আহলে কুরআন ও কুরআন তিলাওয়াতের ফদ্বীলত

আহলে কুরআন ও কুরআন তিলাওয়াতের ফদ্বীলত

মূল: হযরত আল­ামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)

অনুবাদ: মুহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী

 

হযরত সাঈদ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল­াহ (সা.) বলেন- বেহেশতে প্রবেশের পর যারা (পৃথিবীতে) কুরআন পড়ত, তাদেরকে বলা হবে- কুরআন পাঠ কর এবং কুরআন পাঠ করতে করতে উপরের দিকে উঠতে থাক। তারা প্রত্যেক আয়াতের বিনিময়ে এক একটি সিঁড়ি অতিক্রম করতে থাকবে। এভাবে কুরআন পাঠ শেষ হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে। 

আহমদ আবূ সাঈদ আল খুদরী (রা.)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসূলুল­াহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, কিছু দিন পর এমন এক জামাত আসবে, যারা নামায নষ্ট করে ফেলবে, নিজ কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করবে, তারা ধ্বংসে পতিত হবে। অতঃপর এক জামাত আসবে যারা কুরআন পাঠ করবে, কিন্তু তাদের ভিতর তা পৌঁছবে না। তিন ধরনের লোকেরা কুরআন পাঠ করবে। মুমিন, মুনাফিক এবং ফাজির। বশীর বলেন আমি ওয়ালীদাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই তিন দলের অবস্থা কি? তিনি বলেন, মুনাফিক তিলাওয়াত করবে কিন্তু এর প্রতি সে অবিশ্বাসী হবে, আর ফাজির বা পাপাচারী এর প্রতি আমল করবে না এবং মুমিন এর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসী হবে। 

অপর এক রিওয়ায়তে হযরত আবূ সাঈদ (রা.) বলেন- রাসূলুল­াহ (সা.) তাবুকের দিন একটি খুরমা বৃক্ষে হেলান দিয়ে খোৎবা দিলেন এবং সে খোৎবায় বলেন- আমি কি তোমাদেরকে ভাল লোক এবং খারাপ লোক সম্পর্কে অবহিত করব না? মানুষের মধ্যে সবচেয়ে ভাল মানুষ ঐ ব্যক্তি, যে মৃত্যু মুখে পতিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আল­াহ প্রদত্ত নীতিমালা অনুযায়ী আমল করতে থাকে। সে ঘোড়ার পিঠে হোক, উটের পিঠে হোক বা পায়ে হেটে হোক। আর মানুষের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ঐ ব্যক্তি, যে ফাজির। সে কুরআন পাঠ করে কিন্তু শরীআতের ধার ধারে না। 

হযরত হাফিয আবূ বকর আল বাযযার আবূ সাঈদ (রা.) হতে বর্ণনা করেন- রাসূলুল­াহ (সা.) ইরশাদ করেন-

يقول الله تعالى من شغله قرأة القران عن دعائي اعطيته افضل ثواب الشاكرين وقال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان فضل كلام الله تعالى على سائر الكلام كفضل الله على سائر خلقه-                                               

অর্থ: আল­াহ তাআলা বলেন, যে ব্যক্তিকে কুরআন পাঠের কাজ আমার কাছে দু‘আ করা থেকে বিরত রাখবে আমি তাকে শুকরিয়া জ্ঞাপনকারী (شاكرين)-এর প্রতিদানের চেয়ে উত্তম প্রতিদান দেই। রাসূলুল­াহ (সা.) বলেন- সমস্ত কথার মধ্যে আল­াহ তাআলার কথা তথা কুরআন এমন মর্যাদাপূর্ণ যেমন সমস্ত সৃষ্টির উপর আল­াহ তাআলার শ্রেষ্ঠত্ব। আনাস বিন মালিক (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল­াহ (সা.) বলেন- মানুষের মধ্যে আল­াহর পরিবারভুক্ত লোক রয়েছে। প্রশ্ন করা হল এরা কারা? রাসূলুল­াহ (সা.) বলেন- আহলে কুরআন। তাঁরাই আল­াহর আহাল এবং খাস বান্দাহ। 

হযরত আনাস বিন মালিক (রা.) যখন কুরআন তিলাওয়াত শেষ করতেন, তখন সন্তান-সন্ততি একত্রিত করে আল­াহ তাআলার দরবারে দু‘আ করতেন। হাফিয আবুল কাসিম তাবারানী হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণনা করেন- রাসূলুল­াহ (সা.) বলেন-

القران غني لافقر بعده ولا غني دونه-

অর্থ- কুরআনই সম্পদ, যে কুরআন ধরে আছে, সে ফকীর নয় এবং কুরআন ছাড়া কেউ ধনী নয়।

হযরত আবূ বকর বাযযার হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণনা করেন- রাসূলুল­াহ (সা.) বলেন- 

لكل شي حلية وحلية القران الصوت الحسن-

অর্থ- প্রত্যেক জিনিসের অলংকার আছে, আল কুরআনের অলংকার হল শ্র“তিমধুর আওয়াজ। অর্থাৎ বিশুদ্ধভাবে ও শ্র“তিমধুর কন্ঠে কুরআন পাঠ করা উচিত।

ইমাম আহমদ (র.) হযরত আনাস বিন মালিক (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন- আমরা আরবী, আজমী, কালো ও শ্বেত বর্ণের একদল লোক বসা ছিলাম। হঠাৎ রাসূলুল­াহ (সা.) আমাদের এখানে তশরীফ আনলেন এবং বললেন- انتم في خير تقرءون كتاب الله وفيكم رسول الله (الخ      

অর্থ: তোমরা এমন এক ভাল ক্ষণে আছ- তোমরা আল­াহ তাআলার কুরআন পাঠ করছ এবং তোমাদের মাঝে আল­াহর রাসূল (সা.) বিদ্যমান ও বিরাজমান। কিন্তু মানুষের মাঝে এমন এক সময় আসবে- তারা তাদের বিনিময় খুব তাড়াতাড়ি চাইবে, বিলম্ব করবে না।

হযরত আনাস (রা.) বলেন- রাসূলুল­াহ (সা.) বলেছেন, যে ঘরে বেশি বেশি কুরআন পাঠ হয়, সে ঘরে বেশি কল্যাণ হয়। পক্ষান্তরে যে ঘরে কুরআন পাঠ করা হয় না, সে ঘরের বরকত কমে যায়। হযরত হাফিয আবূ ইয়ালা হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণনা করেন, হযরত আবূ মূসা (রা.) একটি ঘরে বসা ছিলেন, তখন তাঁর কাছে অনেক লোকের সমাবেশ হল। আবূ মূসা কুরআন পাঠ আরম্ভ করলেন, তখন এক ব্যক্তি রাসূলুল­াহ (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরয করলেন- ইয়া রাসুলাল­াহ! (সা.) আপনার এ কথা পছন্দ হবে কী যে হযরত আবূ মূসা (রা.) একটি ঘরে বসে আছেন এবং তাঁর কাছে অনেক লোকের সমাবেশ হল এবং আবূ মূসা (রা.) কুরআন পাঠ করে শুনাচ্ছেন। রাসূলুল­াহ (সা.) বললেন- তুমি কি আমাকে এমন জায়গায় বসাতে পার যেখানে তাদের মধ্য হতে কেউ আমাকে দেখবে না? তিনি উত্তরে বলেন- হ্যাঁ। তারপর রাসূলুল­াহ (সা.) বের হলেন- তখন ঐ ব্যক্তি রাসূলুল­াহ (সা.)-কে এমন এক জায়গায় বসালেন যেখানে কেউ তাঁকে দেখতে না পারে। রাসূলুল­াহ (সা.) আবূ মূসা (রা.)-এর কিরাত শ্রবণ করলেন, তারপর ফরমালেন-

انه ليقرأ علي مزمار من مزامير داود عليه السلام-

অর্থ: আবূ মূসা এমন সুরে কুরআন পাঠ করছেন, যেন দাউদ (আ.)-এর বাঁশি।  (এ হাদীস গরীব)।

হযরত ইমাম আহমদ (র.) হযরত জাবির বিন আব্দুল­াহ (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন- রাসূলুল­াহ (সা.) আমাদের উদ্দেশ্যে খুৎবা দিলেন। তিনি আল­াহ তাআলার প্রশংসা করার পর বলেন-

 فان اصدق الحديث كتاب الله وان افضل الهدي هدي محمد صلى الله عليه وسلم  وشر الامور محدثاتها وكل بدعة ضلالة (الحدي                        

অর্থ: সত্য কথা হচ্ছে আল­াহ তাআলার কিতাব এবং সবচেয়ে উত্তম পথ নির্দেশিকা হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পথ নির্দেশনা এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ হচ্ছে দ্বীনের ব্যাপারে নতুন জিনিসের উদ্ভাবন এবং প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী। (আল হাদীস)

হযরত জাবির বিন আব্দুল­াহ বলেন- রাসূলুল­াহ (সা.) মসজিদে প্রবেশ করলেন। তখন লোকেরা কুরআন পাক পাঠ করছিলেন। রাসূলুল­াহ (সা.) বললেন- পাঠ কর এবং কুরআনের মাধ্যমে আল­াহ তাআলাকে তালাশ কর।

অন্য এক হাদীসে হযরত জাবির বিন আব্দুল­াহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমরা আরবী ও আজমী (আরব দেশের বাইরের লোককে আজমী বলা হয়) এক জায়গায় বসে কুরআন পাঠ করছিলাম। তখন রাসূলুল­াহ (সা.) আমাদের কাছে তশরীফ আনলেন এবং কুরআন পাঠ শুনে বললেন- 

اقراء فكل حسن وسياتى قوم يقيمونه كما يقام القدح يتعجلونه ولايتأجلونه-

অর্থ: কুরআন পাঠ কর পূর্ণ শুদ্ধভাবে এবং সুললিত কণ্ঠে। এমন এক স¤প্রদায় অতিসত্ত¡র আসবে, যারা কুরআন পাঠ করবে এবং বিনিময় চাইবে যেমনিভাবে কোন পাত্রের দাম চাওয়া হয়। তা তারা নগদ চাইবে, বাকী রাখবে না।

হযরত আব্দুল­াহ বিন মাসউদ (রা.) বলেন-

ان هذا القران شافع ومشفع من اتبعه قاده الى الجنة ومن تركه او اعرض عنه او كلمة نحوهارح فى قفاه الى النار-

অর্থাৎ অবশ্যই এ কুরআন সুপারিশকারী এবং সুপারিশ করার জন্য অনুমোদন প্রাপ্ত। যে এ কুরআন পাকের আনুগত্য করবে, কুরআন তাকে জান্নাতের দিকে পরিচালিত করবে। যে কুরআন ত্যাগ করবে বা কুরআন হতে মুখ ফিরিয়ে থাকবে, তাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। 

হযরত জাবির বিন আব্দুল­াহ (রা.) হতে বর্ণিত- রাসূলুল­াহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি এক হাজার আয়াত পাঠ করবে, তাকে আল­াহ তাআলা এক কিনতার মালের অধিকারী করবেন। আর কিনতার হল একশত রতল (প্রায় ৪০ তোলা) আর رطل হল বার আওকিয়া। আওকিয়া হল ছয় দিনারের সমান। এক দিনার সমান চব্বিশ কিরাত এবং এক কিরাত উহুদ পাহাড়ের মত। যে ব্যক্তি কুরআনের তিনশত আয়াত পাঠ করবে, আল­াহ তাআলা তাঁর সম্পর্কে ফিরেশতাদেরকে বলেন- আমার বান্দাহকে দেখ। আমি তোমাদেরকে সাক্ষী করছি, হে আমার ফেরেশতাগণ! আমি আমার এ বান্দাহর গুনাহ মাফ করে দিয়েছি। যে এর ফদ্বীলত সম্পর্কে অবগত হবে এবং এর প্রতি বিশ্বাস করতঃ এবং আল­াহ তাআলার পক্ষ হতে সওয়াবের আশা নিয়ে তদনুযায়ী আমল করবে আল­াহ তাআলা তাঁকে এ সমুদয় কাক্সিক্ষত বস্তু দান করবেন। 

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল­াহ (সা.) বলেছেন, যার মুখে কুরআন পাকের কিছুই নেই, সে যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি গৃহের ন্যায়। 

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল­াহ (সা.) বলেন- যে ব্যক্তি আল­াহ তাআলার কিতাবের অনুসরণ করে, তাকে আল­াহ তাআলা গোমরাহী হতে রক্ষা করে হিদায়ত দান করেন। কিয়ামতের দিন মন্দ হিসাব নিকাশ হতে রক্ষা করেন। এজন্যে আল­াহ তাআলা বলেন- যে আমার হিদায়ত অনুসরণ করে সে গোমরাহও হয় না এবং দুর্ভাগাও হবে না। 

তাবারানী হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করেন- রাসূলুল­াহ (সা.) বলেন, সর্বোত্তম পাঠক ব্যক্তি সেই, যে কুরআন পাঠ করে এবং তদানুযায়ী আমল করে। একই সনদ হতে আরও একটি রিওয়ায়ত আছে- রাসূলুল­াহ (সা.) বলেন- احسنو الاصوات بالقران অর্থাৎ তোমরা কুরআন শ্র“তিমধুর ও বিশুদ্ধভাবে পাঠ কর।

 

কুরআন পাকের ফদ্বীলত

হযরত ইমাম বুখারী (র.) (অহী কিভাবে নাযিল হয়েছে এবং সর্ব প্রথম যা অবতীর্ণ হয়েছে সে অধ্যায়ে) বলেন- হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, المهيمن শব্দের অর্থ-الامين  পূর্ববর্তী সমস্ত আসমানী কিতাবের তত্ত¡াবধায়ক হল কুরআন। مهيمن শব্দের তাফসীর ইমাম বুখারী (র.) হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর বক্তব্য অনুযায়ী ‘তত্ত¡াবধায়ক’ করেছেন। যেমন সূরা মায়িদার আয়াত- 

وَاَنْزَلْنَا اِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ وَمُهَيْمَنًا عَلَيْهِ

“আমি তোমার নিকট সত্যসহ কুরআন নাযিল করেছি, যা আগের সমস্ত কিতাবসমূহকে সত্যায়িত করে এবং তত্ত¡াবধান করে।” (সূরা: মায়িদা-৪৮)।

হযরত আবূ জাফর, ইবনে জারীর (র.) হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে مهيمن (মুহাইমীন)-এর অর্থ امين  উলে­খ করেন এবং অন্য বর্ণনায় شهيدا عليه  অর্থ সাক্ষী এবং অন্য বর্ণনায় موتمنا অর্থাৎ হিফাযতকারী উলে­খ করেন। এভাবে হযরত মুজাহিদ, সুদ্দী, কাতাদাহ, ইবনে জুরাইজ, হাসান বসরী (র.) এবং পূর্বের সমস্ত ইমামগণ বলেন- واصل المهيمنة الحفظ والارتقاب অর্থাৎ المهيمنة শব্দের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে রক্ষা করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা। যেভাবে পরিভাষায় বলা যায়। যখন কেউ কোন বস্তুকে নিয়ন্ত্রণ করে বা সংরক্ষণ করে তখন বলা হয়, هيمنه ও وهو عليه مهيمن আল­াহ তাআলার নামসমূহের মধ্যে একটি  মুহাইমিন, কেননা তিনি প্রত্যেক জিনিষের উপর সাক্ষী ও সবকিছু নিয়ন্ত্রণকারী এবং রক্ষাকারী।

হযরত ইমাম বুখারী (র.) হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করেন- 

قال انزل القران حملة واحدة الى سماء الدنيا فى ليلة القدر ثم نزل بعد ذالك فى عشرين سنة ثم قرأ وَقُرْاَنَا فَرَقْنَه عَلَى النَّاسِ عَلَى مُكْثٍ وَّنَزَّلْنَاهُ تَنْزِيْلًا   

অর্থাৎ তিনি বলেন- পূর্ণ কুরআনকে একসাথে পৃথিবীর আসমানে অবতীর্ণ করা হয়। তা ছিল কদরের রাত। তারপর বিশ বৎসর সময়ে প্রয়োজন অনুসারে নাযিল করা হয়। তারপর তিনি এ আয়াতটি পাঠ করেন, “আমি কুরআনকে পৃথককারী বানিয়েছি। যেন প্রয়োজন অনুসারে আপনি মানুষের কাছে পাঠ করতে থাকেন এবং ইহা যেভাবে অবতীর্ণ করা প্রয়োজন সেভাবে অবতীর্ণ করেছি।” (সূরা ঃ বনী ইসরাঈল- ১০৬) আলোচ্য হাদীসের সনদ সহীহ।

 

কুরআন শরীফ ফিতনা হতে পরিত্রাণের মাধ্যম

হযরত হারিস বিন আব্দুল­াহ আল-আওয়ার বলেন, আমি ইশার নামায শেষে আমীরুল মু‘মিনীন হযরত উমর (রা.)-এর নিকট এসে হাদীস বর্ণনা করতে বললাম। তিনি (রা.) ইরশাদ করেন, “আমি রাসূলুল­াহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি- আমার নিকট জিবরাইল (আ.) এসে বলেন, হে মুহাম্মদ (সা.)! আপনার পরে আপনার উম্মতরা বিভিন্ন পথে পরিচালিত হবে। তখন আমি জিবরাইল (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, এ থেকে পরিত্রাণের পথ কি? হে জিবরাইল (আ.)! উত্তরে জিবরাইল (আ.) বলেন, এ থেকে পরিত্রাণের পথ পবিত্র কুরআন রয়েছে। এর দ্বারা আল­াহ তাআলা প্রত্যেক অকৃতজ্ঞ ও অন্যায়কারীকে ধ্বংস করবেন। যে ব্যক্তি আল­াহ তাআলার কুরআন অনুসারে চলবে, সে কৃতকার্য হবে। যে কুরআন মেনে চলবে না, সে ধ্বংস হবে।” একথাটি তিনি দু’বার বলেন।

মোট কথা কুরআন নিয়ে ঠাট্টা করার অবকাশ নেই এবং তা ভিন্নরূপে পাঠ করবে না। কুরআনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কুরআন তোমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে অবহিত করেছে। এভাবে ইমাম আহাম্মদ (র.) বর্ণনা করেন।

وقد قال ابو عيسى الترمذى ثنا عبد بن حميد ثنا حسين بن على الجعفى ثنا حمزة الزيات عن ابى مختار الطائى عن ابن اخى الحارث الاعور عن الحارث الاعور قال مررت فى المسجد فاذا الناس فى احاديث فدخلت على   علي فقلت يا امير المؤمنين الخ                                                     

অর্থাৎ হযরত হারিস আল-আওয়ার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি মসজিদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন কতেক লোক মসজিদের ভিতর হাদীস নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আমি হযরত আলী (রা.)-এর নিকট গিয়ে বললাম, হে আমীরুল মু’মিনীন। আপনি কী দেখেননি কতেক লোক হাদীস নিয়ে আলোচনা করছে? তিনি বললেন, তারা কি তাই করছে? উত্তরে আমি বললাম হ্যাঁ! তখন হযরত আলী (রা.) বলেন- রাসূলুল­াহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি অতিসত্ত¡র তোমাদের মধ্যে ফিতনা অর্থাৎ অন্যায় ও অবিচার শুরু হবে। আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল­াহ (সা.)-এ অবস্থায় পরিত্রাণের পথ কী? তিনি উত্তরে বলেন- আল­াহ তাআলার কিতাবের অনুসরণ করে চললে পরিত্রাণ পাবে। আল­াহ তাআলার কিতাবের ভিতর তোমাদের অতীত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। এটিই হচ্ছে পরিত্রাণ। এ নিয়ে ঠাট্টা করবে না। যে লোক পাশবিক শক্তি দেখিয়ে কুরআন পাকের বিধান অনুযায়ী চলবে না, কুরআন ছেড়ে দেবে- আল­াহ তাআলা তাকে ধ্বংস করবেন। যে ব্যক্তি কুরআন ছাড়া অন্য কিছুতে হিদায়াত পেতে চেষ্টা করবে, আল­াহ তাআলা তাকে গোমরাহ করবেন- এ কুরআন আল­াহ তাআলা প্রদত্ত দৃঢ় ও শক্ত রশি, এ কুরআন হচ্ছে প্রজ্ঞাময়  উপদেশ বাণী, এ কুরআন হচ্ছে সঠিক পথ, যার মধ্যে কু-প্রবৃত্তির কোন অবকাশ নেই, এর ভাষায় কোন সন্দেহ নেই, যার খনি থেকে আলিম সমাজ যতই আহরণ করেন না কেন, তাদের তৃপ্তি মিটবে না এবং কুরআনের নতুন নতুন তত্ত¡ ও তথ্য শেষ হবে না। কুরআন থেকে জ্বিনরাও মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেনি যখন তারা তা শ্রবণ করেছিল। এমন কী জ্বিনেরা বলে-

اِنَّا سَمِعْنَا قُرْاَنًَا عَجَبًا يَّهْدِىْ اِلَى الرُّشْدِ فَاَمَنَّا بِه-

-আমরা কুরআন শ্রবণ করেছি, সত্যিই এ কুরআন আশ্চর্য ও আকর্ষণকারী, যা হিদায়াতের পথ প্রদর্শন করে। এর ফলে আমরা এ কুরআনের উপর ঈমান আনলাম। (সূরা ঃ জ্বিন-১)

যে কুরআনের কথা বলল, সে সত্য বলল এবং যে এ কুরআনের বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করবে সে পুরস্কৃত হবে। যে এ কুরআন অনুসারে রায় প্রদান করে, সে ন্যায় ভিত্তিক কাজ করে। যে এ কুরআন-এর প্রতি আহবান করল, সে সঠিক পথের সন্ধান দিল। হে আওয়ার! তুমি এ কুরআন পাককে আঁকড়ে ধর। তিরমিযী (র.) বলেন, এ হাদীস গরীব।

কিন্তু এ বিষয় নিয়ে হযরত আব্দুল­াহ বিন মাসউদ (রা.) থেকে যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তা হাসান সহীহ বলেছেন। সেই হাদীসের শেষে এ ইবারত বা বর্ণনাটুকু বেশি আছে-

فاتلوه فان الله يأجر كم على تلاوته بكل حرف عشر حسنات- اما انى لا اقول الم- حرف- ولكن الف عشر ولام عشر وميم عشر

অর্থাৎ তুমি এ কুরআন পাঠ কর, এতে তোমাকে প্রত্যেক হরফ বা বর্ণের জন্যে দশটি নেকী দেয়া হবে। তবে, আমি একথা বলছিনা যে, الم একটি বর্ণ; বরং ‘আলিফ’ একটি হরফ, যার জন্যে দশটি নেকী দেয়া হবে, ‘লাম’ একটি হরফ, যার জন্যে দশটি নেকী এবং ‘মিম’ একটি হরফ, যার জন্যে দশটি নেকী দেয়া হবে।

 

হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে আরও এক বর্ণনা এ রকম  আছে-

لا يسأل عبد عن نفسه الا القران فان كان يحب القران فانه يحب الله ورسوله

অর্থাৎ বান্দাহকে তার নিজের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে না বরং কুরআন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। যদি সে কুরআন পাককে মুহব্বত করে থাকে, সে আল­াহ এবং তাঁর রাসূলকে মুহব্বত করে।

হযরত ইবনে শিহাব হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন- রাসূলুল­াহ (সা.)-এর নিকট অন্যান্য নবী বা রাসূলের চেয়ে বেশি ওহী নাযিল হয়েছিল এবং এরপর তাঁর ইন্তিকাল হয়। অর্থাৎ একের পর এক রাসূলুল­াহ (সা.)-এর কাছে প্রয়োজন অনুযায়ী ওহী আসত।

حدثنا ابو نعيم ثنا سفيان عن الاسود بن قيس قال سمعت جندبا يقول اشتكى رسول صلى الله عليه وسلم فلم يقم ليلة او ليلتين فاتته أمراة فقالت يا محمد ما ارى شيطانك الا تركك فانز الله تعالى والضحى ولليل اذا سجى ا ما ودعك ربك وما قلى                                                                             

হযরত আসওয়াদ বিন কাইস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি জুনদুব থেকে শ্রবণ করেছি, তিনি বলেন রাসূলুল­াহ (সা.) অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এক রাত বা দু’রাত তাহাজ্জুদ পড়তে উঠেননি। তাঁর কাছে এক মহিলা এসে বলল, হে মুহাম্মদ! তোমার শয়তানকে তো দেখা যাচ্ছে না- সে তোমাকে ছেড়ে যায়নি তো? তক্ষুনি আল­াহ তাআলা এ আয়াত নাযিল করে- “দ্বি-প্রহর এবং রাতের শপথ, যখন তা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়। আল­াহ তাআলা আপনাকে ত্যাগ করেননি এবং শত্র“তাও করেননি।” হযরত ইমাম বুখারী (র.), মুসলিম (র.), তিরমিযী (র.) এবং নাসায়ী (র.) ভিন্ন ভিন্ন সনদে এ হাদীসখানা বর্ণনা করেন।

কুরআনের ফযীলত বর্ণনায় এ ধরনের হাদীসের উদ্ধৃতি প্রদান  এ জন্যে যে, আল­াহ তাআলা তাঁর রাসূলের কাছে বিরতিহীনভাবে, ধারাবাহিকভাবে অহী নাযিল করা এবং কুরআন পাককে পৃথকভাবে অবতীর্ণ করার অর্থ তার রাসূলের প্রতি অত্যধিক আন্তরিকতা এবং ভালবাসার নিদর্শনের বহিঃপ্রকাশ।


মাসহাফ ও নুকতার প্রচলন

খলীফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের নির্দেশে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কুরআন মজীদে নুকতার প্রচলন করেন। তিনি যখন ওয়াসিত-এ ছিলেন, তখন হযরত হাসান বসরী (র.) এবং ইয়াহইয়া বিন উমর (রা.)-কে দিয়েই এ কাজ করিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেন- মাসহাফে নুকতা সর্বপ্রথম আবুল আসওয়াদ আদদুওয়ালী দিয়েছিলেন। উলে­খ্য যে, মুহাম্মদ বিন সিরীন এর একটি মাসহাফ ছিল, যার মধ্যে ইয়াহইয়া বিন ইয়া’মর নুকতা লাগিয়েছিলেন। হযরত কাতাদাহ (রা.) বলেন, ইয়াহইয়া বিন ইয়া’মরই সর্বপ্রথম نقطه নুকতা লাগিয়েছিলেন। কিন্তু আবূ আমর আদ-দানী হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন- তিনি তা’শীরকে পছন্দ করতেন না এবং মুজাহিদও তা পছন্দ করতেন না। তবে হযরত ইমাম মালিক (র.) এতে কোন অসুবিধা নেই বলে মন্তব্য করেন।

হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আল­াহ তাআলার কিতাবে যা নেই, তা সংযোজন করো না। হযরত আবূ আমর আদদানী বলেন, নুকতা লাগানোর ব্যাপারে সমস্ত মুসলিম জাহান একমত পোষন করেছেন, তাই সর্বত্র এ নুকতা স্বীকৃত হয়েছে।



সাহাবীদের মধ্যে যারা কারী ছিলেন

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- তোমরা চারজন লোক থেকে কুরআন শিখবে। ১. হযরত আব্দুল­াহ বিন মাসউদ (রা.), ২. হযরত সালিম (রা.) ৩. হযরত মুআয বিন জাবাল (রা.) এবং ৪. হযরত উবাই বিন কাআব (রা.)। প্রথমোক্ত দু’জন অগ্রগামী মুহাজিরদের অন্তর্ভূক্ত। সালিম হচ্ছেন হযরত আবূ হুযাইফার গোলাম, যাকে আবূ হুযাইফা আযাদ করে দিয়েছিলেন এবং শেষোক্ত দু’জন অর্থাৎ হযরত মুআজ বিন জাবাল এবং হযরত উবাই বিন কা’ব হচ্ছেন উঁচু শ্রেণীর আনসার। তাঁদের মর্যাদা সম্পর্কে বুখারী এবং মসুলিম শরীফে হাদীস রয়েছে।

 

কুরআন পাঠে প্রশান্তি এবং ফিরিশতার অবতরণ

হযতর লাইস বলেন, আমাকে যায়েদ বিন হাদী, হযরত মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম এবং তিনি হযরত উসাইদ বিন হুদাইর থেকে বর্ণনা করেন, একদা রাত্রিকালে উসাইদ বিন হুদাইর (রা.) সূরা বাকারা পাঠ করছিলেন। তখন তাঁর ঘোড়াটি তাঁর নিকটে বাঁধা অবস্থায় ছিল। ঘোড়াটি নড়াচড়া করতে লাগল। কিন্তু তিনি যখন কুরআন তিলাওয়াত বন্ধ করে দিলেন তখন ঘোড়াটি চুপচাপ হয়ে যায়। এ সময় ঘোড়ার কাছে তাঁর ছেলে হযরত ইয়াহইয়া ছিলেন। তাঁর আশংকা হল ঘোড়া তাঁর ছেলেকে পদদলিত করতে পারে। এ জন্য তিনি কুরআন তিলাওয়াত বন্ধ করে আসমানের দিকে তাকালেন। এক সময় তা অদৃশ্য হয়ে গেল তখন যা দেখার তা দেখলেন। যখন সকাল হলো তিনি রাসূল (সা.)-কে একথা বলেন। হযরত রাসূলুল­াহ (সা.) বলেন, হে ইবনে হুদাইর! তুমি পড়তে থাকলে না কেন? তিনি বলেন, আমি আশংকা করেছিলাম যে, এটা ইয়াহইয়াকে আঘাত করতে পারে, কারণ এটা তার নিকটবর্তী ছিল। হযরত ইবনে হুদাইর বলেন, আমি আসমানের দিকে তাকিয়ে একটি ছায়া দেখতে পেলাম যার ভেতর কতেক সংখ্যক প্রদীপের মত দেখছিলাম। তিনি ফরমাইলেন হে হুদাইর তুমি কি জান! তা কি ছিল, তিনি বলেন, জি না। হুজুর (সা.) ফরমান ওরা ছিল ফিরিশতা যারা তোমার কুরআন পাকের আওয়াজ শুনে নিকটবর্তী হয়েছিল। তুমি যদি সকাল পর্যন্ত পড়তে থাকতে তা হলে ফিরিশতাও সকাল পর্যন্ত অবস্থান করতেন। তাদেরকে মানুষ দেখে ফেলত, মানুষের দর্শন থেকে তারা লুকাতে পারত না। 

 

রাসূলুল­াহ (সা.) কুরআন এবং সুন্নাহ ছাড়া অন্য কিছু রেখে যাননি

কুতাইবা বিন সাইদ হাদীস বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমাদেরকে হযরত সুফিয়ান হযরত আব্দুল আজীজ বিন রাফী থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি এবং শাদ্দাদ বিন মা’কাল হযরত ইবনে আব্বাসের খিদমতে হাজির হলাম। হযরত ইবনে আব্বাসকে শাদ্দাদ বিন মা’কাল জিজ্ঞেস করেন, রাসূলুল­াহ (সা.) কী রেখে গেছেন? উত্তরে ইবনে আব্বাস বলেন, কোন কিছু রেখে যাননি শুধু কুরআন ও সুন্নাহ ছাড়া। অনুরূপভাবে আমরা হযরত মুহাম্মদ বিন আল-হানফিয়াকেও জিজ্ঞেস করলাম, তিনিও একই উত্তর দিলেন। হযরত আবূ দারদা বলেন, নবীরা তাদের ওয়ারিশদের জন্যে দীনার বা দিরহাম রেখে যাননি, রেখে গেছেন ইলম বা বিদ্যা। যে ব্যক্তি ইলম বা বিদ্যা আহরণ করল, সে প্রাচুর্যে পূর্ণ হল। এ জন্যে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) দু’টি বিষয় রেখে গেছেন, তা হল কুরআন এবং সুন্নাহ।

 আল­াহ তাআলা বলেন- 

ثُمَّ اَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِيْنَ اصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا (الاية)

অর্থাৎ আমি ওয়ারিশ বানিয়েছি আমার কিতাবের আমার বান্দাহদের মধ্য থেকে ঐ সমস্ত লোকদেরকে, যাদেরকে আমি নির্বাচিত বা পছন্দ করেছি। (সূরা ফাতির-৩২)


সুললিত ও বিশুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত করা

আল­াহ তাআলার বাণী- اَوَلِمْ يَكْفِهِمْ اَنَّا اَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكَتَابَ يُتْلَى عَلَيْهِمْ “তাদের  জন্যে কি এটা যথেষ্ট নয়, আমি আপনার উপর কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যা তাদেরকে তিলাওয়াত করে শুনানো হবে?” (সূরা আনকাবূত-৫১)

হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল­াহ তাআলা আর কোন বিষয় এত মনযোগ দিয়ে শুনেন না যেরূপ শুনেন কোন নবীর তিলাওয়াত, যখন নবী তা সুললিত কণ্ঠে তিলাওয়াত করেন। يتغنى দ্বারা উদ্দেশ্য হল উচ্চস্বরে তিলাওয়াত। সুফিয়ান বলেন এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সুমধুর স্বরে তিলাওয়াত। ইমাম মুসলিম ও নাসায়ী হযরত সুফিয়ান বিন উআইনা হতে এর কারণ বর্ণনা করেন এভাবে- নবীগণের সৃষ্টিগত পরিপূর্ণতার কারণে তাঁদের তিলাওয়াত হয় সুমধুর, তিলাওয়াতে থাকে পরিপূর্ণ নম্রতা। অন্যদিকে আল­াহ তাআলা তাঁর পূণ্যবান ও পাপী সকল বান্দার আওয়াজই শুনে থাকেন। যেমন আয়িশা (রা.) বলেন, “পবিত্র ঐ সত্ত¡া যার শ্রবণ শক্তি সকল আওয়াজকে বেষ্টন করে আছে-” তবে মুমিন বান্দার কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ গুরুত্ব সহকারে মনযোগ দিয়ে শুনেন। উপরোক্ত হাদীসে উলে­খিত اذن শব্দের অর্থ মনযোগ দিয়ে শ্রবণ। যেমন আল­াহ তাআলা বলেন-

اِذَا السَّمَآءُ انْشَقَّتْ- وَاَذِنَتْ لِرَبِّهَا وَحُقَّتْ- وَاِذَا الْاَرْضُ مُدَّتْ وَاَلْقَتْ مَا فِيْهَا وَتَخَلَّتْ وَاَذِنَتْ لِرَبِّهَا وَحَقَّتْ                                                             

এ আয়াতেও اذن শব্দের মর্ম হচ্ছে মনযোগ দিয়ে শ্রবণ করা। হযরত ফুদ্বালা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে আছে, রাসূলুল­াহ (সা.) বলেন- আল­াহ তাআলার সর্বাধিক মনযোগ ঐ ব্যক্তির প্রতি যিনি সুমধুর স্বরে কুরআন তিলাওয়াত করেন। 

হযরত সায়িব (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাকে হযরত সাদ (রা.) বলেন, ভাতিজা তুমি কী কুরআন পড়েছ? উত্তরে আমি বল­াম, হ্যাঁ। তিনি বললেন- সুর করে কুরআন পড়। কারণ আমি রাসূলুল­াহ (সা.) থেকে শুনেছি। রাসূলুল­াহ (সা.) বলতেন-

غنوا بالقران ليس منا من لم تغن بالقران وابكوا فاذ لم تقدرو اعلى البكاء فتباكوا

অর্থাৎ সুর করে কুরআন পাঠ কর। যে কুরআন সুললিত কন্ঠে পাঠ করে না, সে আমার উম্মত নয়। তিলাওয়াতের সময় কাঁদো, যদি কান্না করতে না পার তা হলে কাঁদার ভান কর। 

হযরত আবূ দাউদ সাদ বিন আবূ ওক্কাস হতে বর্ণনা করেন- 

ان هذا القران نزل بحزن فاذا قرأتموه فابكوا فان لم تبكوا فتباكوا وتغنوا به فمن لم يتغن به فليس منا

অর্থাৎ এ কুরআন চিন্তার কথা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। যখন তা পাঠ করবে, তখন কাঁদো। যদি কাঁদতে না পার, কাঁদার ভান কর। মধুর সূরে কুরআন পাঠ কর। যে সুললিত কন্ঠে কুরআন পাঠ করবে না, সে আমার উম্মত নয়। এখানে تغنى শব্দের অর্থ সুন্দর ও সুললিত কন্ঠ। ইমামগণের নিকট থেকে এভাবে বর্ণনা এসেছে। মোটামুটি হযরত আবু মূসার কিরাত থেকে উদ্ধৃত করে ইমামগণ বলেন- معنى التغنى ,تغن، صوتاحسنا مع خشية تامة ورقة اهل اليمن  শব্দের অর্থ সুন্দর ও সুমধুর কন্ঠ এবং আল­াহ তাআলার পূর্ণ ভয় মনে রেখে কুরআন পাঠ করা। 


তারতীলের সাথে কুরআন তিলাওয়াত

আল­াহ তাআলা বলেন-   وَرَتِّلِ الْقُرْاَنَ تَرْتِيْلاُআর তারতীলের সাথে কুরআন তিলাওয়াত কর। (মুয্যাম্মিল)

وَقُرْاَنًا فَرَقْنَاهُ لِتَقْرَأَهُ عَلَى النَّاس عَلَى مُكْثٍ “আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি খণ্ড খণ্ডভাবে যাতে তুমি তা মানুষের নিকট পাঠ করতে পার ক্রমে ক্রমে।” (সূরা: বনী ইসরাঈল, আয়াত-১০৬)

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) فرقناه শব্দের অর্থ فَصَّلْنَا দ্বারা ব্যাখ্যা প্রদান করেন। এবং مكث শব্দের অর্থ ভয়ভীতি চিন্তা-গবেষণা এবং ভক্তি শ্রদ্ধার সাথে পাঠ করা। ভয়-ভীতির আয়াত পাঠ করলে আল­াহ তাআলার আযাব থেকে পানাহ চাওয়া এবং সুসংবাদের আয়াত পাঠ করা হলে তা অর্জনের জন্যে প্রলুব্ধ হওয়াকে হযরত ইমাম শাফিঈ (র.)-এর অনুসারীরা সুন্নত বলেছেন। তারতীল শব্দের অর্থ হচ্ছে বেশি তাড়াতাড়ি না করা এবং বেশি আস্তে আস্তেও না পড়া এবং মধ্যমভাবে পড়া এবং  চিন্তা করে করে পাঠ করা। কারণ আল­াহ তাআলা বলেন-

كِتَابٌ اَنْزَلْنَاهُ اِلَيْكَ مُبَارَكٌ الِّيَدَّبَّرُا اَيَاتِه وَلِيَتَذَكَّرُو اُوْلُوْ الْاَلْبَابِ 

“এক কল্যাণময় কিতাব, ইহা আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধ শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ গ্রহণ করে উপদেশ।”

হযরত ইমাম আহমদ (র.) আব্দুল­াহ বিন উমর থেকে এবং তিনি রাসূলুল­াহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল­াহ (সা.) বলেন, কিয়ামতের দিন কুরআন তিলাওয়াতকারীকে বলা হবে, তুমি দুনিয়াতে যেভাবে (তারতীল) সুললিত কন্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতে তেমনিভাবে তিলাওয়াত কর এবং আরোহন কর। তোমার অবস্থান হবে সর্বশেষ আয়াতে যা তুমি তিলাওয়াত করতে।

 

কিরাত দীর্ঘ করা

হযরত কাতাদাহ্ (রা.) বলেন, আমি হযরত আনাস বিন মালিককে রাসূলুল­াহ (সা.)-এর কিরাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বলেন, রাসূলুল­াহ (সা.)-এর কিরাত লম্বা ছিল। তারপর তিনি بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ পাঠ করে শুনান بِسْمِ اللهِ কে মদ করে পড়েন এবং الرحيم  কে মদ করে পড়েন। 

উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত-

قالت كان رسول الله صلى الله يقطع قراَنه بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ – اَلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَلَمِيْنَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ- مَالِكِ يَوْمِ الدِّيْنِ- رواه ابو داود

তিনি বলেন- রাসূলুল­াহ (সা.) কুরআন পৃথক পৃথক করে পড়তেন যেমন بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ পড়ে এরপর اَلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَلَمِيْنَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ এভাবে হযরত আবূ দাউদ বর্ণনা করেন।

 

কিরাত পাঠে তারজী’ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল­াহ বিন মুগাফ্ফল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-  আমি নবী (সা.)-কে দেখলাম, তখন তিনি স্ত্রী উট বা পুরুষ উটের উপর ছিলেন। যা দ্বারা তিনি ভ্রমণ করতেন এবং সূরা ‘ফতহ’ বা সূরা ফতহের কিছু অংশ পাঠ করেন এবং তিনি তাতে ترجيع করেন। সে দিন ছিল মক্কা বিজয়ের দিন। ترجيع শব্দের অর্থ একই আওয়াজ বার বার করা। যেমন বুখারী শরীফে আছে, রাসূল (সা.) পড়লেন আ-আ-আ। সম্ভবতঃ তা জানোয়ারের ঝাঁকীতেই দু’তিন বার উচ্চারিত হতো।

 

সুললিত কন্ঠে কুরআন পড়া

হযরত আবূ মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল­াহ (সা.) বলেন- হে আবূ মূসা আপনাকে দাউদ (আ.)-এর বংশধরদের বাঁশরীসমূহের একটি বাঁশরী (সুন্দর কন্ঠস্বর) প্রদান করা হয়েছে। কেননা হযরত আবূ মুসা আশআরী তিলাওয়াতের কন্ঠ খুব সুমধুর ছিল। হযরত ইমাম মুসলিম এ হাদীসকে একটি কাহিনীর সাথে বর্ণনা করেন এবং হযরত ইমাম বুখারী (র.) من لم يتغن بالقران  এর প্রসঙ্গে সুমধুর ও সুললিত কন্ঠের ব্যাপারে তা উলে­খ করেন।

 

[হযরত আল­ামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর তাফসীরগ্রন্থ  ‘আত তানভীর আলাত তাফসীর’ এর ভূমিকা থেকে সংকলিত।

অনুবাদক : আল­ামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর ছোট ছাহেবজাদা; সভাপতি, বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ]

শেয়ার করুন:
  • জনপ্রিয়
  • সাম্প্রতিক

নির্বাচিত

Don`t copy text!