রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মুবারক শরীরের পরশ : অনন্য সৌভাগ্যের কারণ

মূল: হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)
অনুবাদ: মাওলানা মুহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মুবারক শরীরের পরশে যে কল্যাণ অর্জন হয় এ ব্যাপারে সার কথা হলো, যেই বস্তু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শরীর মুবারক স্পর্শ করেছে সেই বস্তুর উপর দুযখের আগুন হারাম হয়ে যায়। এ সত্যের অনুকূলে দু’একটা দলীল পেশ করা হলো।
.
সাওয়াদ ইবনু আমর আনসারী (রা.)
বদরের যুদ্ধে যখন যোদ্ধাদেরকে সারিবদ্ধ করা হচ্ছিল তখন হযরত সাওয়াদ ইবনু আমর আনসারী (রা.) যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করার আকাঙ্ক্ষায় সারি থেকে একটু এগিয়ে গিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) এক খন্ড কাঠ দ্বারা ধাক্কা দিয়ে তাঁকে পিছনে সরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি সাহাবায়ে কিরামদের মধ্যে বেশি কৌতুক প্রিয় ছিলেন। এ ধাক্কা খাওয়ার পর তিনি বলতে লাগলেন-ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.), আমি খুব বেশি ব্যথা পেয়েছি। এ শব্দটি তিনি বারবার বলতে লাগলেন। রাসূল (সা.) বললেন, তুমি কী চাও? তিনি জবাব দিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.), আমি এর বদলা চাই। রাসলুল্লাহ (সা.) তাঁর পেট মুবারককে আগে বাড়িয়ে বলেন-এসো, তোমার বদলা নাও। যেহেতু তাঁর পেটেই ধাক্কা লেগেছিল, তাই তিনি বলেন-ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.), আমাকে আঘাত করার সময় পেটের উপর কোন কাপড় ছিল না। শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) পেট মুবারক হতে কাপড় খুলে বললেন, নাও তোমার বদলা নাও। তখনই সেই সাহাবী (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পেট মুবারকে হাত রেখে চুম্বন প্রদান করেন এবং কাঁদতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কেন চুম্বন দিলে এবং কাঁদলে? তিনি উত্তর দিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.) আমি বদলা প্রত্যাশী নই, আমি মুনাফিক নই, শুধু আপনার শরীর মুবারক স্পর্শ করার জন্যই একটি অজুহাত দেখিয়ে আমার উদ্দেশ্য পূর্ণ করলাম। কেননা আমি নিজ চোখে নিজের মৃত্যু দেখছি। আমার জানাও আছে এবং দলীলও আছে যে, যেই ব্যক্তি আপনার শরীর মুবারক স্পর্শ করবে, যার শরীর আপনার শরীরের সাথে লেগে যাবে তাঁর উপর দুযখের আগুন হারাম হয়ে যাবে। ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.), আমার উদ্দেশ্য ছিল মৃত্যুর আগে যে কোন উপায়ে আপনার শরীর স্পর্শ করব যেন দুযখের আগুন আমার উপর হারাম হয়ে যায়।

আবূ তালিব
দ্বিতীয় ঘটনা আবূ তালিবের, যিনি ঈমান কবুল করেননি, তবুও দুযখীদের মধ্যে সবচেয়ে লঘু শাস্তি হবে আবু তালিবের। শুধু দুটি পায়ে দুযখের আগুনের জুতা পরানো হবে এবং বাকী শরীর দুযখের আগুন থেকে সুরক্ষিত থাকবে। ঐ রিওয়ায়াত মুসলিম শরীফেও আছে। আবূ তালিবের শরীর আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার কারণ হচ্ছে যেহেতু আবূ তালিবের পূরো শরীর রাসূল (সা.) এর শরীর মুবারকের স্পর্শ পেয়েছিল শুধু দু’টি পা ছাড়া। আর নিয়ম হচ্ছে-যে কোন জিনিষ রাসূল (সা.) এর শরীর মুবারকের সাথে লাগে তার উপর দুযখের আগুন হারাম হয়ে যায়। এজন্য দুযখের আগুন আবূ তালিবের শরীর স্পর্শ করবে না। আবূ তালিব রাসূল (সা.) কে নিজের সন্তানের ন্যায় ¯েœহ করতেন। কখনো কাঁধের উপর, কখনো কোলে এবং কখনো পেটের উপর উঠাতেন।

আফতাবে রিসালাতের নূর থেকে ফয়েয লাভের বর্ণনা
হযরত ইবরাহীম (আ.) আগুনে জ্বলেননি। তাঁকে মজবুত রশি দিয়ে বাঁধা হয়েছিল। রশি অগ্নিদগ্ধ হওয়ার সাথে সাথে সমস্ত শরীর জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু তিনি জ্বলেননি। তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করার পর আল্লাহ বলেছিলেন- يَانَارُ كُوْنِيْ بَرْدًا وَّسَلاَمًا عَلَيْ اِبْرَهِيْمَ “হে আগুন ইবরাহীমের জন্য ঠান্ডা ও শান্তিময় হয়ে যাও।”
হযরত ইবরাহীম (আ.) এর একটি পশমও না জ্বলার কারণ ছিল-হযরত ইবরাহীম (আ.) এর মধ্যে তখন নূরে মুহাম্মদী (সা.) বিদ্যমান ছিল। নূরে মুহাম্মদীর জন্য আগুন তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারেনি।

হযরত ইসমাঈল (আ.) এর ঘটনা
এ বিষয়ে আরেকটি ঘটনা হযরত ইসমাঈল (আ.) এর। হযরত ইবরাহীম (আ.) স্বপ্ন দেখার পর হযরত ইসমাঈল (আ.) কে নিয়ে মিনায় পৌছেছিলেন। শয়তান তিন বার ধোঁকা দিতে চাইলে ইসমাঈল (আ.) শয়তানকে পাথর মেরেছিলেন। যখন হযরত ইবরাহীম (আ.) নিজে সন্তানকে স্বপ্নের তাৎপর্য সম্পর্কে অবহিত করলেন, তখন হযরত ইসমাঈল (আ.) নিজে সানন্দে কুরবানী হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং এর সমর্থনে পাঁচটি ওসিয়ত করলেন।
প্রথমত: প্রিয় আব্বাজান! যদি আপনি আমাকে কুরবানী করতে ইচ্ছা করেন তবে প্রথমে আপনার ছুরি ধার করিয়ে নিন, যেন আল্লাহর নির্দেশ দ্রæত সম্পন্ন হয়। অর্থাৎ গলা কাঁটতে যেন বিলম্ব না হয়। যদি গলা কাটতে দেরী হয় সেই মুহূর্তে সন্তানের মুহব্বত জেগে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
দ্বিতীয়ত: প্রিয় আব্বাজান! আপনি যখন আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যে আমাকে কুরবান করতে চাচ্ছেন, তাই আপনি কুরবানীর আগে শক্ত রশি দিয়ে আমার পুরো শরীরটা বেঁধে নিন, যাতে কুরবানীর পরে আমার শরীর নড়াচড়া না করে। নড়াচড়া করলে একথা সাব্যস্ত হবে যে, আমি স্বেচ্ছায় আমার গর্দান আল্লাহ তাআলার রাস্তায় কুরবানী দেইনি।
তৃতীয়ত: প্রিয় পিতা! কুরবানীর সময় আমাকে চিৎ করে শোয়াবেন না। আমার চেহারার উপর আপনার দৃষ্টি পড়লে পিতৃত্বের ¯েœহের প্রবলতা হেতু হয়ত আল্লাহর নির্দেশ কার্যকর করতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং আমাকে মুখ নিচের দিকে করে জমিনে শোয়াবেন।
চতুর্থত: প্রিয় আব্বাজান! আপনি আমাকে কুরবানী দেয়ার আগে আপনার কাপড় গুছিয়ে নিন। যাতে আমার রক্তের ছিটা আপনার কাপড়ে না পড়ে। রক্তের চিহ্ন নিয়ে আপনি ঘরে গেলে এবং তাতে আম্মার দৃষ্টি পড়লে হয়ত আমার অসহায় মায়ের কলজে বিদীর্ণ হয়ে যাবে।
পঞ্চমত: প্রিয় আব্বাজান! আমার আম্মাকে আমার কুরবানীর খবর শুনাবেন না। কারণ তার ধৈর্য হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে।
হযরত ইবরাহীম (আ.) আনন্দের সাথে কুরবানী করার জন্য প্রস্তুত হলেন এবং হযরত ইসমাঈল (আ.) অনেক খুশী হয়ে ওসিয়ত করেই স্বীয় গর্দান সোপর্দ করলেন কিন্তু গর্দানের উপর ছুরি নিস্তেজ হয়ে রইলো। হযরত ইবরাহীম (আ.) পূর্ণ শক্তি দিয়ে ছুরি চালিয়েছিলেন, কেন ছুরি চলছে না সেই রাগে রাগান্বিত হয়ে ছুরি নিক্ষেপ করলে পাথরের উপর পড়ে পাথর কেটে যায় কিন্তু হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর গর্দান কাটা যায়নি।
এর কারণ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সেইক্ষণে নূরে মুহাম্মদ (সা.) স্থানান্তরিত হয়ে হযরত ইসমাঈল (আ.) এর মধ্যে পৌঁছেছিল।
এ নূরের কারণেই উম্মতে মুহাম্মদী (সা.) হতে দুযখ আশ্রয় প্রার্থনা করে বলে- দ্রæত চলে যাও হে মুমিন, তোমার নূরের কারণে আমার অগ্নিশিখা নিভে যাচ্ছে।
যদিও অন্যান্য নবীদেরকে মু’জিযা প্রদান করা হয়েছিল, কিন্তু তা ছিল জন্মের সময়, জন্মের পর বা নবুওয়াত প্রকাশের পর। আর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মু’জেযা প্রকাশ পেয়েছিল হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করার সাথে সাথে আর তাঁর প্রশংসা সৃষ্টি জগত সৃষ্টির পূর্ব হতেই করা হয়েছিল। এর দলীল হলো- যখন হযরত আদম (আ.) জান্নাত থেকে বের হচ্ছিলেন- তখন দেখলেন যে, আরশের পৃষ্ঠে এবং বেহেশতের সর্বত্র আল্লাহর নামের সাথে মুহাম্মদ (সা.) এর নাম মুবারক লেখা রয়েছে। তখন আদম (আ.) বললেন, হে পরওয়ারদিগার! মুহাম্মদ নামটি কার? আল্লাহ তাআলা বলেন- তিনি হচ্ছেন তোমার সন্তান। যিনি না হলে তোমাকে সৃষ্টি করা হতো না। তিনি তারপর বলেন, হে পরওয়ারদিগার! এ সন্তানের সম্মানার্থে আমাদের দয়া করুন। তখন বলা হয় হে আদম! তুমি আসমান এবং জমিনের যে কোন লোকের জন্য যদি মুহাম্মদ (সা.) এর ওসীলা দিয়ে আমার কাছে শাফাআত চাও, তা হলে শাফাআত কবূল করা হবে।
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ফরমায়েছেন, হযরত আদম (আ.) যখন ভুল করলেন, তখন বললেন ইয়া রব! আমি আপনার কাছে মুহাম্মদ (সা.) এর ওসীলা নিয়ে ক্ষমা চাচ্ছি; আমাকে ক্ষমা করে দিন। তখন আল্লাহ তাআলা বললেন, হে আদম! কিভাবে তুমি মুহাম্মদ (সা.) কে চিনলে অথচ আমি তাঁকে সৃষ্টি করিনি? তখন তিনি বললেন, পরওয়ারদিগার! আপনি আমাকে আপনার হাত দিয়ে তৈরি করলেন, তারপর আমার মধ্যে রূহ ফুঁকলেন, তারপর আমি মাথা উত্তোলন করে দেখলাম আরশে লেখা আছে- لااله الا الله محمد رسول الله তখনই আমি বুঝতে পারলাম, আপনি তাঁকে মুহব্বত না করলে তাঁর নাম আপনার নামের সাথে যোগ করতেন না। আল্লাহ তাআলা বললেন- হে আদম! যেই তাঁর ওসীলা নিয়ে আমার কাছে প্রার্থনা করবে, তাঁকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। মুহাম্মদ না হলে তোমাকে সৃষ্টি করা হতো না। ইমাম বায়হাকী এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। হযরত তিবরানীও অনুরূপ বর্ণনা করেন এবং কিছু বাড়িয়ে বলেন- وهو اخر الانبياء من ذريتك অর্থাৎ তিনি হচ্ছেন তোমার বংশীয়দের মধ্যে সর্বশেষ নবী। সীরাতের কিতাবসমূহে এ সম্পর্কে অনেক হাদীস রয়েছে।

[মুজাদ্দিদে যামান, শামসুল উলামা হযরত আল্লামা মোঃ আব্দুল লতিফ চৌধুরী
ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর ‘মুনতাখাবুস সিওর’ থেকে সংকলিত।
অনুবাদক: আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর সুযোগ্য ছাহেবজাদা;
সভাপতি, বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ]

শেয়ার করুন:
  • জনপ্রিয়
  • সাম্প্রতিক

নির্বাচিত

Don`t copy text!