর মিম্বরে বসার স্থানে হাত লাগিয়ে উক্ত হাত স্বীয় চেহারায় লাগাতেন। আর ইমাম মালিক (র.) কখনো রাসূল (সা.) এর শহর মদীনা তায়্যিবায় কোন জন্তুর পিঠে সওয়ার হননি । তিনি একে রাসূল (সা.) এর শহর মদীনা তায়্যিবার আদব ও ইহতিরামের পরিপন্থী মনে করতেন।
হযরত আসমা বিনতে আবী বকর (রা.) একদা একটি জুব্বা মুবারক বের করে বললেন, এ জুব্বা মুবারক রাসূলুল্লাহ (সা.) ব্যবহার করেছেন। আমরা এ জুব্বা মুবারকের এক কোনা ধৌত করে অসুস্থ ব্যক্তিকে পানি পান করিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে সে এর বরকতে সুস্থ হয়ে যায়।
অনূরূপ রাসূল (সা.) এর ব্যবহৃত একটি পেয়ালা ছিল তাতে কেউ পানি নিয়ে পান করলে এর বরকতে সুস্থ হয়ে যেত।
প্রিয় নবী (সা.)-এর সাহচর্যের বরকতে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) নবীগণের পর পৃথিবীর সকল যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন।
প্রিয়নবী (সা.)-এর দেহ মুবারকের সংস্পর্শ পেয়ে রাওদ্বায়ে আতহারের মাটি ও ভূমি সারা দুনিয়ার মাটি ও যমীন থেকে শ্রেষ্ঠ এমন কি কা’বা শরীফের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী হয়েছে, যে বিষয়ে ফুকাহায়ে কিরাম তথা উলামায়ে উম্মত সকলের ইজমা হয়েছেন, এতে কারো কোন দ্বিমত নেই। কারো কারো মতে আরশে আযীমের চেয়েও তা শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। রদ্দুল মুখতার গ্রন্থে এ সম্পর্কে এসেছে
قَالَ فِي اللُّبَابِ : وَالْخِلَافُ فِيمَا عَدَا مَوْضِعَ الْقَبْرِ الْمُقَدَّسِ ، فَمَا ضَمَّ أَعْضَاءَهُ الشَّرِيفَةَ فَهُوَ أَفْضَلُ بِقَاعِ الْأَرْضِ بِالْإِجْمَاعِ .
ا هـ .قَالَ شَارِحُهُ : وَكَذَا أَيْ الْخِلَافُ فِي غَيْرِ الْبَيْتِ : فَإِنَّ الْكَعْبَةَ أَفْضَلُ مِنْ الْمَدِينَةِ مَا عَدَا الضَّرِيحَ الْأَقْدَسَ وَكَذَا الضَّرِيحُ أَفْضَلُ مِنْ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ .وَقَدْ نَقَلَ الْقَاضِي عِيَاضٌ وَغَيْرُهُ الْإِجْمَاعَ عَلَى تَفْضِيلِهِ حَتَّى عَلَى الْكَعْبَةِ ، وَأَنَّ الْخِلَافَ فِيمَا عَدَاهُ .وَنُقِلَ عَنْ ابْنِ عَقِيلٍ الْحَنْبَلِيِّ أَنَّ تِلْكَ الْبُقْعَةَ أَفْضَلُ مِنْ الْعَرْشِ ،(ردالمحتار:৯/১৭০(
শিফা গ্রন্থকার বিশিষ্ট মনিষী কাযী ইয়াদ্ব (র.)-এর আরেকটি চমৎকার উক্তি উল্লেখপূর্বক এ বিষয়ে উপসংহারে যেতে চাই। তিনি লিখেছেন:
وجدير لمواطن عمرت بالوحى والتنزيل وتردد بها جبريل وميكائيل وعرجت منها الملائكة والروح وضجت عرصاتها بالتقديس والتسبيح واشتملت تربتها على جسد سيد البشر وانتشر عنها من دين الله وسنة رسوله ما انتشر مدارس آيات ومساجد وصلوات ومشاهد الفضائل والخيرات ومعاهد البراهين والمعجزات ومناسك الدين ومشاعر المسلمين ومواقف سيد المرسلين ومتبوأ خاتم النبيين حيث انفجرت النبوة وأين فاض عبابها ومواطن طويت فيها لرسالة وأول أرض مس جلد المصطفى ترابها ان نعظم عرصاتها وتتنسم نفحاتها (الشفا:২/৫৭-৫৯(

সাহাবায়ে কিরাম, তাবীঈন ও সকল সলফে সালিহীনের আকীদা-বিশ্বাস, পথ ও মত এবং কর্ম পন্থা পরিহার করে আজ যারা শিরক নির্মূলের মিথ্যা অজুহাতে বরকতপূর্ণ বিষয়াদির বরকত গ্রহণ থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করছে তাদের যথার্থ মিল কেবল ঐ বাতিল স¤প্রদায় খারিজীদের সাথে খুঁজে পাই যারা আল্লাহর কালামের মনগড়া ভ্রান্ত ব্যাখ্যা প্রদানে অভ্যস্থ ছিল এবং সাহাবায়ে কিরামকে মুশরিক ও কাফির ফতওয়া দিয়েছিল। (নাউযুবিল্লাহ)
সহীহ বুখারী শরীফে হযরত ইবনু উমর (রা.) এর নিম্নোক্ত বাণী তাদের ফিতনা থেকে সতর্ক হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য যথেষ্ট হবে বলে মনে করি। তিনি বলেছেন: এরা আল্লাহর সবচেয়ে নিকৃষ্ট সৃষ্টি। আল্লাহর কালামের যে সকল আয়াত মুশরিকদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে সেগুলোকে (অপব্যাখ্যা করে) তারা মুসলমানদের বিরোধিতার প্রয়োগ করে থাকে। অর্থাৎ সেগুলো দ্বারা তারা মুসলমানদেরকে মুশরিক বলে আখ্যায়িত করে। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৫৩১)
আমরা খারিজী ও ওয়াহাবীদের চক্রান্ত ও ভুল বিশ্বাস থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাই। আল্লাহর আমাদের ঈমান, আকীদা ও আমলকে হিফাযত করুন। আমীন।

[লেখক: ইমাম ও খতীব, আল ইসলাহ ইসলামিক সেন্টার, মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র;
সাবেক মুহাদ্দিস, বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল (এম.এ) মাদরাসা

লেখাটি সুবহে সাদিক ২০১৬ থেকে সংগৃহিত]

শেয়ার করুন:
  • জনপ্রিয়
  • সাম্প্রতিক

নির্বাচিত

Don`t copy text!