বদর যুদ্ধ: রাসূল (সা.)-এর মু’জিযা ও ইলমে গাইবের প্রমাণ

 

মাওলানা মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম পারভেজ

 

বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ, যা মুসলিম ও কাফিরদের মধ্যে দ্বিতীয় হিজরীতে বদর নামক স্থানে সংগঠিত হয়। বদর হচ্ছে একটি কূপের নাম, যা গিফার গোত্রের বদর নামক এক ব্যক্তি খনন করেন। এটি মদীনা হতে প্রায় আশি মাইল দূরে অবস্থিত। শাবীর মতে, বদর নামক এক ব্যক্তির মালিকানায় থাকার কারণে এই কূপটির নাম হয়েছে বদর। ইবনু হাযম বলেন- বদর এখানে বসতি স্থাপনকারী বনু দাসরার জনৈক ব্যক্তির নাম। কারো কারো মতে বদর ছিল কুরাইশ বংশের অন্যতম পূর্বপূরুষ কুরাইশের ছেলের নাম। বদর যুদ্ধে মুসলিমরা সংখ্যায় অনেক কম হয়েও মক্কার কাফির শক্তিকে পরাজিত করে ইসলামের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের সূচনা করেন। এর মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সূচিত হয়ে যায়। এজন্য এ যুদ্ধকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী বলা হয়। আল কুরআনে এই দিনকে يوم الفرقان হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

 

বদর যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

আবূ জেহেল আবূ সুফিয়ানের কাফেলার সাহায্যার্থে এক হাজার সৈন্য বাহিনী নিয়ে রওয়ানা করল। তন্মধ্যে দুশো অশ্বারোহী, সাতশো উষ্ট্রারোহীর মধ্যে ছয়শো লৌহবর্মধারী ছিল। আবূ জেহেল বদর ময়দানে দক্ষিণ প্রান্তে মক্কার অংশে বদর যুদ্ধ: রাসূল (সা.)-এর মু’জিযা ও ইলমে গাইবের প্রমাণ

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম পারভেজ

 

বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ, যা মুসলিম ও কাফিরদের মধ্যে দ্বিতীয় হিজরীতে বদর নামক স্থানে সংগঠিত হয়। বদর হচ্ছে একটি কূপের নাম, যা গিফার গোত্রের বদর নামক এক ব্যক্তি খনন করেন। এটি মদীনা হতে প্রায় আশি মাইল দূরে অবস্থিত। শাবীর মতে, বদর নামক এক ব্যক্তির মালিকানায় থাকার কারণে এই কূপটির নাম হয়েছে বদর। ইবনু হাযম বলেন- বদর এখানে বসতি স্থাপনকারী বনু দাসরার জনৈক ব্যক্তির নাম। কারো কারো মতে বদর ছিল কুরাইশ বংশের অন্যতম পূর্বপূরুষ কুরাইশের ছেলের নাম। বদর যুদ্ধে মুসলিমরা সংখ্যায় অনেক কম হয়েও মক্কার কাফির শক্তিকে পরাজিত করে ইসলামের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের সূচনা করেন। এর মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সূচিত হয়ে যায়। এজন্য এ যুদ্ধকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী বলা হয়। আল কুরআনে এই দিনকে يوم الفرقان হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

 

বদর যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

আবূ জেহেল আবূ সুফিয়ানের কাফেলার সাহায্যার্থে এক হাজার সৈন্য বাহিনী নিয়ে রওয়ানা করল। তন্মধ্যে দুশো অশ্বারোহী, সাতশো উষ্ট্রারোহীর মধ্যে ছয়শো লৌহবর্মধারী ছিল। আবূ জেহেল বদর ময়দানে দক্ষিণ প্রান্তে মক্কার অংশে নিম্নভূমিতে সুবিধামত স্থানে তাঁবু গেড়ে আনন্দ ফুর্তিতে মেতে উঠলো।

অপরদিকে রাসূলুল্লাহ (সা.) আট অথবা বারো রামাদ্বান তারিখে তিনশত তেরো জন মুজাহিদের বাহিনী নিয়ে রওয়ানা হন। যার মধ্যে বিরাশি জন মুহাজির এবং আনসারগণের মধ্যে আউস গোত্রের একষট্টি জন ও খাজরাজ গোত্রের একশত সত্তর জন সাহাবী ছিলেন। তিন শতাধিক লোকের এ বাহিনীতে মাত্র দু’টি ঘোড়া (যুবায়র ইবনুল আওয়াম এর একটি ও মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদের একটি) এবং সত্তরটি উট ছিল, যাতে দু’তিনজন করে পালাক্রমে সওয়ার হয়ে চলতে হতো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বদর প্রান্তরের নিকটবর্তী অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমিতে ষোল রামাদ্বান তাঁবু স্থাপন করেন। ঐ রাত্রে আল্লাহ পাক প্রবল বৃষ্টি বর্ষণ করলেন। প্রান্তরের মাটি ছিল নরম ভেজা। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীরা পর্যাপ্ত বৃষ্টি পেলেন, যার ফলে তাদের যমীন শক্ত হয়ে গেল। ফলে চলাচলে স্বাচ্ছন্দ্য এলো। পক্ষান্তরে কুরাইশ পক্ষের মাটি এত স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেল যে, তাদের চলাচল কঠিন হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (সা.) মুসলিম বাহিনীকে আরো বেশি পানি আছে এমন জায়গায় সরিয়ে নিলেন। হুবাব ইবনু মুনযির ইবনে জামুহ (রা.) এর পরামর্শে রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্যান্য কূপ বন্ধ করে দিলেন। দ্বিতীয় হিজরী ১৭ রামাদ্বান মুতাবেক ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ই মার্চ শুক্রবার যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠলো এবং সে যুগের প্রথা অনুযায়ী কুরাইশ পক্ষ মুসলিম পক্ষের বীর যোদ্ধাদের দ্বৈতযুদ্ধে আহবান করল। তাদের একই পরিবারের তিনজন সেরা অশ্বারোহী বীর- উৎবা, শায়বাহ ইবনু রাবীআহ এবং ওলীদ ইবনু উৎবা এগিয়ে এল। জবাবে মুসলিম পক্ষ হতে হযরত আউফ ও মুআওয়িয ইবনু হারিস এবং আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা তিনজন আনসার যুবক বীরদর্পে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু কুরাইশ পক্ষ বলে উঠলো হে মুহাম্মদ, আমাদের স্বগোত্রীয় সমকক্ষদের পাঠাও। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে ওবায়দাহ, হে হামযা, হে আলী, তোমরা যাও। অতঃপর হযরত আলী (রা.) তার প্রতিপক্ষ ওলীদ ইবনু উৎবাকে, হযরত হামযা (রা.) তার প্রতিপক্ষ শায়বা ইবনু রাবীআকে এক নিমিষেই খতম করে ফেললেন। এ দিকে বয়োবৃদ্ধ হযরত ওবায়দা ইবনুল হারিস (রা.) তার প্রতিপক্ষ উৎবা বিন রাবীআর সঙ্গে যুদ্ধে আহত হলেন। হযরত আলী ও হামযা (রা.) তার সাহায্যে এগিয়ে এসে উৎবাকে হত্যা করেন এবং হযরত উবায়দা (রা.) কে কাঁধে তুলে নিয়ে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে পৌঁছে দেন। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে যুদ্ধ শেষে মদীনায় ফেরার পথে ৪র্থ বা ৫ম দিন হযরত উবায়দা (রা.) শাহাদাত বরণ করেন।

প্রথম আঘাতেই সেরা তিনজন বীরযোদ্ধা ও গোত্র নেতাকে হারিয়ে কুরাইশ পক্ষ মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এসময় রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর নিকট আকুলভাবে নিম্নোক্ত প্রার্থনা করেন-

اللهم انجزلى ما وعدتنى اللهم انى انشدك عهدك ووعدك اللهم ان تهلك هذه العصابة لاتعبد فى الارض بعد اليوم ابدا-

তিনি বিনীত প্রার্থনায় এমন বিভোর হয়ে পড়লেন যে, তাঁর স্কন্ধ থেকে চাদর পড়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে হযরত আবূ বকর (রা.) ছুটে এসে তাঁর চাদর উঠিয়ে দিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন-

حسبك يا رسول الله الححت على ربك

এ সময় আয়াত নাযিল হল-

اذ تثتغيثون ربكم فاستجاب لكم انى ممدكم بالف من الملائكة مردفين

রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাযরত অবস্থায় এক সময় সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি হাসতে হাসতে জেগে উঠে বলেন-

بشر ابا بكر اتانا نصر الله- هذا جبريل اخذ بعنان فرسه عليه اداة الحرب-

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলতে লাগলেন-

سيهزم الجمع ويولون الدبر-

-শ্রীঘ্রই দলটি পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালাবে।

মুসলিম বাহিনীর হামলার প্রচন্ডতার সাথে সাথে যোগ হয় ফেরেশতাগণের আক্রমণ। আবূ দাউদ আল মাযিনী (রা.) বলেন, আমি একজন মুশরিক সৈন্যকে মারতে উদ্যত হই। ইতোমধ্যে তার ছিন্ন মস্তক আমার সামনে এসে পড়ল। আমি বুঝতেই পারলাম না, কে ওকে মারল। ইকরামা বিন আবূ জেহেল বলেন- ঐ দিন আমাদের লোকদের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যেতো, অথচ দেখা যেতো না কে মারলো।

মুসলিম বাহিনীর দুর্ধর্ষ আক্রমণে পর্যদুস্ত মুশরিক বাহিনী প্রাণের ভয়ে পালাতে থাকল। এ দৃশ্য দেখে তাদের ধরে রাখার জন্য আবূ জেহেল তার লোকদের উদ্দেশ্যে জোরালো ভাষণ দিয়ে বলে উঠলো সুরাকার পলায়নে তোমরা ভেঙ্গে পড়ো না। সে আগে থেকেই মুহাম্মদের চর ছিল (ইবলিস সুরাকার বেশ ধরে আবূ জেহেলের বাহিনীর সাথে এসেছিল, পরে সে পলায়ন করে)। উৎবা, শায়বা ও ওলীদের মৃত্যুতেও ভীত হওয়ার কারণ নেই। কেননা তাড়াহুড়োর মধ্যে তারা মারা যায়। লাত উযযার শপথ করে বলছি, ওদেরকে শক্ত করে রশি দিয়ে বেঁধে না ফেলা পর্যন্ত আমরা ফিরে যাব না। অতএব তোমরা ওদেরকে মের না। বরং ধরো এবং বেঁধে ফেল।

কিন্তু আবূ জেহেলের এ তর্জন গর্জন অসার প্রমাণিত হল। আনসারদের বনু সালামা গোত্রের কিশোর দু’ভাই মুআয ও মুআওয়িয ইবনু আফরা তীর বেগে ছুটে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়লেন এবং মুআয প্রথম আঘাতে আবূ জেহেলের পা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। এ সময় মুআযের কাঁধে ইকরামা ইবন আবূ জেহেলের তরবারীর আঘাতে মুআযের একটি হাত কেটে ঝুলতে থাকল। তিনি নিজের পা দিয়ে চেপে ধরে একটানে সেটাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। তাঁর ছোট ভাই মুআওয়িযের আঘাতে আবূ জেহেল ধরাশায়ী হলে তারা উভয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে গর্বভরে বলে উঠলেন, হে রাসূল (সা.), আবূ জেহেলকে আমি হত্যা করেছি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন-তোমাদের তরবারী মুছে ফেলেছ কি? তারা বললো- না। উভয়ের তরবারী পরীক্ষা করে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন- তোমরা উভয়ে তাকে হত্যা করেছ। মুআওয়িয ইবনু আফরা পরবর্তীতে যুদ্ধ করে শহীদ হন এবং মুআয ইবনু আফরা হযরত উসমান (রা.) এর খেলাফতকাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।

মুআয ও মুআওয়িয (রা.) আবূ জেহেলকে ধরাশায়ী করার পর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) গিয়ে দেখেন আবূ জেহেলে তখনও নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তিনি তার দাঁড়ি ধরে মাথা কেটে নেবার জন্য ঘাড়ে পা রাখলে সে বলে উঠল “হে মেষের রাখাল, তুই অনেক দুর্লভ মর্যাদা লাভ করেছিস”। উল্লেখ্য যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ মক্কায় থাকাকালে মেষ চরাতেন। তারপর সে বলল-

فلو غيرأكار قتلنى

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) তার মৃতদেহ দেখার পর বলেন-

رحم الله ابنى عفراء هما شركاء فى قتل فرعون هذا الامة-

এ যুদ্ধে ৬ জন মুহাজির ও ৮ জন আনসার শহীদ হন। কাফিরদের পক্ষে ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বন্দী হয়। তাদের বড় বড় ২৪ জন নেতাকে বদরের একটি পরিত্যক্ত দুর্গন্ধময় কূপে নিক্ষেপ করা হয়। মুসলমানগণ প্রচুর গনীমতের মালের অধিকারী হন। যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (সা.) বদর ময়দানে তিনদিন অবস্থান করেন।

 

বদর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মু’জিযা প্রকাশ

(ক) বদরের যুদ্ধে হযরত উবাদা ইবনু মিহসান আসদী (রা.) এর তরবারী ভেঙ্গে যায়। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট গেলেন। তিনি তাঁর হাতে একটি কাষ্টখÐ (শুকনো খেজুরের ডাল) দিয়ে বললেন- তুমি এটি দিয়ে যুদ্ধ কর। উবাদা (রা.) কাষ্টখÐটি (খেজুরের ডাল) হাতে নিতেই খোদার রহমতে তা সূতী² তরবারীতে পরিণত হয়ে গেল। তিনি ঐ তরবারী দ্বারা যুদ্ধ করতে লাগলেন। যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় হয়। তখন উবাদা (রা.) এর ঐ তরবারীখানার নাম রাখা হয় ‘আউন’ অর্থাৎ সাহায্য। হযরত উবাদা (রা.) জীবনভর বিভিন্ন যুদ্ধে এ তরবারী ব্যবহার করেন। হযরত আবূ বকর (রা.) এর খেলাফতকালে ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি তাদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। ঐ যুদ্ধেও তিনি ‘আউন’ তরবারী দ্বারা যুদ্ধ করেছিলেন।

(খ) বদর যুদ্ধে বীর বাহাদুর কিশোর সহোদদের একজন হযরত মুআয ইবনু আফরা (রা.) এর একটি হাত আবূ জেহেলের পুত্র ইকরামার তরবারীর আঘাতে দ্বিখÐিত হয়ে যায়। মুআয (রা.) হাতের খÐিত অংশ সহ নবী করীম (সা.) এর খিদমতে উপস্থিত হলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের একটু থুথু মুবারক লাগিয়ে খÐিত অংশ সংযুক্ত করে দিলেন। সাথে সাথে হাত জোড়া লেগে গেলো। হযরত মুআয (রা.) উক্ত হাত নিয়ে সুস্থ অবস্থায় হযরত উসমান (রা.) এর খেলাফতকাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।

(গ) বদর যুদ্ধের শুরুতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এক মুষ্টি ধূলা হাতে নিয়ে شاهت الوجوه অর্থাৎ ‘তাদের মুখমন্ডল আচ্ছন্ন হোক’ বলে ঐ গুলোতে ফুঁক দিয়ে শত্রুদের দিকে দূর থেকে নিক্ষেপ করেন। উক্ত ধূলিকণাগুলো প্রত্যেক শত্রু সেনার চোখে গিয়ে পড়ে। এতে করে তারা দিশেহারা হয়ে যায়, তাদের দৃষ্টি বিভ্রাট ঘটে এবং তাদের শক্তি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। এ সম্পর্কে কুরআনে পাকে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-

وما رميت اذ رميت ولكن الله رمى (سورة النفال)

‘হে রাসূল’, আপনি যখন ধূলিকণা নিক্ষেপ করেছিলেন তখন আপনি নিক্ষেপ করেননি বরং আল্লাহ তাআলাই নিক্ষেপ করেছেন।

(ঘ) যুদ্ধের মাঠ এমন একস্থান যেখানে সাধারণ সিপাহী থেকে প্রধান সেনাপতি -পর্যন্ত কারও চোখের পাতায় নিদ্রার ছোঁয়া লাগা প্রশ্নাতীত; কিন্তু বদর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর এক অনন্য মু’জিযা ছিল যে, যুদ্ধের ময়দানে মুসলিম বাহিনীর চোখে প্রবল নিদ্রা চেপে বসেছিল। এর কারণ ছিল এই যে, গভীর নিদ্রার মাধ্যমে মানুষের জড়তা, অবসাদ এবং আলস্য দূর হয়ে মানুষ সজীব ও সুদৃঢ় হয়ে উঠে। এমতাবস্থায় যুদ্ধ ক্ষেত্রের দায়িত্ব পালনে তারা পূর্ণরূপে সফল হয়েছিলেন।

(ঙ) বদর প্রান্তরে মুসলিম বাহিনী ও কুরাইশ বাহিনী নিজেদের পছন্দমত স্থানে তাঁবু স্থাপনের পর কুরাইশদের একটি দল সামনে অগ্রসর হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বানানো হাওযের পানি নিতে লাগলো। তাদের মধ্যে হাকীম ইবনু হিযামও ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবীদের বললেন: ওদেরকে বাধা দিও না। বস্তুত সেদিন ঐ হাওয থেকে যে-ই পানি পান করেছে সে-ই নিহত হয়েছে। একমাত্র হাকীম ইবন হিযাম ছাড়া (তিনি নিহত হননি)। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে খাঁটি মুসলমান হয়েছিলেন। এ ঘটনাকে তিনি আজীবন মনে রেখেছিলেন।

 

বদর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর অদৃশ্য জ্ঞান

(ক) বদর যুদ্ধের পূর্বে সন্ধ্যার সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আলী ইবনু আবি তালিব (রা.), যুবায়র ইবনুল আওয়াম (রা.) ও সাদ ইবনু আবি ওয়াক্কাস (রা.) কে একদল সাহাবীসহ বদরের জলাশয়ের কাছে প্রতিপক্ষের অবস্থান ও অন্যান্য তথ্য অনুসন্ধানের জন্য পাঠালেন। সেখানে তাঁরা কুরাইশ গোত্রের একপাল পানি বহনকারী উট দেখতে পেলেন এবং তার মধ্যে হাজ্জাজ গোত্রের গোলাম আসলাম এবং বনু আস ইবনু সাঈদের গোলাম আবূ ইয়াসার আরীযকে দেখতে পেলেন। তারা ঐ লোক দুটিকে পাকড়াও করে নিয়ে এলেন এবং জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) দাঁড়িয়ে নামায আদায় করছিলেন। সাহাবাগণ তাদের জিজ্ঞেস করলেন: তোমরা কারা? তারা বললো: আমরা কুরাইশ গোত্রের পানি সরবরাহকারী। তারা আমাদের খাবার পানি নিতে এখানে পাঠিয়েছে। সাহাবাগণ তাদের কথা বিশ্বাস করলেন না। তাদের ধারণা ছিল, এরা আবূ সুফিয়ানের লোক। এরপর তারা তাদের মারপিট করলেন। প্রচন্ড পিটুনি খেয়ে তারা বললো যে, আমরা আবূ সুফিয়ানের লোক। এরপর সাহাবীগণ তাদের আর কোন কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.) নামায শেষ করে বললেন: “তারা যখন সত্য বললো, তখন তোমরা তাদের প্রহার করলে আর যখন মিথ্যা বললো, তখন জিজ্ঞাসাবাদ থেকে বিরত হলে। আল্লাহর কসম! এরা নিশ্চয়ই কুরাইশদের লোক।” তখন নবী (সা.) নিজে তাদের জিজ্ঞাসা করা শুরু করলেন: ওহে লোকদ্বয়, তোমরা আমাকে কুরাইশদের খবর বলো। তখন তারা উভয়ে বললো: আল্লাহর কসম! ঐ যে দূরে বালুর টিলাটা দেখছেন, ওর পিছনে তারা রয়েছে। পরে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের জিজ্ঞাসা করলেন: তারা সংখ্যায় কত? আসলাম ও আলী বললো: অনেক। রাসূলুল্লাহ (সা.) পুনরায় জিজ্ঞাস করলেন: তাদের সাজসরঞ্জাম কিরূপ? তারা বললো: আমরা জানি না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন: তারা প্রতিদিন কয়টি উট জবাই করে? তারা বললো: কোন দিন নয়টা, কোন দিন দশটা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: তাহলে ওদের সংখ্যা নয়শো থেকে হাজারের মধ্যে হবে।

(খ) বদর যুদ্ধের আগের দিন রাসূলুল্লাহ (সা.) মুসলমানদের সুসংবাদ দিলেন যে, আল্লাহ তাআলা আমাকে বিজয়ের আশ্বাস দিয়েছেন। আমি কুরাইশদের ৭০ জন সরদারের নিহত হওয়ার স্থানও দেখতে পাচ্ছি। একথা বলে রাসূলুল্লাহ (সা.) হাতের লাঠি দিয়ে এক একটি জায়গা চিহ্নিত করে বলতে লাগলেন-এটি আবূ জেহেলের নিহত হওয়ার স্থান, এটি উতবার, এটি ওলীদের, এটি শায়বার নিহত হওয়ার স্থান ইত্যাদি। যুদ্ধ শেষে সাহাবায়ে কিরাম রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা বাস্তবে দেখার জন্য অনুসন্ধান করে দেখতে পেলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) যেখানে যার নাম ধরে জায়গা চিহ্নিত করেছিলেন, ঠিক সে জায়গায়ই সে নিহত হয়েছে।

হযরত উমর (রা.) বদর যুদ্ধের আলোচনায় বলেন-

ان رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يرينا مصارع اهل بدر بالامس يقول: هذا مصرع فلان غدا ان شاء الله- قال: فقال عمر: و الذى بعثه بالحق ما اخطؤوا الحدود التى حد رسول الله صلى الله عليه وسلم (رواه مسلم)

-রাসূল (সা.) গতকাল আমাদের বদরের (কাফিরদের নিহত হওয়ার স্থান) দেখিয়ে বলেছিলেন আগামীকাল এটা হবে অমুকের নিহত হওয়ার স্থান, ইনশাআল্লাহ। বর্ণনাকারী বলেন, উমর (রা.) বলেছেন, সেই সত্তার কসম যিনি তাঁকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, রাসূল (সা.) যে স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন সে স্থান থেকে সামান্য ব্যতিক্রম হয়নি।

(গ) গুপ্তচর উমায়র ইবনু ওয়াহাব জুমাহীর অনুসন্ধানী রিপোর্ট শুনে হাকীম ইবনু হিযাম কুরাইশ বাহিনীর অন্যতম নেতা উৎবা ইবনু রাবীআকে কুরাইশ বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মক্কায় ফিরিয়ে নেয়ার অনুরোধ করলে তিনি তাতে সম্মত হন এবং নিজ মিত্র আমর ইবনু হাদরামীর হত্যাকাÐের ব্যাপারটা মিটিয়ে দেয়ার দায়িত্বও নেন। উৎবা ইবনু রাবীআ হাকিম ইবনু হিযামকে বললেন: তুমি আবূ জেহেলের কাছে যাও। আমি মনে করি কুরাইশদের বিনা যুদ্ধে ফিরিয়ে নেয়ার প্রশ্নে সে ছাড়া আর কেউ বিরোধিতা করবে না। হাকিম আবূ জেহেলের নিকট গিয়ে উৎবার ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন। তখন আবূ জেহেল বললো: আল্লাহর শপথ! উৎবার মাথা তখন থেকে খারাপ হয়ে গেছে, যখন সে মুহাম্মদ এবং তার সঙ্গীদের দেখেছে। আল্লাহর কসম! এটা কখনো হতে পারে না। যতক্ষণ আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মদের ব্যাপারে চূড়ান্ত ফায়সালা না করে দেন, ততক্ষণ আমরা ফিরে যাব না। উৎবা যখন আবূ জাহেলের এ উক্তি শুনলো যে, “উৎবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে” তখন সে বললো: অচিরেই সে ভীরু জানতে পারবে, আমার মাথা খারাপ হয়েছে না তার মাথা খারাপ হয়েছে। অতঃপর উৎবা মাথায় চাদর বেঁধে একটা লাল উটের পিটে চড়ে যুদ্ধের জন্য বেরিয়ে পড়লো। লাল উটের পিটে চড়া উৎবা ইবনু রাবীআকে দেখে রাসূলুল্লাহ (সা.) মন্তব্য করলেন: গোটা কুরাইশ গোত্রের কোন ব্যক্তির মধ্যে যদি কিছুমাত্র শুভবুদ্ধি থেকে থাকে, তবে এই লোকটার মধ্যে আছে। লোকেরা যদি তার কথা শোনে তাহলে তারা সঠিক পথের সন্ধান পাবে। বদর যুদ্ধে কুরাইশদের চরম পরাজয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর এভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবরূপ লাভ করে।

(ঘ) বদর যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে কাফিরদের ৭০ জন সৈন্য বন্দীর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কিরামের সাথে পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, মুক্তিপণের বিনিময়ে বন্দীদের মুক্তি দিবেন। এ সিদ্ধান্তে যখন হযরত আব্বাসের পালা এলো তিনি সম্পদের স্বল্পতার অজুহাতে ৮০ উকিয়া স্বর্ণমদ্র্রা মুক্তিপণ দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। তখন নবী করীম (সা.) তাকে বললেন-

فاين الذهب الذى دفعته الى ام الفضل قبل مخرجك الى بدر- وقلت لها: ان حدث بى حدث فى وجهى هذا فهو لك ولعبد الله والفضل وقثم- قال فقلت: يدريك؟ قال اخبرنى الله بذلك- قلت: انك لصادق- وانى قد دفعت اليها بالذهب ولم يطلع عليه احد الا الله فانا اشهد ان لا اله الا الله وانك رسول الله (اسباب النزول)

-“আপনি বদরের উদ্দেশ্যে বের হবার আগে উম্মুল ফদ্বল এর কাছে যে স্বর্ণ রেখে বলেছিলেন, যদি আমার কিছু হয়ে যায় তবে এই স্বর্ণ তোমার এবং (আমার তিনপুত্র) আব্দুল্লাহ, ফদ্বল ও কুছামের জন্য রেখে গেলাম, সে স্বর্ণ কোথায়? হযরত আব্বাস বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম-আপনি কি করে জানলেন? জবাবে নবী করীম (সা.) বললেন, আল্লাহই আমাকে জানিয়েছেন। হযরত আব্বাস বলেন, আপনি সত্যি বলেছেন। আমি তার কাছে যে স্বর্ণ রেখেছি তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। সুতরাং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবূদ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল।”

উপরে বর্ণিত আলোচনা থেকে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি বদর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বহু অনন্য মু’জিযা ও আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত অদৃশ্য জ্ঞানের প্রকাশ ঘটেছিল। এ যুদ্ধটি এ হিসাবে খুব ফলপ্রসু হয় যে, কুফর ও ইসলাম সর্বপ্রথম যুদ্ধের ময়দানে শক্তি পরীক্ষার সুযোগ লাভ করে এবং সংখ্যাধিক্য ও অস্ত্রশস্ত্রের বাহুল্য সত্তে¡ও কাফিররা অপমানজনক ও দৃষ্টান্তমূলক পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়। এতে মক্কার কুরাইশদের শক্তি ও মনোবল চূর্ণ হয়। অপরদিকে মুসলমানদের শক্তি-সাহস বৃদ্ধি পায় এবং মনোবল অধিক শক্তিশালী হয়। মোটকথা বদর যুদ্ধ সর্বকালের জন্য মুসলমানদের সৌভাগ্য বয়ে আনে এবং কুফরের ধ্বংস ও দুর্ভাগ্যের অগ্রদূত প্রমাণিত হয়।

 

[লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ;

অধ্যক্ষ, হুলিয়ারপাড়া সিনিয়র মাদরাসা, জগন্নাথপুর, সুনামগনজ]

 

শেয়ার করুন:
  • জনপ্রিয়
  • সাম্প্রতিক

নির্বাচিত

Don`t copy text!