কুরআন শরীফ তিলাওয়াতের আদব

কুরআন শরীফ তিলাওয়াতের আদব

মাওলানা মুহাম্মদ হবিবুর রহমান


সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব আল কুরআনুল কারীম। এর তিলাওয়াতের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য ফযীলত। আল­াহ পাক ইরশাদ করেন-

ان الذين يتلون كتاب الله واقاموا الصلاة وانفقوا مما رزقناهم سراوعلانية يرجون تجارة لن تبور- ليوفيهم اجورهم ويزيدهم من فضله

অর্থাৎ- “যারা আল­াহর কিতাব তিলাওয়াত করে, নামায কায়েম করে, আমি তাদের যে রিযক দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, এর দ্বারা তারা এমন এক ব্যবসা কামনা করে যাতে কোন লোকসান নেই। এর ফলস্বরূপ, অবশ্যই তিনি তাদেরকে পরিপূর্ণ প্রতিদান দিবেন এবং স্বীয় অনুগ্রহে আরও বেশি প্রদান করবেন।”(সূরা ফাতির: ২৯-৩০) 

রাসূলে পাক (সা.) ইরশাদ করেনخيركم من تعلم القران وعلمه  তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে, যে কুরআন শিক্ষা করে ও শিক্ষা দেয়। (বুুখারী)


পবিত্র কুরআনের একটি হরফ তিলাওয়াত করলে দশটি সওয়াব পাওয়া যায়। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-

من قرأ حرفا من القران فله به حسنة والحسنة بعشر امثالها- لا اقول الم حرف بل الف حرف ولام حرف وميم حرف-

অর্থাৎ যে ব্যক্তি কুরআন কারীমের একটি হরফ তিলাওয়াত করে সে এর বিনিময়ে একটি সওয়াব পাবে। আর প্রত্যেকটি  সওয়াব দশগুণ হবে। আমি বলি না ‘আলিফ লাম মীম’ একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ। 


কুরআন কারীম তিলাওয়াতের পূর্ণ ফযীলত লাভ করতে হলে কিছু নিয়ম মেনে তিলাওয়াত করতে হবে। এগুলোই হচ্ছে তিলাওয়াতের আদব। এর মধ্যে কিছু আদব আছে যেগুলো রক্ষা করা অবশ্য পালনীয়, আর কিছু আদব রক্ষা করা তিলাওয়াতের পরিপূর্ণ সওয়াব লাভের জন্য উচিত। নিæে তিলাওয়াতে কুরআনের কিছু আদব সম্পর্কে আলোকপাত করা হল।


 পবিত্রতা 

পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের অবশ্য পালনীয় আদবসমূহের একটি হল পবিত্রতা। মুখস্থ তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে ওযু বিহীন তিলাওয়াত অবশ্য জায়িয। তবে ওযূসহ তিলাওয়াত উত্তম। দেখে দেখে তিলাওয়াত করলে অবশ্যই ওযূ থাকতে হবে। কারণ ওযূবিহীন অবস্থায় কুরআন কারীম স্পর্শ করা হারাম। আল­াহ পাক ইরশাদ করেন-

انه لقران كريم فى كتاب مكنون- لا يمسه الا المطهرون-

“নিশ্চয় এটি সম্মানিত কুরআন। গোপন কিতাবে সংরক্ষিত। পবিত্র ব্যক্তিগণ ছাড়া কেউ তা স্পর্শ করবে না।”


গোসল আবশ্যক এমন নারী-পুরুষের জন্য কুরআন কারীম তিলাওয়াত ও স্পর্শ উভয়ই হারাম। চাই দেখে তিলাওয়াত হোক কিংবা না দেখে।


ইখলাস 

কুরআন কারীম তিলাওয়াতের সময় একনিষ্ঠভাবে আল­াহ তাআলার দিকে অন্ত-রকে নিবেদিত করে তিলাওয়াত করা উত্তম। এতে পরিপূর্ণ বরকত লাভ সম্ভব হয়। কারণ ইখলাস হচ্ছে সকল আমলের রূহ। আর ইবাদতের মধ্যে ইখলাস হচ্ছে এমনভাবে ইবাদত করতে হবে যেন ইবাদতকারী আল­াহকে দেখছেন। আর তিনি না দেখলেও অন্তত: এ মনোভাব থাকতে 

হবে যে আল­াহ তাআলা তাকে দেখছেন। আর তিলাওয়াতে কুরআন যেহেতু একটি ইবাদত, তাই এতেও ইখলাস আবশ্যক। রাসূলে কারীম (সা.) ইরশাদ করেন-

ان تعبد الله كأنك تراه فان لم تكن تراه فانه يراك-

 

আউযু বিল­াহ ও বিসমিল­াহ পড়ে তিলাওয়াত শুরু করা 

শয়তান প্রত্যেক ভাল কাজে বান্দাহকে বাধা দিতে সচেষ্ট। সে শপথ করে আল­াহপাককে হুমকি দিয়েছিল, সকল মানুষকে সে বিপথগামী করবেই। আল­াহ পাক ইরশাদ করেন- قال فبعزتك لاغونهم اجمعين শয়তান বলেছিল হে আল­াহ! আপনার ইযযতের কসম! আমি তাদের সকলকেই বিপথগামী করব। (সূরা সোয়াদ, আয়াত-৮২) 

কালামে পাক তিলাওয়াতের সময় শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনার নির্দেশ স্বয়ং আল­াহ তাআলা দিয়েছেন-

فاذا قرأت القران فاستعذ بالله من الشيطان الرجيم-

অর্থাৎ যখন আপনি কুরআন তিলাওয়াত করবেন তখন অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল­াহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবেন। (সূরা নহল, আয়াত-৯৮)


আর তিলাওয়াত শুরুর সময় ‘বিসমিল­াহ’ পড়া উত্তম। আল­াহ পাক ইরশাদ করেন-

اقرأ باسم ربك الذى خلق

-পড়–ন আপনার রবের নামে যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা-আলাক, আয়াত-১) 


দুই সূরার মধ্যখানে বিসমিল­াহ পড়া আবশ্যক। কারণ, তা না হলে দুই সূরার মধ্যে পার্থক্য করা যাবে না। তবে সূরা ‘বারাআত’ এর শুরুতে বিসমিল­াহ পড়া যাবে না।


তিলাওয়াতের সময় কিবলামুখী হয়ে বসা

সকল ইবাদতই কিবলামুখী হয়ে করা উত্তম। ফুকাহায়ে কিরামের ঐক্যমতে দিকসমূহের মধ্যে কিবলাহর দিকই উত্তম। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- ان سيد المجالس ما استقبل القبلة (الطبرانى সর্বোত্তম বৈঠক হল সেই বৈঠক যাতে কিবলাহমুখী হয়ে বসা হয়।


রেহাল বা উঁচু কোন বস্তুর উপর কুরআন কারীম রেখে তিলাওয়াত করা

কুরআন কারীম আল­াহ পাকের কালাম। তাই যথাসাধ্য সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করে তা তিলাওয়াত করা উত্তম। এজন্য বসার স্থান হতে উঁচু কোন বস্তুর উপর রেখে তা তিলাওয়াত করতে হবে। কোন অবস্থাতেই তা পায়ের উপর রাখা যাবে না।                  

ফুকাহায়ে কিরামের মতে পবিত্র কুরআনের দিকে পা ছড়িয়ে দেয়া মাকরুহ, যদি কুরআন কারীম পায়ের সমান উচ্চতায় থাকে। কুরআন কারীম উঁচু স্থানে রেখে প্রয়োজনে সে দিকে পা স¤প্রসারন করা যাবে। সুতরাং যেখানে এর দিকে পা ছড়ানো ঠিক নয়, সেখানে কিভাবে পায়ের উপর তা রাখা যাবে?

কোন কোন বেআদব লোক বলে থাকেন হাতের উপর কুরআন কারীম রাখা ঠিক হলে পায়ের উপর রাখা ঠিক হবে। কারণ পা শরীরের একটি অংশ। তাদের এ যুক্তি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। কারণ পা শরীরের অংশ হলেও হাত ও পায়ের ব্যবহার ভিন্ন। হাত দিয়ে কোন মানুষকে ছুঁয়ে দিলে তা কোন আলোচনার বিষয় হয় না, বরং কোন সময় তা আশির্বাদ অর্থে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু কারো গায়ে পা লাগিয়ে দিলেই তা বেআদবী হয় । অনেক সময় তা ঝগড়া বিবাদে রূপ লাভ করে।


তারতীলের সাথে কুরআন কারীম তিলাওয়াত করা 

কালামে পাকের ইরশাদ- ورتل القران ترتيلا আপনি তারতীলের সাথে কুরআন তিলাওয়াত করুন। 

তারতীল হলো- হরফসমূহের হক আদায়, মদ, গুন্নাহ ইত্যাদি যথাযথ আদায় করে তিলাওয়াত করা, কমবেশি না করা। উদাহরণস্বরূপ মদ্দে কসর দুই হরকতের বেশি লম্বা করার কোন সুযোগ নেই। কোন সময় দেখা যায়, তিলাওয়াতকারী অন্য স্থানে যাই করুন মদ্দে কসর এর স্থলে অপ্রত্যাশিতভাবে আওয়াজ দীর্ঘ করে তিলাওয়াতে ভিন্ন মাত্রা প্রদানের অপচেষ্টা করেন। এটা তিলাওয়াতের আদবের পরিপন্থী। আল­াহ তাআলা ইরশাদ করেন-  الذين اتينهم الكتاب يتلونه حق تلاوته


সুন্দর স্বরে কুরআন তিলাওয়াত করা 

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- زينوا القران باصواتكم-তোমাদের স্বর দিয়ে কুরআনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত কর।


বিশেষ ফযীলতপূর্ণ সূরা ও আয়াত বেশি করে তিলাওয়াত করা  

বিশেষ ফযীলতপূর্ণ সূরা ও আয়াত বেশি করে তিলাওয়াত করা উত্তম। যেমন সূরা ইখলাস একবার তিলাওয়াত করলে কুরআন কারীমের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াতের সওয়াব হয়। তা ছাড়া সূরা ‘কাহাফ’, সূরা ‘ইয়াসীন’ সূরা ‘বাকারাহ’ এর শেষ তিন আয়াত ইত্যাদি আয়াত ও সূরাসমূহ তিলাওয়াতের বিশেষ ফযীলত থাকায় এগুলো বেশি করে তিলাওয়াত করা উত্তম।


অর্থের প্রতি মনোযোগ প্রদান করা 

অর্থ জানা থাকলে উত্তম হলো তিলাওয়াতের সময় অর্থের প্রতি মনোযোগ প্রদান করা। ভয়ভীতির আয়াত তিলাওয়াত করলে আল­াহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা, সুসংবাদজনিত আয়াতে আল­াহর প্রশংসা করা। অনুগ্রহ সংক্রান্ত আয়াতে আল­াহর অনুগ্রহ লাভের দু‘আ করা। যেমন সূরা মুলকের শেষ আয়াত তিলাওয়াত করে الله يأتينا به وهو رب العالمين পড়া। শাস্তির আয়াত তিলাওয়াত করে  اللهم انى اسئلك العافية

 পাঠ করা। আল­াহ তাআলার শান সম্পর্কিত আয়াত তিলাওয়াত করে جلت عظمت ربنا  পাঠ করা।  সূরা ওয়াকিয়াহ তিলাওয়াত শেষে سبحان ربى العظيم পাঠ করা, এমনিভাবে অন্যান্য নিআমতের আয়াত তিলাওয়াত করে সেই নিআমত কামনা করা মুস্তাহাব। 


নিরিবিলি স্থানে কুরআন তিলাওয়াত করা 

উলামায়ে কিরাম মতামত প্রদান করেছেন, তিলাওয়াতের সর্বোত্তম স্থান হচ্ছে মসজিদ। মসজিদে তিলাওয়াত সম্ভব না হলে এমন কোন নিরিবিলি স্থানে বসে কুরআন তিলাওয়াত উত্তম যেখানে অন্য কোন কিছুর আওয়াজ তিলাওয়াতের আওয়াজের চেয়ে উঁচু না হয়। 

সিজদাহর আয়াত তিলাওয়াত করলে সাথে সাথে সিজদাহ আদায় করা উত্তম। তবে তিলাওয়াত শেষ করে সিজদাহ আদায় করলেও তা আদায় হয়ে যাবে। কুরআন কারীমের ইহতিরাম রক্ষার্থে তিলাওয়াতের মধ্যখানে হাসি, তামাসা ও অনর্থক কথাবার্তা পরিত্যাগ করা আবশ্যক। এমনকি তিলাওয়াতের মধ্যখানে হাই বা হাঁচি আসলে তিলাওয়াত বন্ধ করে আবার তিলাওয়াত শুরু করা উত্তম। 


তিলাওয়াতের উত্তম সময় 

ফুকাহায়ে কিরাম একথার উপর একমত যে, নামাযে কুরআন তিলাওয়াত হচ্ছে সর্বোত্তম। নামাযের বাইরে তিলাওয়াতের সর্বোত্তম সময় হলো শেষ রাত। আর দিনের বেলা বাদ ফজর। আল­াহ পাক ইরশাদ করেন-   يتلون ايات الله اناء الليل واناء النهار   

অবশ্য এসময় ছাড়া যে কোন সময়ে তিলাওয়াত করা যাবে, সওয়াবও পাওয়া যাবে।


দেখে দেখে কুরআন তিলাওয়াত করা 

কুরআন কারীম মুখস্থ থাকলেও মাসহাফ দেখে দেখে তিলাওয়াতের মধ্যে না দেখে তিলাওয়াতের চেয়ে অধিক সওয়াব রয়েছে।

 

তিলাওয়াতকালে ক্রন্দন করা 

বলা হয়ে থাকে-  البكاء حال القراة حال العارفين وستعارعباد الصالحين অর্থাৎ- আল­াহ ওয়ালাদের অবস্থা হলো তিলাওয়াতের সময় ক্রন্দন করা। আর এটা হলো নেক বান্দাহদের পরিচয়। 

রাসূলে পাক (সা.) ইরশাদ করেন- তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর এবং ক্রন্দন কর। যদি কাদঁতে না পার তা হলে কাঁদার ভান কর। (الترغيب)


অন্যের কাছ থেকে কুরআন তিলাওয়াত শুনা 

সুন্দর আওয়াজ ও তিলাওয়াতকারী লোকের কাছ থেকে কুরআন তিলাওয়াত শুনাও মুস্তাহাব।

শেয়ার করুন:
  • জনপ্রিয়
  • সাম্প্রতিক

নির্বাচিত

Don`t copy text!