নবী করীম (সা.)-এর সুমহান চরিত্র

মূল: শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)

অনুবাদ: মুহাম্মদ মামুনুর রশিদ

 

আখলাক শব্দটি ‘খুলুকুন’ এর বহুবচন। খুলুকুন خُلُقٌ এর ‘খা’ বর্ণ পেশ যোগে পড়লে অর্থ হবে অভ্যন্তরীণ চরিত্র। আর খালকুন خَلْقٌ  এর ‘খা’ বর্ণে যবর দিলে অর্থ হবে বাহ্যিক আকৃতি। অভিধানগ্রন্থে খুলুকুন এর ‘খা’ বর্ণে পেশ, লাম বর্ণে পেশ বা সাকিনÑ এর অর্থ হচ্ছে স্বভাব, তবিয়ত। ‘সাররাহ’ নামক গ্রন্থে খুলুকুন এর বিভিন্ন অর্থ করা হয়েছে। যেমন সুন্দর আচরণ, বীরত্ব, আনন্দদায়ক ব্যবহার, ভালো ব্যবহার ইত্যাদি। তবে হুযূরে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শানে যে আখলাক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তার অর্থ এর চেয়েও ব্যাপক ও প্রশস্ত। তাঁর আখলাকে শরীফা উপরোক্ত অর্থসমূহের মিলিত অবস্থারও উর্ধ্বে ছিলো। তিনি যেখানে মুসলমানদের প্রতি ছিলেন দয়াময়, স্নেহময়, ঠিক সেখানে হক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, প্রমাণ স্থাপনের ক্ষেত্রে কাফেরদের প্রতি ছিলেন কঠোর।

জ্ঞানীগণের নিকট ‘খুলুক’ এর অর্থ এমন যোগ্যতা যার মধ্যে সহজ ও অবলীলাক্রমে কর্মের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ‘খুলুক’ শব্দের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য কিতাবসমূহে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করা হয়েছে। অবশ্য এতে মতানৈক্য আছে যে, ‘খুলুক’ বা চারিত্রিকগুণ মানুষের স্বভাবজাত, প্রকৃতিগত, জন্মগত স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত নাকি এটা একটি অর্জনযোগ্য বিষয় যা বান্দা রিয়াযত, মুজাহাদা, অর্জন ও প্রজ্ঞার দ্বারা লাভ করে নেয়। এটা যে একটি জন্মগত গুণ, তার প্রমাণ হচ্ছে হযরত ইবন আব্বাস (রা.)-এর এই হাদীস, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “আল্লাহ তাআলা তোমাদের আখলাককে তোমাদের মধ্যে এরকম নির্ধারণ করে দিয়েছেন যেরকম নির্ধারণ করে দিয়েছেন তোমাদের রিযিক (বুখারী)।”

তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কাছে যদি এ সংবাদ আসে যে পাহাড় তার স্বস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে, তাহলে তা তোমরা বিশ্বাস করতে পারো। কিন্তু যদি এ সংবাদ পাও যে অমুক ব্যক্তি তার স্বভাব পরিবর্তন করে ফেলেছেÑ তাহলে এ সংবাদ গ্রহণ করো না। হ্যাঁ, এরপরও আল্লাহ তাআলার এখতিয়ারে সবকিছুই।’

এটা স্থিরকৃত যে, বিভিন্ন মানুষের অবস্থা বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। কিছু লোক তো এমন আছে, যাদের কতিপয় আখলাক এত সুদৃঢ় ও মযবুত যে, তাতে কোনোরূপ পরিবর্তন সাধিত হওয়াটা কষ্টসাধ্য। সেগুলো বর্জন করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। কঠিন রিয়াযত ও মুজাহাদার মাধ্যমে যদি ঐ সমস্ত অবস্থাকে দূরীভূত করার চেষ্টা করা হয় এবং তাকে প্রশংসনীয় অবস্থায় নিয়ে আসতে ইচ্ছা করে, তবে হয়তো পরিবর্তন করা সম্ভব হতেও পারে। কতিপয় আখলাক তুলনামূলকভাবে দুর্বল ও কমজোর হয়ে থাকে, যা চেষ্টাসাধনার মাধ্যমে সুদৃঢ় হয়ে যায়। আবার কতিপয় থাকে শক্তিশালী যা চেষ্টাসাধনার মাধ্যমে দুর্বল হয় না। আখলাক সুন্দর করার জন্য শরীআতে তাগিদ করা হয়েছে। আম্বিয়ায়ে কিরামকে মানুষের আখলাক সুসজ্জিত করার জন্য এবং তাদেরকে হিদায়াত দেয়ার জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে। আখলাক পরিবর্তন করা যদি সম্ভব না হতো তাহলে মানুষকে উত্তমরূপে গঠন করা এবং নবী প্রেরণ করার সার্থকতা কোথায়? দুআ মাছুরায় বর্ণিত হয়েছে “হে আল্লাহ! তুমি যেরকম আমার গঠনকে সুন্দর করেছো সেরকম আমার আখলাক বা চরিত্রকেও সুন্দর করে দাও।” অন্য এক হাদীসে এসেছে, “হে আল্লাহ! তুমি আমাকে উত্তম আখলাকের সন্ধান দাও। তুমি ছাড়া আর কেউ তো উত্তম আখলাকের সন্ধান দিতে পারে না। আর বদ আখলাক আমা থেকে ফিরিয়ে নাও। বস্তুত তুমি ভিন্ন আর কেউ তো বদ আখলাক অপসারিত করতে পারে না।” এসমস্ত হাদীস উম্মতের তালীম ও তালকীনের উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছে।

হযরত আবদুল কায়স সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসে আছে, হুযূরে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  ইরশাদ করলেন, হে আবদুল কায়স, তোমার দুটি স্বভাব আল্লাহ তাআলার নিকট বড়ই প্রিয়। একটি হচ্ছে সহিষ্ণুতা আর অপরটি আত্মমর্যাদা। একথা শুনে তিনি আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ স্বভাব দুটি আমার মধ্যে আগে থেকেই আছে নাকি নতুন সৃষ্টি হলো? হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আগে থেকেই আছে। একথা শুনে তিনি বললেন, আমি আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করি, তিনি আমার মধ্যে প্রকৃতিগত ও জন্মগতভাবে এমন স্বভাবদ্বয় সৃষ্টি করে দিয়েছেন, যা তিনি নিজেই পছন্দ করেন।

উপরোক্ত বর্ণনাসমূহের দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের কতিপয় আখলাক প্রাকৃতিক এবং জন্মগত। আবার এমন কতিপয় আখলাকও আছে যা মানুষের সংকল্প সাপেক্ষ এবং অর্জনযোগ্য।

আখলাক সম্পর্কিত এরকম বৈপরীত্যের সমাধান এভাবে করা যায় যে, যে সমস্ত আখলাক সাহচর্য ও অভ্যাসের কারণে অর্জিত হয় সেগুলির পরিবর্তন ও রূপান্তর সহজসাধ্য। কিন্তু যে সকল আখলাক প্রাকৃতিক, স্বভাবগত এবং স্থায়ী, সেগুলির পরিবর্তন সাধন করা দুরূহ ব্যাপার। তবে সম্ভাব্যতার সীমানার বাইরেÑ এমনটি বলা যায় না। আল্লাহপাক ভালো জানেন।

এরূপ আকীদা বিশ্বাস রাখা অপরিহার্য যে, সমস্ত নবী-রাসূল আলাইহিমুস্সালাতু ওয়াস্সালাম এর আকৃতি ও প্রকৃতিতে সুন্দর চরিত্র, প্রশংসনীয় গুণাবলী, যাবতীয় পূর্ণতা ও মর্যাদা এবং সার্বিক সৌন্দর্য বিদ্যমান ছিলো। এ কারণে তাঁরা সমগ্র মানবজাতি তথা প্রতিটি মানবসন্তানের উপর অগ্রগণ্য ও বিশেষত্ব লাভ করেছিলেন। সম্মানের দিক দিয়ে তাঁরা ছিলেন সকলের উর্ধ্বে। মর্যাদায়ও তাঁরা ছিলেন সবচেয়ে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। ঐ মহান হযরতগণের মর্যাদা ও মাকাম কতোই না উর্ধ্বে হতে পারে যাঁদেরকে হক সুবহানাহু তাআলা স্বয়ং পছন্দ করে, বাছাই করে, মনোনীত করে তাঁর কিতাব কুরআন কারীমে তাঁদের ফযীলত ও প্রশংসার কথা উল্লেখ করেছেন। ওয়া সালামুহু আলাইহিম আজমাঈন।

আকাইদ শাস্ত্রের সুসাব্যস্ত মাসআলা এই যে, কোনো ওলী কোনো নবীর মর্যাদায় পৌঁছতে পারেন না। ইমাম হাফিযুদ্দীন নসফী (র.) তাফসীরে মাদারিকে উল্লেখ করেছেন, কোনো কোনো লোক ওলীকে নবীর উপর মর্যাদা দেয়ার কারণে পদস্খলিত হয়ে গিয়েছে। এটা প্রকাশ্য কুফুরী এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে হ্যাঁ, আল্লাহ তাআলা অবশ্য নবী রসূলগণকে একে অপরের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘ঐ রাসূলগণকে আমি একে অপরের উপর মর্যাদা প্রদান করেছি।’

কাযী ইয়ায মালিকী (র.) স্বীয় কিতাব ‘আশ শিফা’ তে উল্লেখ করেছেন, সমস্ত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম এর আখলাকে কারীমা ছিলো প্রকৃতিগত ও জন্মগত। কোনোটিই অর্জিত ছিলো না। সেগুলি তাঁরা আমলের মাধ্যমে অর্জন করেননি। বরং প্রথম সৃষ্টি ও মৌলিক স্বভাবের মধ্যেই বিদ্যমান ছিলো। কোনোরূপ রিয়াযত ও মেহনতের দ্বারা তা অর্জন করেননি। ঐ আখলাকসমূহ সবই ওজুদে এলাহীর মনোনয়ন ও তাঁর অসীম ফযল ও অনুগ্রহের ফয়ায থেকে আগত। যেমন জনৈক কবির ভাষায়, আল্লাহ তাআলা মহান ও বরকতময়। কোনো নবীর ওহীই অর্জনীয় নয় এবং কোনো নবীকেই গায়েবের সংবাদ প্রদান করার ব্যাপারে অপবাদ দেয়া যায় না। 

এই কবিতাংশে যে ওহীর উল্লেখ করা হয়েছে তার অর্থ নবুওয়াত ও রিসালাত, যা ওহী এবং হিকমতের উৎস ও প্রস্রবন স্বরূপ।

 

কতিপয় নবী আলাইহিস সালাম-এর বাল্যকালীন অবস্থা

কোনো কোনো নবীর আখলাকে কারীমার বহিঃপ্রকাশ বাল্যবেলাতেই ঘটেছিলো। তাঁরা যে নবুওয়াতের পদবীতে ভূষিত হবেন তারও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো বাল্যকাল থেকেই। যেমন হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আমি তাকে বাল্যকালেই হিকমতসমূহ প্রদান করেছি।’  হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম সম্পর্কে এরকম বর্ণিত আছে যে, তাঁর বয়স যখন দুই বা তিন বৎসর, তখন সমবয়সী ছেলেরা তাঁকে বললো, আপনি আমাদের সঙ্গে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করেন না কেনো? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আল্লাহ তাআলাতো আমাকে খেলাধুলা করার জন্য সৃষ্টি করেননি। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম দোলনায় থাকা অবস্থায় বলেছিলেন, “নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর বান্দা, আমাকে আল্লাহ তাআলা কিতাব দান করেছেন এবং নবুওয়াত প্রদান করেছেন।” হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম অন্যান্য শিশুদের মতো যখন শৈশবকাল অতিক্রম করছিলেন, তখন তিনি ফতওয়া প্রদান করতেন। আল্লামা তিবরী (র.) বলেন, উন্নান রাজত্ব যখন তিনি পরিচালনা করতেন, তখন তাঁর বয়স ছিলো মাত্র বারো বৎসর। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কেও কুরআন মজীদে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে প্রথম থেকেই রুশদ অর্থাৎ জ্ঞানবুদ্ধির সঠিকতা প্রদান করেছিলাম।’ এ আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে, আমি তাকে বাল্যকালেই হিদায়েত প্রদান করেছিলাম। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তাঁর সময় ফেরেশতাগণকে তাঁর কাছে পাঠানো হয়েছিলো তাঁকে এ কথাটি জানিয়ে দেয়ার জন্য যে, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেনÑ ‘অন্তর দিয়ে আমার পরিচয় অর্জন করো এবং জিহবা দিয়ে আমার যিকির করো।’ তদুত্তরে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বলেছিলেন, মনপ্রাণ দিয়ে আমি কবূল করলাম। নমরুদ যখন তাঁকে অগ্নিকুÐে নিক্ষেপ করেছিলো, তখন তাঁর বয়স ছিলো ষোল বৎসর। হযরত মুসা আলাইহিস সালাম যে ফেরাউনের দাড়ি ধরে টান দিয়েছিলেন তাও এরকম বয়সেই হয়েছিলো। হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম কে যখন তাঁর ভাইয়েরা কূপে নিক্ষেপ করেছিলো, তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছে ওহী প্রেরণ করেছিলেন, তাও এ বয়সেই। আমাদের প্রিয় আকায়ে নামদার হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্মের সময় দুখানা হাত ও মাথা মুবারক আকাশের দিকে উত্তোলন করে রেখেছিলেন। এটি তো একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা। হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, জাহেলী যুগের আচার অনুষ্ঠানের প্রতি জীবনে আমি দু’বারের বেশী আকর্ষণ বোধ করিনি। কিন্তু সে সময়েও আল্লাহ তাআলা আমাকে রক্ষা করেছেন। প্রথম জীবন থেকেই আমার অন্তরে মূর্তি পূজা এবং (অশ্লীল) কবিতা আবৃত্তির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছিলো।

 

বাল্যকাল থেকে আম্বিয়া কিরামকে আখলাকে হাসানার বৈশিষ্ট্য প্রদান করা হয়েছে। এরপর রিসালাত ও নবুওয়াতের কার্যাবলী দিয়ে তাদেরকে সুদৃঢ় করে দেয়া হয়েছে এবং অনবরত রবের তরফ থেকে পবিত্র সুবাস এসে তাঁদেরকে সুবাসিত করেছে। এমনকি চূড়ান্ত পর্যায়ের উন্নত মর্যাদা এবং কামালিয়াতের শেষ স্তর লাভ করে তাঁরা কৃতকার্য হয়েছেন। এসবই তাঁরা লাভ করেছিলেন মেহনত, রিয়াযত ও কঠোর সাধনা ব্যতিরেকে। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘যখন আকল পূর্ণতায় পৌঁছে দৃঢ়তা অর্জন করলো, তখন আমি ইলম ও হিকমত দান করলাম।’

নবী রাসূলগণের উপরোক্ত গুণাবলীর অংশবিশেষ কোনো কোনো ওলীরও হাসিল হয়ে থাকে। তবে তাঁদের সমস্ত গুণাবলী অর্জন করা ওলীগণের পক্ষে সম্ভব নয়। আর ইসমত (গোনাহ থেকে নিরাপত্তা) তো কেবল নবী রাসূলগণের জন্যই খাস।

বিভিন্ন গুণাবলীতে যাবতীয় আখলাক ও খাসলাত, সিফাতে জামালী ও জালালী ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র ব্যক্তিত্ব এতো উন্নত, উত্তম, পূর্ণাঙ্গ, সুন্দর, দর্শনীয়, উজ্জ্বল ও সুদৃঢ় ছিলো যে, তা ছিলো সীমার অতীত, সংখ্যার উর্ধ্বে ও ধারণক্ষমতার বাইরে। পরিপূর্ণতার কুদরতের ভাÐার ও সম্ভাব্যতার স্তর বলতে যা অনুমিত হয়, ঐ সমুদয়েরও উপস্থিতি তাঁর মধ্যে ছিলো। সমস্ত আম্বিয়া-মুরসালীন ছিলেন চন্দ্রতুল্য আর তিনি ছিলেন সেই চন্দ্রের উপর কিরণ সঞ্চারণকারী সূর্য। তাঁরা সকলেই ছিলেন হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নূরে জামালের প্রতিবিম্বের আধার। বস্তুত আল্লাহ তাআলার জন্যই সমস্ত সৌন্দর্য। ইমাম বুসিরী (র.) কী সুন্দর বলেছেন, সমস্ত আম্বিয়া মুরসালীন যে সকল মু’জিযা সহকারে দুনিয়াতে এসেছেন এসব কিছুই তাঁদের কাছে এসেছে হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নূরে জামাল থেকে। বস্তুতঃ তাঁরা সকলেই ছিলেন হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নূরে জামালের প্রতিবিম্বস্বরূপ। নিঃসন্দেহে তিনিই হলেন ফযীলতের সূর্য। আর অন্যান্য নবীগণ হলেন নক্ষত্রতুল্য। আর নক্ষত্রের আলোর বহিঃপ্রকাশ তো ঘটে তখনই যখন সূর্য থাকে অনুপস্থিত। হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাগরতুল্য। সাগরের সীমাহীন জলরাশি থেকে অন্যেরা যেনো অঞ্জলি পেতে কিছু আহরণ করে নিচ্ছেন। অথবা তিনি হলেন মুষলধারার বৃষ্টি যা থেকে কেউ এক চুমুক গ্রহণ করে কণ্ঠনালী সিক্ত করে নিচ্ছে।

 

হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সত্তায় আল্লাহ তাআলা যে মর্যাদাময় আখলাক ও প্রশংসনীয় গুণাবলীর সমাহার ঘটিয়েছেন, তার আধিক্য, দৃঢ়তা ও মহত্তে¡র প্রশংসা কুরআন কারীমে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, ‘আপনার উপর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ সুমহান।’ হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং ইরশাদ করেছেন, ‘উত্তম আমলের পরিপূর্ণতা বিধানের জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি।’

 

অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘উত্তম চারিত্রিক গুণাবলীকে পূর্ণতা দেয়ার উদ্দেশ্যে আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে।’ আয়াতে কারীমা ও হাদীসের বর্ণনা দ্বারা প্রতীয়মান হয়, হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র সত্তায় সকল সৌন্দর্য ও উত্তম আখলাক সন্নিবেশিত ছিলো। আর কেনোই বা এরকম হবে না? তাঁর শিক্ষক যে ছিলেন স্বয়ং রাব্বুল ইয্যত, যিনি সমস্ত জ্ঞানের উৎস।

 

পবিত্র স্বভাবের এক ঝলক

 সায়্যিদুনা হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, একদা তাঁকে হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আখলাকে কারীমা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো। উত্তরে তিনি বললেন, তাঁর আখলাক ছিলো পবিত্র কুরআন। হাদীসখানার বাহ্যিক অর্থ এইরুপ কুরআন কারীমে যতো উত্তম আখলাক এবং প্রশংসনীয় গুণাবলীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি সে সমস্ত গুণে ভূষিত ছিলেন। কাযী আয়ায (র.) ‘আশ শিফা’ গ্রন্থে এর অতিরিক্ত বিবরণ দিয়েছেন। বলেছেন, কুরআনের পছন্দই ছিলো তাঁর পছন্দ আর কুরআনের অসন্তুষ্টিই ছিলো তাঁর অসন্তুষ্টি। মোট কথা, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি ছিলো আল্লাহ তাআলার হুকুমের যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্যে, আর তাঁর অসন্তুষ্টি ছিলো আল্লাহ তাআলার হুকুমের অস্বীকৃতি ও অবাধ্যতায়। উপরোক্ত হাদীসের মর্মার্থ এরকমই যা উল্লেখ করা হয়েছে।

 

‘আওয়ারিফুল মাআরিফ’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.)-এর উক্ত হাদীসের মর্মার্থ ছিলো এইরুপ কুরআন কারীম ছিলো হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মার্জিত চরিত্র। ‘আওয়ারিফুল মাআরিফ’-এর গ্রন্থকার এ সম্পর্কে সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন। যার সারকথা এইরুপ হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র অন্তঃকরণ থেকে শয়তানের হিস্সাকে নিষ্ক্রান্ত করার পর তাকে ধৌত করে পবিত্র করা হয়েছে। এরপর তাঁর পবিত্র প্রবৃত্তিকে মানবীয় বৈশিষ্ট্যময় প্রবৃত্তির পরিসীমায় এনে স্থির করা হয়েছে। তারপর উক্ত প্রবৃত্তির মানবীয় বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী এই পরিমাণ অবশিষ্ট রেখে দেয়া হয়েছে, যা কুরআন নাযিলের উপযোগী হয়। কেননা নবীতো ঐ মহামানবই হতে পারেন, যাঁর মধ্যে মানবীয় বৈশিষ্ট্য পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান থাকে। পূর্ণ মানবীয় বৈশিষ্ট্যের বিপরীত যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মধ্যে বিদ্যমান ছিলো তা বের করে দেয়া হয়েছে। যে সমস্ত গুণাবলী আদব ও শালীনতাপূর্ণ তথা নবুওয়াতের শানের উপযোগী তা অবশিষ্ট রেখে দেয়া হয়েছে, যাতে মাখলুকাতের উপর রহমত বর্ষণ ও উম্মতের আখলাক-চরিত্রকে মার্জিত করার মাধ্যম হয়। মর্মার্থ এই যে, হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মধ্যে কতিপয় মানবীয় গুণাবলী এজন্য অবশিষ্ট রেখে দেয়া হয়েছে, যাতে মানুষ তাঁকে তাদের নিজের আকৃতি ও স্ব-শ্রেণিভুক্ত দেখতে পায় যাতে তাঁর প্রতি তাদের মহব্বত ও আকর্ষণ জন্মে।

 

হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি কেবল ফেরেশতাদের গুণে গুণান্বিত হতেন, তা হলে মানুষ সন্ত্রস্ত হয়ে যেতো এবং নবীর প্রতি ভালোবাসা ও আকর্ষণ সৃষ্টি হতো না। ফলে মানুষ দূরে সরে যেতো। কাজেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মধ্যে মানবীয় গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য মাখলুকাতের জন্য রহমত ও উম্মতের আখলাক মার্জিত হওয়ার কারণ বটে। একারণেই মানবীয় প্রবৃত্তির অভ্যন্তরে মানবীয় গুণাবলীর মূল প্রবিষ্ট করণের মাধ্যমে অধিক আযমত ও ঘনত্ব প্রদান করা হয়েছে এবং ঈমান ও ইসলামের মাধ্যমে প্রবৃত্তির মুলোৎপাটন করে দিয়ে ঈমানকে কলবে সুদৃঢ় করে দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, তোমার অন্তরকে এ কুরআনের মাধ্যমে প্রশান্ত করে দেয়ার জন্য আমি তা নাযিল করেছি। আর কলবে প্রশান্ত অবস্থা সৃষ্টি হয় এদতেরাব বা চাঞ্চল্যকর অবস্থার পর। কেননা প্রবৃত্তির তৎপরতা তার গুণাবলীর বহিঃপ্রকাশের সাথে সম্পৃক্ত। এজন্যই কলব ও নফসের মধ্যে একটি সম্পর্ক ও যোগসূত্র রয়েছে। যেমন হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সম্মানিত ব্যক্তিত্বে আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিলো তখন, যখন তাঁর দান্দান মুবারক শহীদ করা হয়েছিলো এবং নূরানী চেহারা রক্তে রঞ্জিত করা হয়েছিলো। ঐ সময় তিনি মনের খেদ এভাবে ব্যক্ত করেছিলেন “তারা সংশোধিত হতে পারে কীভাবে, যারা তাদের নবীর চেহারাকে রক্তরঞ্জিত করে দিয়েছে। অথচ তিনি তাদেরকে তাদের রবের দিকেই আহবান করছেন।” ঐ সময় আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র কলবকে ‘ছাবেতা’ অবস্থা প্রদানের উদ্দেশ্যে নাযিল করলেন, ‘বন্ধু হে! একাজের ব্যাপারে আপনার উপর কোনোরূপ বাধ্যবাধকতা নেই যে, সকলকেই আপনি সংশোধন করে ফেলবেন।’ এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র হৃদয় সবরের পরিচ্ছদ পরিধান করলো। এদতেরাব (চাঞ্চল্য)-এর হাল থেকে সকুনত (প্রশান্তি)-এর হালে উপনীত হলো। এরকম বিভিন্ন অবস্থা ও কারণের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর কুরআনের আয়াতসমূহ নাযিল হতে থাকলো এবং তাঁর পবিত্র কলবকে অধিকতর পরিমার্জিত ও পরিচ্ছন্ন করা হতে লাগলো। এমনকি কুরআনুল কারীম তাঁর আখলাকে রূপান্তরিত হলো। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.)-এর বাণীর (কুরআনই ছিলো তাঁর চরিত্র) মর্মার্থ এটাই। তবে প্রকৃত অবস্থা এই যে, হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাকামের হাকীকত এবং মহান অবস্থার নিগুঢ় রহস্য পর্যন্ত পৌঁছতে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি ও বিবেক অক্ষমতা স্বীকার করতে বাধ্য। তাঁর মহান মর্যাদার নিগুঢ়ত্ব কেবল আল্লাহ পাকই জানেন। যেমন আল্লাহ তাআলার যাতে পাকের রহস্য সম্পর্কে হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মতো আর কেউ অবগত হতে পারেননি। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, এ তাবীল আল্লাহ তাআলা ব্যতীত আর কেউ জানে না।

 

কবির ভাষায়: আল্লাহ ছাড়া আর কেউ হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রকৃত কদর ও মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত হতে পারে না। যেমনিভাবে, হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া আল্লাহ তাআলাকে কেউ চিনতে পারে না। তাঁর মাকাম বা মর্যাদা যেহেতু সর্বাধিক উন্নত, কাজেই সে সম্পর্কে অবহিতি লাভ মানুষের জ্ঞান বুদ্ধির উর্ধ্বে।

কবির ভাষায় : ‘তিনি যেরকম, হুবহু সেরকম কি কোথাও কোনো চক্ষু দেখতে সক্ষম হবে? প্রত্যেক ব্যক্তিই আপন আপন জ্ঞানবুদ্ধির ধারণক্ষমতা অনুযায়ী তাঁকে বুঝার জন্য চেষ্টা করে থাকে।’

হাদীসের মর্মার্থ আলোচনায় অনেক কিছুই উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তাঁর শান ও মর্যাদা অনুধাবন পরিসীমার বাইরে। যদি ধরেও নেয়া হয় যে, তাঁকে অনুভব করা যায় অর্থাৎ বাহ্যিক দেহ মুবারককে চর্মচক্ষু দ্বারা অবলোকন করা সম্ভব, তবে দৃষ্টিশক্তির ধারণ ক্ষমতার উর্ধ্বে এটা নিশ্চিত। যেমন, একটি বিশাল পর্বত দৃষ্টি সীমার বেষ্টনীতে আসে না। যদি বলা হয় তিনি বোধগম্য অর্থাৎ আকলের মাধ্যমে তাঁকে বুঝা যায়। তবে এটা নিশ্চিত আকল কিন্তু তাঁকে পূর্ণভাবে লাভ করতে অক্ষম। যেমন আল্লাহ তাআলার সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে পূর্ণভাবে বোঝা যায় না। আল্লাহ তাআলা যেখানে তাঁর আখলাকের বিশেষণে আযীম (মহান) শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং তাঁর জন্য যে মর্যাদা নিরূপণ করেছেন, সেখানেও আযীম শব্দ ব্যবহার করেছেন। সুতরাং তাঁর মহত্ত্বের নিগুঢ়তা সম্পর্কে ধারণা করতে অভিজ্ঞান অক্ষম হতে বাধ্য। এ সম্পর্কে পূর্বেও আলোচনা করা হয়েছে। এতে সকলেরই ঐকমত্য রয়েছে যে, আম্বিয়ায়ে কিরামের প্রশংসনীয় আখলাক ও সুন্দর গুণাবলী সবই সৃষ্টিগত, মৌলিক ও প্রাকৃতিক। তাঁদের এ মহান আখলাক অর্জন করার ব্যাপারে কোনোরূপ চেষ্টা সাধনা বা রিয়াযতের কোনোরূপ ভূমিকা নেই। এর কোনো প্রয়োজনও দেখা দেয়নি। বিশেষ করে সায়্যিদুনা জনাব মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ব্যাপারে তো এর কোনো প্রশ্নই আসে না। যেহেতু তিনি সুমহান আখলাক ও প্রশংসনীয় গুণাবলী দ্বারা সজ্জিত ও মার্জিত হয়েই দুনিয়াতে তাশরীফ এনেছেন। যেমন কবি বলেছেনÑ

“তাঁকে তা’লীম ও আদব শিক্ষা দেয়ার কিইবা প্রয়োজন? যেহেতু তিনি নিজেই শিক্ষক হয়ে তাশরীফ এনেছেন।”

তাঁর মর্যাদার পর্দায় কোনোরূপ রূপান্তর ও পরিবর্তনের কোনো অবকাশ নেই। তাঁর এমন কিছু কিছু আহকাম ও কীর্তি রয়েছে, যাতে সৃষ্টিগত মানবীয় বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যায় না। সেগুলিও বিশেষ স্থান ও অবস্থানের সাথে সম্পৃক্ত। মাহাত্ম্য অনুধাবন করার ব্যাপারে মানুষের অনুমান সে পর্যন্ত ভ্রমণ করতে সক্ষম। তাঁর হাকীকত সম্পর্কে রাব্বুল ইয্যতই অবহিত আছেন। যেমন কবির ভাষায় ‘ধারণার গন্ডিতে আনয়ন করা থেকে তিনি অনেক উর্ধ্বে।’

এ প্রসঙ্গে উহুদ যুদ্ধের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। যখন হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দান্দান মুবারক শহীদ হলো, মাথা মুবারাক যখম হয়ে নূরানী মুখমÐল রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেলো। সাহাবায়ে কিরামের নিকট এ দৃশ্য বড়ই হৃদয়বিদারক ছিলো। তাঁরা নিবেদন করতে লাগলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আপনি এদেরকে বদ দুআ করুন যাতে এরা কৃতকর্মের যথাযোগ্য শাস্তি ভোগ করে। করুণার সিন্ধু মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, আমাকে তো বদ দুআ ও অভিসম্পাতকারী হিসেবে দুনিয়াতে পাঠানো হয়নি। বরং আল্লাহর মাখলুককে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক করে দিতে এবং তাদেরকে দয়া ও ভালোবাসা প্রদান করার উদ্দেশ্যে আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে। তখন তিনি তাদের উদ্দেশ্যে এ দুআ করেছিলেন, ‘হে আমার আল্লাহ! আমার কাওমকে তুমি হিদায়েত দান করো, তাদেরতো জ্ঞান নেই।’ এক্ষেত্রে মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার চরম ও পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। কোথায় চিন্তা? কোথায় ক্লেশ? বিচলিত হওয়ার বিন্দুমাত্র চিহ্ন তাঁর মধ্যে নেই।

‘আওয়ারিফুল মাআরিফ’ গ্রন্থে যে উল্লেখ করেছেন, হুযূরে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মহান সত্তায় প্রথমে হরকত, বিচলিত অবস্থা এবং অধৈর্যের বহিঃপ্রকাশ হয়েছিলো। অতঃপর আয়াতে কারীমা অবতরণের মাধ্যমে ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচ্ছদ পরিধান করানো হয়েছে। ফলে, তাঁর অভ্যন্তরে প্রশান্তি ও স্থিতিশীলতার আবির্ভাব ঘটেছে। এই মিসকীন (আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী র.) এ ধরনের বাক্য ব্যবহার করতে ভীত সন্ত্রস্ত। যদিও এগুলি ইলমী নীতিমালার কিয়াসের ভিত্তিতে সঠিক বলে ধরে নেয়া যেতে পারে, তবুও হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি আদব প্রদর্শনের শানের পরিপন্থি। উপরোক্ত বক্তব্যের কাছাকাছি তিনি আরও বলেছেন যে, হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.)-এর كان خلقه القران হাদীসখানা এক গভীর রহস্যের দিকে ইঙ্গিত প্রদান করছে যে, হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চরিত্র আখলাকে রব্বানীর বাহ্যিক রূপায়ণ। কিন্তু উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) আল্লাহ তাআলার আযমত বা মহত্ত্বের দিকে লক্ষ্য রেখেছেন। তিনি এরূপ বলতে চেয়েছেন যে, হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মহান আখলাক আখলাকে ইলাহীরই প্রকাশস্থল। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) মহান আল্লাহ তাআলার জালালাতে শানের সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রেখে বলেছেন যে, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার আখলাকে রঞ্জিত হয়েই জন্মগ্রহণ করেছেন। কাজেই তিনি উক্ত বক্তব্যটির ভাব এভাবে ব্যক্ত করেছেন, কুরআন ছিলো তাঁর চরিত্র। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) আল্লাহ জাল্লা শানুহুর প্রতি লজ্জাশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে এবং প্রকৃত অবস্থাকে সূক্ষ্ম রূপকতার মাধ্যমে গোপন রেখে এভাবে বলেছেন। এটা তাঁর আকলের পূর্ণাঙ্গতা ও আদবের পরিপূর্ণতার পরিচায়ক। অপরপক্ষে, উক্ত বর্ণনাখানি হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সুমহান ও সীমাহীন সুন্দর আখলাকের অধিকারী ছিলেন সেদিকেও ইঙ্গিত করছে।

কোনো কোনো উলামা এরূপ বলেন, কুরআন পাকের অর্থ ও তাৎপর্য যেমন সীমাহীন, হুযূর আনওয়ার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নূর, কীর্তি, আখলাকে হাসানা ও আওমাকে জামীলা এসবও ঠিক তদ্রুপ সীমাহীন। তাঁর মহৎ আখলাক ও তাঁর সৌন্দর্যাবলী প্রতিনিয়ত প্রতিটি হালেই সজীবতা ও নবতর ভঙ্গিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। আল্লাহ তাআলা যে জ্ঞান ও মারেফত তাঁকে প্রদান করেছেন, তার প্রকৃত পরিচয় আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। সুতরাং তাঁর কোনো আংশিক গুণাবলীকেও জ্ঞানের আওতায় বেষ্টন করার মানসে অগ্রসর হওয়া কোনা দুর্লভ বস্তুকে অর্জন করার ব্যর্থ প্রয়াস তুল্য। ওয়াল্লাহু আলামু।

 

[শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)-এর ‘মাদারিজুন নবুওয়াত’ থেকে অনূদিত।

অনুবাদক: বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক]

শেয়ার করুন:
  • জনপ্রিয়
  • সাম্প্রতিক

নির্বাচিত

Don`t copy text!